বাংলাদেশ

মায়ার মন্ত্রিত্বে সাংবিধানিক বাধা নেই

ফৌজদারি অপরাধে দণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে কারো সংসদ সদস্যপদ খারিজ হয় না। তেমনিভাবে

চূড়ান্ত সাজা না হওয়া পর্যন্ত আইনের দৃষ্টিতে কাউকে দোষী বলে গণ্য করা যায় না। আমাদের দেশে

সাজা চূড়ান্তের একমাত্র মালিক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
 
নিম্ন আদালত বা হাইকোর্টে সাজার উপর নির্ভর করে অতীতে কারো সংসদ সদস্য পদ খারিজ হয়নি

বা নির্বাচনের অযোগ্যতা সৃষ্টি হয়নি। তবে নিম্ন আদালত বা হাইকোর্টে দণ্ডের বিরুদ্ধে কারো আপিল

গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত ওই ব্যক্তির দণ্ডাদেশ বহাল থেকে যায়। কিন্তু আপিল গৃহীত হলে তাকে

দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলা হয় না। তিনি গণ্য হন বিচারাধীন ব্যক্তি হিসেবে।
 
দেশ স্বাধীনের পর এখন পর্যন্ত বিচারাধীন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের

ক্ষেত্রে অযোগ্যতার কোন উদাহরণ সৃষ্টি হয়নি। এমনকি পদে বহাল না থাকারও কোন নজীর নেই।

বরং জেনারেল এরশাদসহ অসংখ্য দণ্ডপ্রাপ্ত বিচারাধীন ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পেরেছেন এবং

সংসদ সদস্য পদেও বহাল থেকেছেন।
 
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে নিম্ন আদালতের দেয়া ১৩ বছরের

সাজা বাতিল সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশ সম্প্রতি সুপ্রিম কোার্টের আপিল বিভাগ বাতিল করে

দিয়েছে। এই সাজা বাতিলের পর কোন কোন গণমাধ্যম তার মন্ত্রিত্বে বহাল থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

মায়ার সাজা বাতিলে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশ হয়নি। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর

জানা যাবে যে তার আপিল বিচারাধীন রয়েছে, না নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে তাকে পুনরায়

আপিল করতে হবে?  আপিল বিভাগের রায়ের এ প্রসঙ্গে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় দুদক আইনজীবী খুরশীদ

আলম খান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আপিল বিভাগের এই রায়ের পর ধরে নিতে হবে নিম্ন

আদালতের সাজার বিরুদ্ধে মায়ার আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। সে কারণে তার জামিন

বহাল এবং সাজা স্থগিত থাকবে। দুদকের প্রধান আইনজীবীর বক্তব্য অনুযায়ী মায়ার সাজা স্থগিত

রয়েছে। ফলে তিনি আইনের দৃষ্টিতে অযোগ্য হয়ে পড়েছেন এ কথা বলা যায় না।
 
আমাদের সংবিধানের ৬৬ (২) ঘ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হবার

এবং সংসদ সদস্য থাকবার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্থলন জনিত ফৌজদারি অপরাধে

দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বত্সরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ

বত্সরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।
 
সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ দণ্ড এবং দণ্ডভোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। মায়া এখনো দণ্ড ভোগ করেননি।

এছাড়া তার নিম্ন আদালতের দণ্ড স্থগিত রয়েছে। এ ধরনের একটি সাংবিধানিক প্রশ্নের উদ্ভব

হয়েছিলো জেনারেল এরশাদকে সাজা দেয়াকে কেন্দ্র করে। ১৯৯০ সালে কারাগারে যাওয়ার পর

এরশাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার মধ্যে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত জনতা

টাওয়ার দুর্নীতি মামলা, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পাওয়া উপহার সামগ্রী আত্মসাতসংক্রান্ত দুর্নীতির

মামলাসহ তিনটি মামলায় নিম্ন আদালতে এরশাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। এই সব মামলায়

এরশাদের তিন থেকে ১৩ বছরের দণ্ড দেয় নিম্ন আদালত। এর বিরুদ্ধে এরশাদ হাইকোর্টে আপিল

করেন।
 
নিম্ন আদালতের সাজার সময় এরশাদ সংসদ সদস্য ছিলেন। কিন্তু তার আপিল বিচারাধীন থাকার

কারণে সংসদ সদস্যপদ বাতিলের প্রশ্ন সেসময় উত্থাপিত হয়নি। কিন্তু জনতা টাওয়ার মামলায়

২০০০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এরশাদের সাজা চূড়ান্ত করে। যে কারণে এরশাদ ২০০১

সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। এমনকি তার সংসদ সদস্য পদও খারিজ হয়ে

গিয়েছিলো। কিন্তু নিম্ন আদালতের সাজার পর হাইকোর্টে আপিল করে এরশাদ ১৯৯৬ সালের সংসদ

নির্বাচনে অংশ নিতে পেরেছিলেন। এই ইস্যুটি ১৯৯৬ সালেই উচ্চ আদালত নিষ্পত্তি করে। সেসময়

এরশাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কুড়িগ্রাম আসনে বিএনপি দলীয় প্রার্থী

হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেছিলেন। কিন্তু হাইকোর্ট এরশাদকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ

থেকে বিরত থাকার প্রশ্নে কোন আদেশ প্রদান করেনি।
 
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আদালতের আদেশে কারো সংসদের আসন খালি হয় না। বিদ্যমান

আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন সংসদ সদস্য পদ নিয়ে বিরোধের বিষয়টি নিষ্পত্তি করে। কমিশনের

এ সংক্রান্ত রায়ের পরেই স্পিকার কোন সংসদ সদস্যের আসন শূন্য ঘোষণা করতে পারেন। ফলে

আইন ও সংবিধানের দৃষ্টিতে মায়া এখনো সংসদ সদস্য।
 
নিম্ন আদালতের সাজার পর কারো সংসদ সদস্য পদ চলে গেলে বা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে

অযোগ্য হয়ে পড়লেও বিষয়টি ভবিষ্যতে রাজনীতিবিদদের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। নিম্ন

আদালতের স্বাধীনতা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়েছে। খোদ প্রধান বিচারপতি নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে

প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। ফলে নিম্ন আদালতের সাজাকে চূড়ান্ত সাজা হিসেবে গণ্য করা হলে ন্যায়

বিচার লংঘিত হবে বলে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাদের অভিমত, নিম্ন আদালতের সাজা

চূড়ান্ত নয় বলেই আপিল আদালত থাকে। আর চূড়ান্ত বিচারের আগে কাউকে শাস্তি দেয়া আইনের

ন্যায় দর্শন নয়।