বাংলাদেশ

চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের সুর, ভুল শোধরাতে চায় ভারত

ভারতের সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সম্পর্ক বরাবরই ভালো ছিল। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শেখ হাসিনা সরকার নয়াদিল্লির প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত বিষয়ে সংবেদনশীল ছিলেন। বলা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক ছিল গতানুগতিক প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মতোই।  



শুরু থেকেই ভারতের স্বার্থরক্ষায় কাজ করেছে শেখ হাসিনা সরকার। যেমন, ক্ষমতার প্রথম দফায় ভারতের বিরুদ্ধে কাজ করা ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (ইউএলএফএ) এর নেতাদের বন্ধু দেশের সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এছাড়া, উত্তর-পূর্ব সীমান্ত থেকে পালিয়ে আসা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সকল ক্যাম্প বন্ধ করে ভারতের সাথে ভালো প্রতিবেশীর মতো আচরণ করে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টিলিজেন্স এর কার্যক্রমকেও সংকুচিত করে দিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। 


কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক ক্রমেই ইতিবাচক দেখাচ্ছে। চীন ও বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপার ক্রমেই বাড়ছে৷ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে চীনের বাজারে সম্প্রতি ৫ হাজার ১৬১ পণ্যের ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। চলমান মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে চীন বাংলাদেশে একটি মেডিকেল টিমও পাঠিয়েছে৷ তাছাড়া করোনাভাইরাসের টিকা পরীক্ষার জন্য চীনের কোম্পানিকে অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট তিস্তা নদীর প্রজেক্টের জন্য ১ বিলিয়ন ডলার দিবে চীন, এই ঘোষণাও এসেছে৷


এসব কিছু মিলিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ভারতের কপালে। আর তাই হুট করেই সম্প্রতি  বাংলাদেশ সফরে এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্র-সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। একদিনের এই সংক্ষিপ্ত সফরে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র-সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে সামাজিক মাধ্যমে দুই দেশের তিক্ত সম্পর্ক নিয়ে যে কথাবার্তা চলছিল, সে ব্যাপারে পরস্পরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় এবং চলমান সম্পর্ককে আরও বেগবান করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে।


তবে, দুই দেশের সম্পর্কের মন্দার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ দোষ ভারতেরই। বাংলাদেশের অভিবাসীদের অবৈধভাবে আগমন ইস্যুকে নির্বাচনি এজেন্ডায় রূপ দেওয়ায় দুইটি দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষতি হয়েছে। এটি ভারতের কৌশলগত স্বার্থের জন্য সামান্য উদ্বেগের বিষয় হলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ ক্ষমতাসীন বিজেপি এটিকে বড় নির্বাচনি ইস্যু হিসাবে রূপ দিয়েছে। তাছাড়া অমিত শাহ বাংলাদেশি অভিবাসীদের উইপোকা বলেও অভিহিত করেছেন। যদিও তখন এটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কোনো মন্তব্য করেনি। পাশাপাশি শেখ হাসিনার সরকার ৩০ অনুচ্ছেদ বাতিল এবং কাশ্মীরের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রতিবাদও জানায়নি। তবে আসামের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন এবং নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) বড় উদ্বেগের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ 


সিএএ সংশোধন আইন অনুযায়ী, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধসহ আরও কিছু অমুসলিম ধর্মাবলম্বীরা, যারা নিজের দেশে ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে পালিয়ে গেছে, তারা যদি ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করে থাকে, তবে এই আইনের আওতায় ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার উপযুক্ত। এসব সম্প্রদায়ের মানুষজন ভারতে ছয় বছর বসবাসের পর সেখানকার নাগরিকত্ব পাবেন। যা আগে ছিল এগার বছর। তাদের কোনো কাগজপত্র না থাকলেও চলবে। পরবর্তীতে এই সংশোধন আইনের কারণে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় বাংলাদেশে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সাথে বাংলাদেশকে তুলনা দেওয়ায় খুশি হয়নি বাংলাদেশ সরকার। যদিও অমিত শাহ পরবর্তীতে বলেন, বাংলাদেশে এখন বর্তমানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কোনো অবিচার হয় না। 


তাছাড়া আসাম ও বাংলাদেশের সমস্যাগুলোও বহু বছর ধরে চলমান রয়েছে৷ ১৯৮০ এর দিকে আসামে হওয়া আন্দোলনেও ঢাকার সাথে ভারতের সম্পর্কে প্রভাব ফেলেনি। তবে এখন এনআরসি আইন ও অভিবাসীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার আলোচনা স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। যদিও ভারত বারবার বাংলাদেশ সরকারকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, এনআরসি একটি ঘরোয়া বিষয়। তবে উদ্বেগের হলো, সশস্ত্র শিবিরের অনেক বাঙালি-মুসলমান কারাগার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করতে পারে। দিল্লির দাঙ্গার পাশাপাশি ভারতে সাধারণ মুসলিমবিরোধী প্রবণতাও সে দেশের অনেক নাগরিককে ক্ষুব্ধ করেছিল। 


অভিবাসীদের নিয়ে ভারতের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নাগরিকেরা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন৷ শুধু বিরোধীদল নয়, আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও  ভারতের অবস্থান নিয়ে হতাশ হয়েছেন। আর তাই বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে ভারত।  


তবে এতো কিছুর পরেও আগামী বছরের প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন শুরু হওয়ার সাথে সাথে বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান এবং অবৈধ প্রবাহ আবারও বড় আকারে সামনে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


এলএবাংলাটাইমস/ওম/এনএইচ