একজন মানুষের জীবন যত মহৎ, বর্ণিল, বর্ণাঢ্য ও কর্মবহুল হোক না কেন, তার জীবন যেহেতু
সীমিত, তিনি যেহেতু অতিমানব নন, সেহেতু তার কর্মপরিধি ও গুণাগুনেরও একটি সীমা থাকতে
বাধ্য। ফলে একজন মানুষকে নিয়ে অনন্তকাল ধরে অবিরাম কথা বলতে ও লিখতে হলে হয়
একঘেয়ে চর্বিতচর্বন করতে হয় অথবা বানিয়ে বানিয়ে কাল্পনিক ও বানোয়াট কথা বলতে বা লিখতে
হয়। এ জন্যই হয়তো আব্রাহাম লিংকন বা উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনে প্রতিনিয়ত
ভুরিভুরি প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হয়না। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার মহানায়ক টিংকু আবদুর রহমানের জন্ম,
মৃত্যু আর কীর্তি নিয়ে ফি বছর মাতামাতি হয় না। এমনকি আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারতে
মহাত্মাগান্ধী বা জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্ম-মৃত্যুর
দিনে শতশত প্রবন্ধ লেখা বা দিনের পর দিন অনুষ্ঠান করে পত্রিকার পাতায় সরকারি খরচে
ক্রোড়পত্র ছেপে বন্দনা করা হয় না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোটি কোটি টাকা শ্রাদ্ধ করে
গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনী শ্রদ্ধার বানে ভাসানো হয় না। অবৈধভাবে বিলবোর্ড দখল করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের
নামে মরহুম নেতাকে অপমানিত করার নজীরও নেই।
নির্মোহ মূল্যায়নে মরহুম শেখ মুজিব ও শহীদ জিয়াউর রহমান কেউ কারও প্রতিপক্ষ হওয়ার কথা
নয়। দু’জনই পৃথক পটভ’মিতে আপন আলোয় উদ্ভাসিত। দু’জনের বেড়ে ওঠা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
শেখ মুজিব তার তরুণ বয়স থেকে লাগাতারভাবে রাজনীতি ও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
বৃটিশ আমলে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছেন। আবার পাকিস্তান আমলে করেছেন এ
অঞ্চলের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন। পাকিস্তানী স্বৈরশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়েছে, জনগণকে
সংগঠিত করেছেন। তিনি কাজ করেছেন, মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ অনেক
বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। বহুবার তিনি জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। অনেক
উত্থান-পতন ঘটেছে তার জীবনে।
কিন্তু সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ব্যাপার ছিল সম্পূর্ন ভিন্ন। তরুণ বয়সেই তিনি যোগ
দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। পালন করেছিলেন অত্যন্ত সুশৃঙ্খল জীবন। রাজনীতিকদের সঙ্গে কাজ
করার কোন সুযোগই তার ছিল না। ছিল না জেল-জুলুম, সংগ্রাম ও মিছিল-মিটিং এর বর্ণাঢ্য
ক্যারিয়ার। মুক্তিযুদ্ধের আগে দেশের মানুষ তার নামই জানতো না। আরও একটি ক্ষেত্রে দুই নেতার
মধ্যে পার্থক্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরাট অবদান
থাকলেও, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ তার হয়নি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে কি ঘটছিল এ সম্পর্কেও
তার ওয়াকিবহাল থাকার সুযোগ ছিল না পাকিস্তানের জেলে বন্দী থাকার কারণে। কিন্তু জিয়াউর
রহমান একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর কর্মকর্তা হয়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশমাতৃকার পক্ষে বিদ্রোহ
ঘোষণা করেন, কিংকর্তব্যবিমুঢ় জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য কালুরঘাট বেতার
কেন্দ্র থেকে ডাক দেন, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, একটি ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন এবং
অসম বীরত্বের জন্য ‘বীরোত্তোম’ খেতাব পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রক্রিয়াতেই বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা,
রাজনীতিবিদ ও জনগণের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ট সম্পর্কের সূচনা হয়।
শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমানের মধ্যে মিল হচ্ছে- দু’জনই বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান
ছিলেন, দু’জনই প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী গ্রপের হাতে নিহত হয়েছিলেন।
দু’জনই মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে ঘাতকদের সামনে অকুতভয়ে এগিয়ে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন- কেন
তাদের টার্গেট করা হয়েছে। আরেকটি মিল হচ্ছে দু’জনই মৃত্যুর সময় বাংলাদেশের বড় দু’টি
রাজনৈতিক সংগঠন রেখে গেছেন।
অবশ্য শেখ মুজিবের রেখে যাওয়া আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু ১৯৪৯ সালে, যার পেছনে ছিল
মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আতাউর রহমান খানসহ আরও অনেকের শ্রম,
মেধা ও ত্যাগ। পক্ষান্তরে জিয়াউর রহমান দেশের এক টালমাটাল পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়ে বহুদলীয়
গণতন্ত্রের পথ সুগম করে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রয়োজনে নিজে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার
মৃত্যুর সময় দলটির বয়স ছিল মাত্র বছর তিনেক। এই অল্প সময়ে একক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই তিনি
দাঁড় করিয়েছিলেন বিএনপি নামক একটি রাজনৈতিক প্লাটফরম। বিস্ময়কর ব্যাপর হলো সৈনিকের
ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়েও তার মধ্যে একটি গণচরিত্র গড়ে উঠেছিল। তিনি যখন গ্রামে-গঞ্জে গেছেন, তখন
দেখা গেছে নিরাপত্তা বলয় ভেঙ্গে জনসাধারণের সঙ্গে মিশে গেছেন। ঢাকায় থাকলে নেতাকর্মীদের
সঙ্গে মতবিনিময়েই বেশী সময় ব্যয় করেছেন। রাত ১২টায় হলেও একবার পার্টি অফিসে যেতেন।
একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের নেতাকর্মীও চাইলে তার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন।
সম্ভবত সুশৃঙ্খল বাহিনী থেকে আসার কারণে জিয়াউর রহমান প্রশাসক হিসেবে শেখ মুজিবের
তুলনায় অধিক অর্গানাইজড এবং সিস্টেমেটিক ছিলেন। মন্ত্রি-আমলাদের ওপর জিয়ার নিয়ন্ত্রণ ছিল
সংহত। শেখ মুজিব ভাবমূর্তি ও রাজনীতি দিয়ে রাষ্ট্র ও প্রশাসন চালাতে চাইতেন। তাতে চাটুকার ও
মতলববাজদের খপ্পরে পড়ে সুশাসন দিতে পারেননি। নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি লুটপাট ও সন্ত্রাস।
জিয়াউর রহমান চাইতেন শৃঙ্খলা, চেইন অব কমান্ড ও প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা
করতে।
দু’জনের মধ্যে আরেকটি ক্ষেত্রে অমিল ছিল। আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা বঙ্গবন্ধু তার
সমালোচনা খুব একটা সইতে পারতেন না। এজন্য তার সময়ে গণকন্ঠ, হক কথাসহ বহু পত্রিকা
হামলা, মামলা ও বন্ধের মুখে পড়েছে। এক পর্যায়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণে চারটি পত্রিকা রেখে বাকী সব
সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। পক্ষান্তরে জিয়াউর রহমান ছিলেন অনেক বেশী সহনশীল। তিনি
শেখ মুজিব আমলে বন্ধ হওয়া পত্রপত্রিকা খুলে দেন। ইত্তেফাকসহ সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেয়া
সংবাদপত্র ফেরত দেন। সমালোচনার কারণে জিয়ার আমলে কোন সংবাদপত্রে হামলা কিংবা বন্ধ
হয়নি। অবশ্য শেখ মুজিব প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সৌজন্যতা প্রদর্শের ক্ষেত্রে অনেক
উদার ছিলেন। যদিও কট্টর বিরোধী রাজনীতিক সিরাজ শিকদারকে বিচারবহিভ’ত হত্যার শিকার
হতে তার সময়ে।
শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের চ’ড়ান্ত পদক্ষেপ ছিল সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ
করে এক দলীয় বাকশাল শাসন কায়েম করা। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার অল্প
দিনের মধ্যে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক দল করার স্বাধীনতা পুন:প্রতিষ্ঠা করেন এবং
সে সুযোগে বঙ্গবন্ধুর অনুসারিরাও বাকশালের বদলে আওয়ামী লীগকেই পুনরুজ্জীবিত করেন।
ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৭০ এর নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তানে একচ্ছত্র বিজয়, ৭ মার্চের শিহরণ জাগানো ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় পাকিস্তানে বন্দীত্ব,
মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিতে না পারলেও স্বাধীকার সংগ্রামের প্রাণপুরুষ হিসেবে
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শেখ মুজিবের বিপুল পরিচিতি ছিল। পক্ষান্তরে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে তার
শাসনকালে অব্যবস্থা, অদক্ষতা, পরিত্যক্ত সম্পত্তি আত্মসাত, সম্পদ পাচার, হাজার হাজার কোটি
টাকার রিলিফের মাল লোপাট, বিভিন্ন প্রাইভেট বাহিনীর দৌরাত্ম, বেপরোয়া খুনখারাবি, সংবাদপত্র
দলন, পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের ঔদ্ধত্য, দুর্ভিক্ষে লাখো মানুষের মৃত্যু ইত্যাদী
দেশ-বিদেশের পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার পায়, যা বঙ্গবন্ধুর ভাবমুর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
করে।
অপরদিকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব হিসেবে
দেশ-বিদেশে সুপরিচিতি লাভ করেন। উদার গণতান্ত্রিক মানসিকতায় দেশে উন্নয়ন-উৎপাদনের
রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। স্বজনদের ক্ষমতার চৌহদ্দি থেকে দূরে
রেখে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জনমানসে উদ্ভাসিত হন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রভাব
এমনই ছিল যে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় দু’পক্ষই তাকে মধ্যস্থতাকারি হিসেবে মেনে সমঝোতায়
উপনীতি হয়েছিল। দেশেও সৎ ও পরিশ্রমি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। তার
প্রতিপক্ষরাও আজ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অসততার অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেননি।
জিয়াউর রহমানকে যারা পছন্দ করেন না তারা তার বিরুদ্ধে মোটা দাগে যেসব অভিযোগ করেন
সেগুলো হচ্ছে ১. গণতন্ত্রকে হত্যা করে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। ২. ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি
করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিলেন। ৩. বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশ পাঠিয়েছিলেন। ৪.
রাজাকার-আলবদরদের পুনর্বাসিত করেছিলেন। ৫. কর্নেল তাহরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন এবং
বহুসংখ্যক সেনা সদস্যকে কোর্ট মার্শাল’র মাধ্যমে হত্যা করেছিলেন। ৬. রাজনীতিকে কলুষিত
করেছিলেন।
এছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতারা জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের চর, বিশ্বাসঘাতক,
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারিসহ ইত্যাকার অনেক অভিধা দিয়ে হরহামেশা গালিগালাজ করে থাকেন। জিয়াউর
রহমানের বিরুদ্ধ উত্থাপিত অভিযোগগুলো ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণে সমর্থিত নয়। যেমন- ১.
জিয়াউর রহমান জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ
করে এক দলীয় বাকশাল কায়েম করেছিলেন। আর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে প্রথম সুযোগেই
বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। বাক-ব্যাক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা উন্মুক্ত করেছিলেন। ২.
জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেনন। ওই অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন আওয়ামী
লীগেরই শীর্ষ নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং ওই অধ্যাদেশ ড্রাফট করেন আওয়ামী লীগের
অপর শীর্ষ নেতা মনোরঞ্জন ধর। ৩. বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারিদের বিদেশ পাঠিয়ে দেয়া হয় ৩ নভেম্বর
১৯৭৫, যখন জিয়াউর রহমান ছিলেন ক্যান্টনমেন্টে বন্দী। ৪. রাজকার আলবদর তথা
স্বাধীনতাবিরোধীদের ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর ঢালাওভাবে ক্ষমা করে দেন স্বয়ং শেখ মুজিব। ফলে
তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের মত দেশের সমনাগরিত্ব ও সুযোগ-সুবিধা ভোগের অধিকারি হয়ে যান।
বাংলাদেশে গণহত্যার মূল হোতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ১৯৭৪ সালের ২৬জুন ঢাকায় এনে
রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়ার পর জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ধোপে টেকার নয়। ৫. কর্ণেল
তাহের ১৯৭৫ সালের ২৮ নভেম্বর পাল্টা ক্যু করতে গিয়ে ধরা পড়েন। ওই ক্যু প্রচেষ্টায়
সেনাকর্মকর্তারাও জড়িত থাকায় বিচারটি মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে হয়। ওই সময় জিয়াউর রহমান
ছিলেন তিনজন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের একজন। পৃথিবীব্যাপী ব্যর্থ সামরিক ক্যু’র
নায়কদের যে পরিনতি হয় কর্নেল তাহেরের তাই হয়েছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ৬. জিয়াউর
রহমান দেশে গণতন্ত্র পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। সে প্রক্রিয়ায় দেশের
রাজনীতি কলুষিত হয়েছে কিনা এবং সে ধরণের অভিযোগ যুক্তির কষ্টিপাথরে কতটা টিকবে সে
ব্যাপারে বিতর্ক চলতে পারে। তবে ব্যক্তিগতভাবে জিয়ার সৎ, নির্লোভ ভাবমূর্তি জনগণকে আকৃষ্ট
করেছে।
দু:খজনক হলেও সত্য যে, সামরিক জীবনের প্রতি বাঙালি জাতির এক ধরনের উন্মাসিকতা এবং
অধিকন্তু রাজনৈতিক দলাদলির কারণে জিয়াউর রহমানের অনন্য অবদানগুলোকে এখানকার
রাজনৈতিক সমাজ ও সিভিল সমাজ পাশ কাটিয়ে যান কিংবা অস্বীকার করেন। এটাও সত্য যে,
জিয়াউর রহমানের অবদানকে কেউ স্বীকার করুক আর না করুক কিংবা খাটো করে দেখুক আর না
দেখুক ইতিহাস কিন্তু একদিন সাক্ষ্য দেবে। তখন জিয়ার ব্যাপারে তাদের এই ধরনের হীনমন্যতা
প্রকাশ হয়ে পড়বে।
সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে জিয়াউর রহমানকে তার রাষ্ট্র একীভূত পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের
শপথ নিতে হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে চট্টগ্রামে তার অধীনের আরও অনেক
সেনা অফিসার ও সৈনিককে নিয়ে ‘উই রিভোল্ট’ বলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা
করেছিলেন। এটাই ছিল কোন বাঙালি সেনা অফিসারের নেতৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে প্রথম বিদ্রোহ। মুক্তিযুদ্ধ সফল না হলে তার মৃত্যু ছাড়া আর কোন পথ ছিল
না। তিনি তার পরিণতির কথা চিন্তা করেই ইতিহাসের এই অমোঘ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরপর তিনি
২৬ এবং ২৭শে মার্চ পরপর দুইদিন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা
করেন। জিয়াউর রহমান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে
২৬ মার্চ নিজ দায়িত্বে এবং ২৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কথা
১৯৮২ সালে নভেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের ১৫ খন্ডে উল্লেখ রয়েছে।
জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার অমোঘ ঘোষণা সিআইএর মত লন্ডনের সাপ্তাহিক গার্ডিয়ান সহ গুরুত্বপূর্ণ
সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যম লিপিবদ্ধ করে রেখেছে।জিয়ার তেজোদীপ্ত কন্ঠের ঘোষণা শুনেছেন এমন লক্ষ
লক্ষ মানুষ এখনো বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে নি:শ্বাস ফেলছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক ও
আওয়ামী লীগ নেতা জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ, মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, সৈয়দ আলী
আহসান, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল সুখবন্ত
সিং, মেজর জেনারেল লছমন সিং, লে. জেনারেল মতিন, জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়াসহ অনেকেই
তাদের নিজগৃহে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জিয়ার কন্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে উল্লেখ
করেছেন। জিয়া একাত্তরের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭:৪৫ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে
প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গররত অবস্থায় একটি জাপানী জাহাজ থেকে
অষ্ট্রেলিয়া রেডিওতে জিয়ার ঘোষণার বার্তাটি পাঠানো হয়। অস্ট্রেলিয়া রেডিও জিয়ার ঘোষণাটি প্রথম
প্রচার করে। এরপর বিবিসি’তে প্রচারিত হওয়ার পর তা পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
তিনি বিদ্রোহ করে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার সৌধে
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের অজান্তে এই দুটি কাজ
তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থান করে দেয় এবং একই সঙ্গে অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে ।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আরও এক সুযোগে তাকে এই রাষ্ট্রের ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের
স্টিয়ারিং হুইল চেয়ারে বসিয়ে দেয়। এটা কে না জানে যে, তার হাত ধরেই বাংলাদেশে বহুদলীয়
গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠেছিল। বাংলাদেশের
সামরিক বাহিনীর পরিধি বৃদ্ধি করে একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ইতিহাসে জিয়াউর রহমানই এক স্বতন্ত্র্য ব্যক্তিত¦ যিনি জাতির মুক্তি ও জাতি গঠনের দুটি পর্বের
সঙ্গে উৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বরং বলা চলে বাংলাদেশী জাতি গঠনের কাজটি তার মাধম্যেই
সম্পন্ন হয়েছে।
জিয়ার আদর্শের ঝান্ডা যাদের রাজনীতির পুঁজি, তাদেরকে জিয়ার সেই সততা, নির্লোভ, সাহস,
দেশপ্রেম, কর্মনিষ্ঠাসহ গণমুখী চারিত্রিক গুণগুলো রপ্ত করতে হবে প্রশ্নতীতভাবে।
লেখকঃ মারুফ খান (প্রবাসী সংগঠক, সাবেক ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক কর্মী)
সীমিত, তিনি যেহেতু অতিমানব নন, সেহেতু তার কর্মপরিধি ও গুণাগুনেরও একটি সীমা থাকতে
বাধ্য। ফলে একজন মানুষকে নিয়ে অনন্তকাল ধরে অবিরাম কথা বলতে ও লিখতে হলে হয়
একঘেয়ে চর্বিতচর্বন করতে হয় অথবা বানিয়ে বানিয়ে কাল্পনিক ও বানোয়াট কথা বলতে বা লিখতে
হয়। এ জন্যই হয়তো আব্রাহাম লিংকন বা উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনে প্রতিনিয়ত
ভুরিভুরি প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হয়না। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার মহানায়ক টিংকু আবদুর রহমানের জন্ম,
মৃত্যু আর কীর্তি নিয়ে ফি বছর মাতামাতি হয় না। এমনকি আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারতে
মহাত্মাগান্ধী বা জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্ম-মৃত্যুর
দিনে শতশত প্রবন্ধ লেখা বা দিনের পর দিন অনুষ্ঠান করে পত্রিকার পাতায় সরকারি খরচে
ক্রোড়পত্র ছেপে বন্দনা করা হয় না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোটি কোটি টাকা শ্রাদ্ধ করে
গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনী শ্রদ্ধার বানে ভাসানো হয় না। অবৈধভাবে বিলবোর্ড দখল করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের
নামে মরহুম নেতাকে অপমানিত করার নজীরও নেই।
নির্মোহ মূল্যায়নে মরহুম শেখ মুজিব ও শহীদ জিয়াউর রহমান কেউ কারও প্রতিপক্ষ হওয়ার কথা
নয়। দু’জনই পৃথক পটভ’মিতে আপন আলোয় উদ্ভাসিত। দু’জনের বেড়ে ওঠা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
শেখ মুজিব তার তরুণ বয়স থেকে লাগাতারভাবে রাজনীতি ও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
বৃটিশ আমলে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছেন। আবার পাকিস্তান আমলে করেছেন এ
অঞ্চলের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন। পাকিস্তানী স্বৈরশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়েছে, জনগণকে
সংগঠিত করেছেন। তিনি কাজ করেছেন, মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ অনেক
বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। বহুবার তিনি জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। অনেক
উত্থান-পতন ঘটেছে তার জীবনে।
কিন্তু সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ব্যাপার ছিল সম্পূর্ন ভিন্ন। তরুণ বয়সেই তিনি যোগ
দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। পালন করেছিলেন অত্যন্ত সুশৃঙ্খল জীবন। রাজনীতিকদের সঙ্গে কাজ
করার কোন সুযোগই তার ছিল না। ছিল না জেল-জুলুম, সংগ্রাম ও মিছিল-মিটিং এর বর্ণাঢ্য
ক্যারিয়ার। মুক্তিযুদ্ধের আগে দেশের মানুষ তার নামই জানতো না। আরও একটি ক্ষেত্রে দুই নেতার
মধ্যে পার্থক্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরাট অবদান
থাকলেও, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ তার হয়নি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে কি ঘটছিল এ সম্পর্কেও
তার ওয়াকিবহাল থাকার সুযোগ ছিল না পাকিস্তানের জেলে বন্দী থাকার কারণে। কিন্তু জিয়াউর
রহমান একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর কর্মকর্তা হয়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশমাতৃকার পক্ষে বিদ্রোহ
ঘোষণা করেন, কিংকর্তব্যবিমুঢ় জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য কালুরঘাট বেতার
কেন্দ্র থেকে ডাক দেন, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, একটি ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন এবং
অসম বীরত্বের জন্য ‘বীরোত্তোম’ খেতাব পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রক্রিয়াতেই বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা,
রাজনীতিবিদ ও জনগণের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ট সম্পর্কের সূচনা হয়।
শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমানের মধ্যে মিল হচ্ছে- দু’জনই বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান
ছিলেন, দু’জনই প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী গ্রপের হাতে নিহত হয়েছিলেন।
দু’জনই মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে ঘাতকদের সামনে অকুতভয়ে এগিয়ে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন- কেন
তাদের টার্গেট করা হয়েছে। আরেকটি মিল হচ্ছে দু’জনই মৃত্যুর সময় বাংলাদেশের বড় দু’টি
রাজনৈতিক সংগঠন রেখে গেছেন।
অবশ্য শেখ মুজিবের রেখে যাওয়া আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু ১৯৪৯ সালে, যার পেছনে ছিল
মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আতাউর রহমান খানসহ আরও অনেকের শ্রম,
মেধা ও ত্যাগ। পক্ষান্তরে জিয়াউর রহমান দেশের এক টালমাটাল পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়ে বহুদলীয়
গণতন্ত্রের পথ সুগম করে গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রয়োজনে নিজে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার
মৃত্যুর সময় দলটির বয়স ছিল মাত্র বছর তিনেক। এই অল্প সময়ে একক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই তিনি
দাঁড় করিয়েছিলেন বিএনপি নামক একটি রাজনৈতিক প্লাটফরম। বিস্ময়কর ব্যাপর হলো সৈনিকের
ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়েও তার মধ্যে একটি গণচরিত্র গড়ে উঠেছিল। তিনি যখন গ্রামে-গঞ্জে গেছেন, তখন
দেখা গেছে নিরাপত্তা বলয় ভেঙ্গে জনসাধারণের সঙ্গে মিশে গেছেন। ঢাকায় থাকলে নেতাকর্মীদের
সঙ্গে মতবিনিময়েই বেশী সময় ব্যয় করেছেন। রাত ১২টায় হলেও একবার পার্টি অফিসে যেতেন।
একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের নেতাকর্মীও চাইলে তার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন।
সম্ভবত সুশৃঙ্খল বাহিনী থেকে আসার কারণে জিয়াউর রহমান প্রশাসক হিসেবে শেখ মুজিবের
তুলনায় অধিক অর্গানাইজড এবং সিস্টেমেটিক ছিলেন। মন্ত্রি-আমলাদের ওপর জিয়ার নিয়ন্ত্রণ ছিল
সংহত। শেখ মুজিব ভাবমূর্তি ও রাজনীতি দিয়ে রাষ্ট্র ও প্রশাসন চালাতে চাইতেন। তাতে চাটুকার ও
মতলববাজদের খপ্পরে পড়ে সুশাসন দিতে পারেননি। নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি লুটপাট ও সন্ত্রাস।
জিয়াউর রহমান চাইতেন শৃঙ্খলা, চেইন অব কমান্ড ও প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা
করতে।
দু’জনের মধ্যে আরেকটি ক্ষেত্রে অমিল ছিল। আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা বঙ্গবন্ধু তার
সমালোচনা খুব একটা সইতে পারতেন না। এজন্য তার সময়ে গণকন্ঠ, হক কথাসহ বহু পত্রিকা
হামলা, মামলা ও বন্ধের মুখে পড়েছে। এক পর্যায়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণে চারটি পত্রিকা রেখে বাকী সব
সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। পক্ষান্তরে জিয়াউর রহমান ছিলেন অনেক বেশী সহনশীল। তিনি
শেখ মুজিব আমলে বন্ধ হওয়া পত্রপত্রিকা খুলে দেন। ইত্তেফাকসহ সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেয়া
সংবাদপত্র ফেরত দেন। সমালোচনার কারণে জিয়ার আমলে কোন সংবাদপত্রে হামলা কিংবা বন্ধ
হয়নি। অবশ্য শেখ মুজিব প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সৌজন্যতা প্রদর্শের ক্ষেত্রে অনেক
উদার ছিলেন। যদিও কট্টর বিরোধী রাজনীতিক সিরাজ শিকদারকে বিচারবহিভ’ত হত্যার শিকার
হতে তার সময়ে।
শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের চ’ড়ান্ত পদক্ষেপ ছিল সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ
করে এক দলীয় বাকশাল শাসন কায়েম করা। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার অল্প
দিনের মধ্যে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক দল করার স্বাধীনতা পুন:প্রতিষ্ঠা করেন এবং
সে সুযোগে বঙ্গবন্ধুর অনুসারিরাও বাকশালের বদলে আওয়ামী লীগকেই পুনরুজ্জীবিত করেন।
ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৭০ এর নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তানে একচ্ছত্র বিজয়, ৭ মার্চের শিহরণ জাগানো ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় পাকিস্তানে বন্দীত্ব,
মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিতে না পারলেও স্বাধীকার সংগ্রামের প্রাণপুরুষ হিসেবে
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শেখ মুজিবের বিপুল পরিচিতি ছিল। পক্ষান্তরে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে তার
শাসনকালে অব্যবস্থা, অদক্ষতা, পরিত্যক্ত সম্পত্তি আত্মসাত, সম্পদ পাচার, হাজার হাজার কোটি
টাকার রিলিফের মাল লোপাট, বিভিন্ন প্রাইভেট বাহিনীর দৌরাত্ম, বেপরোয়া খুনখারাবি, সংবাদপত্র
দলন, পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের ঔদ্ধত্য, দুর্ভিক্ষে লাখো মানুষের মৃত্যু ইত্যাদী
দেশ-বিদেশের পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার পায়, যা বঙ্গবন্ধুর ভাবমুর্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
করে।
অপরদিকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে ক্যারিশমেটিক নেতৃত্ব হিসেবে
দেশ-বিদেশে সুপরিচিতি লাভ করেন। উদার গণতান্ত্রিক মানসিকতায় দেশে উন্নয়ন-উৎপাদনের
রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। স্বজনদের ক্ষমতার চৌহদ্দি থেকে দূরে
রেখে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জনমানসে উদ্ভাসিত হন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রভাব
এমনই ছিল যে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় দু’পক্ষই তাকে মধ্যস্থতাকারি হিসেবে মেনে সমঝোতায়
উপনীতি হয়েছিল। দেশেও সৎ ও পরিশ্রমি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। তার
প্রতিপক্ষরাও আজ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অসততার অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেননি।
জিয়াউর রহমানকে যারা পছন্দ করেন না তারা তার বিরুদ্ধে মোটা দাগে যেসব অভিযোগ করেন
সেগুলো হচ্ছে ১. গণতন্ত্রকে হত্যা করে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। ২. ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি
করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিলেন। ৩. বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশ পাঠিয়েছিলেন। ৪.
রাজাকার-আলবদরদের পুনর্বাসিত করেছিলেন। ৫. কর্নেল তাহরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন এবং
বহুসংখ্যক সেনা সদস্যকে কোর্ট মার্শাল’র মাধ্যমে হত্যা করেছিলেন। ৬. রাজনীতিকে কলুষিত
করেছিলেন।
এছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতারা জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের চর, বিশ্বাসঘাতক,
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারিসহ ইত্যাকার অনেক অভিধা দিয়ে হরহামেশা গালিগালাজ করে থাকেন। জিয়াউর
রহমানের বিরুদ্ধ উত্থাপিত অভিযোগগুলো ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণে সমর্থিত নয়। যেমন- ১.
জিয়াউর রহমান জিয়াউর রহমান নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ
করে এক দলীয় বাকশাল কায়েম করেছিলেন। আর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে প্রথম সুযোগেই
বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। বাক-ব্যাক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা উন্মুক্ত করেছিলেন। ২.
জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেনন। ওই অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন আওয়ামী
লীগেরই শীর্ষ নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং ওই অধ্যাদেশ ড্রাফট করেন আওয়ামী লীগের
অপর শীর্ষ নেতা মনোরঞ্জন ধর। ৩. বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারিদের বিদেশ পাঠিয়ে দেয়া হয় ৩ নভেম্বর
১৯৭৫, যখন জিয়াউর রহমান ছিলেন ক্যান্টনমেন্টে বন্দী। ৪. রাজকার আলবদর তথা
স্বাধীনতাবিরোধীদের ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর ঢালাওভাবে ক্ষমা করে দেন স্বয়ং শেখ মুজিব। ফলে
তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের মত দেশের সমনাগরিত্ব ও সুযোগ-সুবিধা ভোগের অধিকারি হয়ে যান।
বাংলাদেশে গণহত্যার মূল হোতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ১৯৭৪ সালের ২৬জুন ঢাকায় এনে
রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়ার পর জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ধোপে টেকার নয়। ৫. কর্ণেল
তাহের ১৯৭৫ সালের ২৮ নভেম্বর পাল্টা ক্যু করতে গিয়ে ধরা পড়েন। ওই ক্যু প্রচেষ্টায়
সেনাকর্মকর্তারাও জড়িত থাকায় বিচারটি মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে হয়। ওই সময় জিয়াউর রহমান
ছিলেন তিনজন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের একজন। পৃথিবীব্যাপী ব্যর্থ সামরিক ক্যু’র
নায়কদের যে পরিনতি হয় কর্নেল তাহেরের তাই হয়েছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ৬. জিয়াউর
রহমান দেশে গণতন্ত্র পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। সে প্রক্রিয়ায় দেশের
রাজনীতি কলুষিত হয়েছে কিনা এবং সে ধরণের অভিযোগ যুক্তির কষ্টিপাথরে কতটা টিকবে সে
ব্যাপারে বিতর্ক চলতে পারে। তবে ব্যক্তিগতভাবে জিয়ার সৎ, নির্লোভ ভাবমূর্তি জনগণকে আকৃষ্ট
করেছে।
দু:খজনক হলেও সত্য যে, সামরিক জীবনের প্রতি বাঙালি জাতির এক ধরনের উন্মাসিকতা এবং
অধিকন্তু রাজনৈতিক দলাদলির কারণে জিয়াউর রহমানের অনন্য অবদানগুলোকে এখানকার
রাজনৈতিক সমাজ ও সিভিল সমাজ পাশ কাটিয়ে যান কিংবা অস্বীকার করেন। এটাও সত্য যে,
জিয়াউর রহমানের অবদানকে কেউ স্বীকার করুক আর না করুক কিংবা খাটো করে দেখুক আর না
দেখুক ইতিহাস কিন্তু একদিন সাক্ষ্য দেবে। তখন জিয়ার ব্যাপারে তাদের এই ধরনের হীনমন্যতা
প্রকাশ হয়ে পড়বে।
সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে জিয়াউর রহমানকে তার রাষ্ট্র একীভূত পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের
শপথ নিতে হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে চট্টগ্রামে তার অধীনের আরও অনেক
সেনা অফিসার ও সৈনিককে নিয়ে ‘উই রিভোল্ট’ বলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা
করেছিলেন। এটাই ছিল কোন বাঙালি সেনা অফিসারের নেতৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে প্রথম বিদ্রোহ। মুক্তিযুদ্ধ সফল না হলে তার মৃত্যু ছাড়া আর কোন পথ ছিল
না। তিনি তার পরিণতির কথা চিন্তা করেই ইতিহাসের এই অমোঘ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরপর তিনি
২৬ এবং ২৭শে মার্চ পরপর দুইদিন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা
করেন। জিয়াউর রহমান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে
২৬ মার্চ নিজ দায়িত্বে এবং ২৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কথা
১৯৮২ সালে নভেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের ১৫ খন্ডে উল্লেখ রয়েছে।
জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার অমোঘ ঘোষণা সিআইএর মত লন্ডনের সাপ্তাহিক গার্ডিয়ান সহ গুরুত্বপূর্ণ
সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যম লিপিবদ্ধ করে রেখেছে।জিয়ার তেজোদীপ্ত কন্ঠের ঘোষণা শুনেছেন এমন লক্ষ
লক্ষ মানুষ এখনো বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে নি:শ্বাস ফেলছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক ও
আওয়ামী লীগ নেতা জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ, মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, সৈয়দ আলী
আহসান, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল সুখবন্ত
সিং, মেজর জেনারেল লছমন সিং, লে. জেনারেল মতিন, জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়াসহ অনেকেই
তাদের নিজগৃহে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জিয়ার কন্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে উল্লেখ
করেছেন। জিয়া একাত্তরের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭:৪৫ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে
প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গররত অবস্থায় একটি জাপানী জাহাজ থেকে
অষ্ট্রেলিয়া রেডিওতে জিয়ার ঘোষণার বার্তাটি পাঠানো হয়। অস্ট্রেলিয়া রেডিও জিয়ার ঘোষণাটি প্রথম
প্রচার করে। এরপর বিবিসি’তে প্রচারিত হওয়ার পর তা পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
তিনি বিদ্রোহ করে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার সৌধে
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের অজান্তে এই দুটি কাজ
তাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থান করে দেয় এবং একই সঙ্গে অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে ।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আরও এক সুযোগে তাকে এই রাষ্ট্রের ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের
স্টিয়ারিং হুইল চেয়ারে বসিয়ে দেয়। এটা কে না জানে যে, তার হাত ধরেই বাংলাদেশে বহুদলীয়
গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠেছিল। বাংলাদেশের
সামরিক বাহিনীর পরিধি বৃদ্ধি করে একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ইতিহাসে জিয়াউর রহমানই এক স্বতন্ত্র্য ব্যক্তিত¦ যিনি জাতির মুক্তি ও জাতি গঠনের দুটি পর্বের
সঙ্গে উৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বরং বলা চলে বাংলাদেশী জাতি গঠনের কাজটি তার মাধম্যেই
সম্পন্ন হয়েছে।
জিয়ার আদর্শের ঝান্ডা যাদের রাজনীতির পুঁজি, তাদেরকে জিয়ার সেই সততা, নির্লোভ, সাহস,
দেশপ্রেম, কর্মনিষ্ঠাসহ গণমুখী চারিত্রিক গুণগুলো রপ্ত করতে হবে প্রশ্নতীতভাবে।
লেখকঃ মারুফ খান (প্রবাসী সংগঠক, সাবেক ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক কর্মী)