বাংলাদেশ

ভাঙনের মুখে জাপা

জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের পিতা-মাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তার স্ত্রী রওশন এরশাদ। এরশাদ নিজেই নিজেদের এ আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ঘোষণার মাত্র দেড় মাসের মাথায় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়লেন এরশাদ ও রওশন।

 জানা গেছে, দলের জ্যেষ্ঠ নেতা জি এম কাদের ও দলের প্রাক্তন মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে ঘিরে হঠাৎ করে এরশাদ ও রওশনের মধ্যে এই বিরোধ দেখা দিয়েছে। দলীয় রাজনীতি নিয়ে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের পিতা এরশাদ ও মাতা রওশন এখন মুখোমুখি। দুজনের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে দলীয় কোন্দল ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে জাতীয় পার্টির এখন বেহাল অবস্থা।

কোন্দলের জের ধরে সোমবার রাতে এরশাদকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান রেখেই রওশনকে ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ ঘোষণা করেছেন দলের বর্তমান মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। আর রংপুর থেকে এ সিদ্ধান্তকে অগঠনতান্ত্রিক আখ্যায়িত করে নেতাদের বহিষ্কারের হুমকি দিয়েছেন পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এরশাদ-রওশনের মধ্যে শিগগির সমঝোতা না হলে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে বহিষ্কার, পাল্টা বহিষ্কার করবে। এতে জাতীয় পার্টি ভাঙতে পারে, এমন আভাস পাওয়া গেছে।

রওশনের ঘনিষ্ঠ জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ‘দলের ফোরামের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়া রংপুরে গিয়ে হঠাৎ করে জি এম কাদেরকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান করায় ম্যাডামসহ আমরা সবাই ক্ষুব্ধ। দলীয় ফোরামে আলোচনা করে পার্টির চেয়ারম্যান চাইলে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।’

 তিনি আরো বলেন, ‘এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে স্যার (এরশাদ) যাতে সরে এসে ম্যাডামের সঙ্গে সমঝোতা করেন, তার জন্যই চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ম্যাডামকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে। যদি তারপরও তিনি তার অবস্থানে অনড় থাকেন, কিংবা ম্যাডামের সঙ্গে সমঝোতা না করেন, তাহলে জাতীয় পার্টি ভাঙতেই পারে। তবে আশা করি, স্যার দলকে বিভক্ত করবেন না।’

 তবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব মেজর (অব.) খালেদ আকতার বলেন, স্যারের সঙ্গে ম্যাডামের দেখা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। স্যার মঙ্গলবার ঢাকায় ফিরে দলের সংসদীয় সভায় যোগ দেবেন। সেখানে ম্যাডামের সঙ্গে দেখা হবে। আশা করি, শেষ পর্যন্ত দুজনের মধ্যে সমঝোতা হবে।

 জানা গেছে, আজ মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যেই রংপুর থেকে ঢাকায় ফিরবেন এরশাদ। তারপর বিকেলে জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন উপলক্ষে দলের সংসদীয় সভায় যোগ দেবেন তিনি। এ সময় তিনি রওশনের মুখোমুখি হবেন। ওই বৈঠকেই এরশাদ-রওশনের মধ্যে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার ও আলাদা জাতীয় পার্টি গঠনের মতো ঘটনা ঘটতে পারে।

 রোববার তিন দিনের সফরে রংপুরে গিয়ে দলের এক সভায় এরশাদ তার ছোট ভাই জি এম কাদেরকে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এবং প্রাক্তন মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে দলের জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটির সদস্যসচিব ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে ঘোষণা দেন, শিগগিরই মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসবে জাতীয় পার্টি। এমন ঘোষণার পরপরই নড়েচড়ে বসেন সরকারে থাকা জাতীয় পার্টির তিন মন্ত্রীসহ জি এম কাদের ও হাওলাদারের বিরোধীরা।

 দলের নেতাদের অভিযোগ, মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগে রাজি না থাকা দলের তিন মন্ত্রীসহ জি এম কাদের ও হাওলাদারবিরোধীরাই মূলত এরশাদের বিরুদ্ধে পাল্টা অবস্থান নিতে রওশনকে প্ররোচনা দিচ্ছেন। তারাই হঠাৎ করে এরশাদের পক্ষ ত্যাগ করে বিরোধী নেতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এসব নেতাদের অনেকেই কিছুদিন আগে রওশনকে মাইনাস করার খেলায় মেতেছিলেন। আবার তারাই জি এম কাদের ইস্যু সামনে রেখে এরশাদকে মাইনাস করার চেষ্টা করছেন।

 জানা গেছে, জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান ঘোষণার পর থেকে দুদিনে বিরোধী নেতার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন তিন মন্ত্রী ও দলের মহাসচিবসহ শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা। শেষ পর্যন্ত তারাই রওশনকে এরশাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে রাজি করাতে সক্ষম হন।

 সূত্র জানায়, জাতীয় পার্টি শিবিরে আগ থেকেই দলের ফ্রন্ট লাইনে নেতৃত্বের প্রশ্নে জি এম কাদেরের ব্যাপারে আপত্তি বিরোধী দলীয় নেতা রওশনের। একইভাবে প্রাক্তন মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বর্তমান মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। কো-চেয়ারম্যান করায় জি এম কাদেরই হবেন এরশাদের পরে জাতীয় পার্টির সর্বেসর্বা। এ ক্ষেত্রে রওশন গুরুত্বহীন হয়ে যেতে পারেন। একইভাবে পার্টির জাতীয় সম্মেলনের সদস্যসচিব করায় রুহুল আমিন হওলাদার জাতীয় পার্টির ফ্রন্টলাইনে চলে আসছেন। এ কারণে মহাসচিব হওয়ার পরও বাবলুকে ক্ষমতাহীন হয়ে থাকতে হবে। এসব আশঙ্কা থেকে দলের মহাসচিব গ্রুপটি হঠাৎ করে প্রকাশ্য এরশাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা দলে ভিড়িয়ে নেন বিরোধী দলীয় নেতা রওশনকেও। এসব নেতাই দফায় দফায় বৈঠক করে এরশাদকে ঘায়েল করতে সোমবার সন্ধ্যায় রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন বলে জাতীয় পার্টির নেতাদের ধারণা।

 এদিকে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে বর্তমানে এরশাদ রওশন দুজনই মুখোমুখি অবস্থানে। দুজনের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরাও এখন বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কেউ এরশাদের পক্ষে, কেউ রওশনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

 দলের নেতারা জানান, জাতীয় পার্টির তিন নেতা কোনোভাবেই মন্ত্রিত্ব ছাড়তে রাজি নন। কিন্তু পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় নেতা দুজনই চান তারা বেরিয়ে আসুক, জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করুক।

সামনে মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসার মতো সিদ্ধান্ত আসতে পারে জেনে জি এম কাদেরের ইস্যুকে পুঁজি করে দলের একটি গ্রুপ রওশনকে এরশাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। হঠাৎ করে বিরোধী দলীয় নেতার পক্ষ নিয়ে তারা নিজেদের ফায়দা লুটতে চাইছেন বলেও নেতাদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন।

 এরশাদের ঘনিষ্ঠ জাতীয় পার্টির এক প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, পার্টির চেয়ারম্যান দলের গঠনতন্ত্রের ৩৯ ধারার ক্ষমতা বলে যেকোনো সময় যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারো সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই একইভাবে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে দলের মহাসচিব করেছিলেন। তখন তো এসব নেতা চুপ ছিলেন।

 দলের ওই নেতা আরো বলেন, দলের চেয়ারম্যান বর্তমান রংপুরে আছেন। দলের কোনো নেতার বিরুদ্ধে তিনি যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, কিংবা পার্টির গঠনতন্ত্রবিরোধী সিদ্ধান্ত হয়েও থাকে তাহলে সেটা দলীয় ফোরাম ডেকে কিংবা স্যারকে জিজ্ঞেস করা যেত। পার্টির চেয়ারম্যান বহাল থাকা অবস্থায় অতি উৎসাহী হয়ে ম্যাডামকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা অবৈধ কাজ। এসব অপকর্ম দলের সঙ্গে বেইমানি ছাড়া আর কিছু নয়।’ জিয়াউদ্দিন বাবলুদের প্ররোচনায় রওশন এরশাদকে দিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।