বাংলাদেশ

নাস্তিক লতিফের মামলা টিকবে না

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো সরকার কর্তৃক দায়ের না হওয়ায় সেগুলো খারিজ হয়ে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতদানকারীর বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষমতা কেবল সরকারের। কোনো ব্যক্তির (সরকারি প্রতিনিধি নন) মামলা করার এখতিয়ার নেই। সরকারের প্রতিনিধি কিংবা অনুমোদন ছাড়া আদালতেরও এসব মামলা আমলে নেয়ার এখতিয়ার নেই। এছাড়া বিদেশে সংঘটিত অপরাধের মামলা দেশে করতে হলেও লাগবে সরকারের অনুমোদন। আবার সংবিধান অনুযায়ী, একটি ঘটনায় একাধিক মামলা হতে পারে না। উল্লিখিত তিনটি কারণ দেখিয়ে সম্প্রতি লতিফ সিদ্দিকীর করা রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতেও ১৭টি মামলা কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। ২৬ মে ও ২৩ জুন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নিজামুল হক ও বিচারপতি মো. ফরিদ আহমদ শিবলীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
উচ্চ আদালতের লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা বাতিলের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) শেখ একেএম মনিরুজ্জামান কবির। এ প্রসঙ্গে তিনি বৃহস্পতিবার তার কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, সরকার লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মামলা করেনি, মামলা করেছে পাবলিক (সাধারণ ব্যক্তি)। লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো টিকবে না। মামলা টেকার হলে তো আর হাইকোর্ট স্টে (স্থগিত) করত না। এতে কোনো সন্দেহ নেই। মামলার ত্র“টি আছে বলেই তো মামলা টিকবে না। তবে এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় আমি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।
লতিফ সিদ্দিকীর আইনজীবী ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়–য়া যুগান্তরকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারা অনুযায়ী, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দানকারীর বিরুদ্ধে মামলা করবে সরকার। সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির নালিশ ছাড়া কোনো আদালত মামলাও গ্রহণ করতে পারবেন না। এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৮ ধারা অনুযায়ী, বিদেশে সংঘটিত অপরাধের মামলা দেশে করতে হলে সরকারি অনুমোদন লাগবে। অথচ লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দায়ের করা কোনো মামলা সরকার কর্তৃক দায়ের হয়নি এবং সরকারের অনুমোদনও নেয়া হয়নি। সংবিধানের ৩৫(২) ধারা অনুযায়ী, একই ঘটনায় একাধিক মামলাও আইনত অচল। এসব কারণ দেখিয়ে হাইকোর্টে মামলা বাতিলের জন্য রিট মামলা করেছি। সম্প্রতি আদালতও মামলার ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। এসব মামলা চূড়ান্তভাবে উচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল ঘোষিত হবে বলে আমি মনে করি।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে স্থানীয় টাঙ্গাইল সমিতির এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী। এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার (জনশক্তি) নষ্ট হয়। এই হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গেছেন। এদেও কোনো কাজ নেই। কোনো প্রডাকশন নেই, শুধু ডিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা বিদেশে দিয়ে আসছে। তার এই বক্তব্য সামাজিক গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারের পর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৯৫-কসহ কয়েকটি ধারায় ২৯টি নালিশি মামলা হয়। এসব মামলা করেন বিভিন্ন সাধারণ ব্যক্তি।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার অথবা সরকার কর্তৃক এ বিষয়ে বিশেষরূপে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো অফিসারের আদেশ বা কর্তৃত্ববলে নালিশ ব্যতীত কোনো আদালত দণ্ডবিধির ৬ বা ৯-ক অধ্যায়ে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ অথবা ১০৮-ক, ১৫৩-ক বা ২৯৪ক বা ২৯৫(ক) (ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অপরাধ) বা ৫০৫ ধারা অনুসারে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ আমলে লইবেন না।
দণ্ডবিধির ২৯৫(ক)-এ বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিকদের যে কোনো শ্রেণীর ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত দেয়ার অভিপ্রায় স্বেচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষাত্মকভাবে কথিত বা লিখিত শব্দাবলীর সাহায্যে বা দৃশ্যমান কল্পমূর্তির সাহায্যে ওই শ্রেণীর ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করে বা অবমাননা করার উদ্দেশ্যে করে, সেই ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ড বা উভয়বিধ দণ্ড হবে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতদানকারীর বিরুদ্ধে সাধারণ ব্যক্তি আদালতে নালিশি মামলা করতে পারেন কিনা- জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, পাবলিক (সাধারণ ব্যক্তি) আদালতে মামলা করতে পারেন না। আমাদের আইনের বিধান রয়েছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে দণ্ডবিধির ২৯৫-এ ধারায় যে মামলা করতে হবে তা সরকার কর্তৃক হতে হবে এবং সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হতে হবে এবং সরকারের অনুমতিও লাগবে। যেহেতু মামলাগুলো সরকারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি করেননি এবং সরকারের অনুমোদন নেয়া হয়নি, তাই ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারা অনুযায়ী এই মামলাগুলো অবশ্যই এখতিয়ারবহির্ভূত করা হয়েছে। সেই কারণে এই মামলাগুলো উচ্চ আদালত কর্তৃক খারিজ হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। যার দায়-দায়িত্ব বর্তমান সরকারকে নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, এটা খুব দুঃখজনক যে, যেসব জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এসব মামলা আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়েছেন তারাও ঠিক করেননি। তাদের এই অসতর্কতার কারণে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার পরও লতিফ সিদ্দিকী বিনা সাজায় বের হয়ে যাবেন।
আসামিপক্ষের তিন যুক্তি মেনে নিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষ : আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মতে, তিন ত্র“টির কারণে লতিফ সিদ্দিকীর মামলাগুলোর কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এগুলো হল- সরকার কর্তৃক লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা না হওয়া, দেশের বাইরের অপরাধে দেশে মামলা হলেও অনুমোদন না নেয়া এবং একই ঘটনায় একাধিক মামলা হওয়া।
এ ব্যাপারে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ একেএম মনিরুজ্জামান কবির যুগান্তরকে বলেন, আসামিপক্ষ যে তিনটি আইনি পয়েন্টে যুক্তি উপাস্থপন করেছেন এর বিরুদ্ধে তো আমাদের কিছু বলার নেই। ল পয়েন্টে তো আমি আটকে গেছি। আর আমি তো ল পয়েন্টের বাইরে যেতে পারব না। আসাপিপক্ষের তিনটি যুক্তি সঠিক।
এ প্রসঙ্গে ডিএজি কবির যুগান্তরকে বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হল রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারা অনুযায়ী, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতদানকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে সরকারের কোনো অফিসার। সরকারের অনুমোদন কিংবা সরকারি অফিসারের লিখিত নালিশ ছাড়া আদালত এই অপরাধের মামলাও গ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছেন তারা কেউ সরকারি লোক নন কিংবা সরকারের কোনো অনুমোদন ছিল না।
তিনি আরও বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৮ ধারা অনুযায়ী, দেশের বাইরে সংঘটিত অপরাধের মামলা দেশের আদালতে করতে হলেও সরকারের পূর্বানুমোদন লাগবে। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকীর মামলার ক্ষেত্রে নেয়া হয়নি। কেবল তাই নয়, সংবিধানের ৩৫-এর ২ ধারা অনুযায়ী, একই ঘটনায় একাধিক মামলা হয় না। কিন্তু সাবেক এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। আসামিপক্ষের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত মামলাগুলোর কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষে আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।
মামলা না টেকার পক্ষে আসামি পক্ষের যুক্তি : সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন আদালতে যারা মামলা করেছিলেন তাদের মামলা করার এখতিয়ার ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন লতিফ সিদ্দিকীর আইনজীবী ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়–য়া এবং অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল। এ ব্যাপারে কাজল যুগান্তরকে বলেন, লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছেন তারা অতি উৎসাহী হয়ে করেছেন। যারা মামলা করেছেন তারা কেউ প্রত্যক্ষভাবে ঘটনা শোনেননি, তাদের মামলা করার যোগ্যতাও নেই, কারণ যেখানে ঘটনা ঘটেছে সেখানে তারা প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত ছিলেন না। নিজেরা কানেও শোনেননি। কাজল দাবি করেন, লতিফ সিদ্দিকী একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। তিনি নিজে হজ করেছেন। তিনি মহানবী, হজ, কোরআন সম্পর্কে কোনো সময় কোনো কটূক্তি করেননি। শোনা কথার পর যেসব মামলা করা হয়েছে তা আইনত অচল। এগুলো কোনো মামলাই নয়। এসব মামলা টিকবে না। এসব মামলা উচ্চ আদালতে অবৈধ ঘোষিত হবে ইনশাআল্লাহ।
সিনিয়র আইনজীবীরা যা বললেন : সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আজিজুল হক যুগান্তরকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারা অনুযায়ী, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতদানকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে পারবেন কেবল সরকারি লোক। লাগবে সরকারের অনুমোদনও। এর বাইরে অন্য কোনো ব্যক্তি আদালতে মামলা করতে পারবেন না। করলেও আদালত তা গ্রহণ করতে পারবেন না। কেবল সাবেক জেলা ও দায়রা আজিজুল হক নন; একই মতামত দেন সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান। যুগান্তরকে তিনিও বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতদানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করবেন সরকার। সরকার আদালতে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করবেন। আদালতও তা গ্রহণ করবেন। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে সরকারের কোনো লোক মামলা না করায় তা ত্র“টিপূর্ণ মামলা হিসেবে চিহ্নিত হবে। এ ব্যাপারে সাবেক আইনমন্ত্রী সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কাছে মতামত জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। তাই এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।