বাংলাদেশ

আসন্ন নাটোরের সিংড়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে সরাসরি হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে

আসন্ন নাটোরের সিংড়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে সরাসরি হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ও নাটোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য জুনাইদ আহমেদ পলকের বিরুদ্ধে। নিজের শ্যালক উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফুল হাবীব রুবেলকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জিতিয়ে আনতে অন্য প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। প্রার্থীদের বুঝানোর জন্য এক প্রার্থীকে উপহার দিয়েছেন পুকুর। অন্যদিকে আদেশ না মানায় অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরেক প্রার্থী।
উপজেলা পরিষদে প্রথম ধাপের নির্বাচন হবে ৮ মে। এ ধাপেই হতে যাচ্ছে নাটোরের সিংড়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। তফসিল ঘোষণার পর তাই নিয়ম অনুযায়ী গণসংযোগ শুরু করেন পাঁচ চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। উপজেলাজুড়ে ছিল নির্বাচনী আমেজও। কিন্তু হঠাৎ থমকে যান তিন প্রার্থী। মাঠে টিকে থাকেন কলম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য দেলোয়ার হোসেন এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফুল হাবীব রুবেল। এই লুৎফুল হাবীবের আরেকটি পরিচয়, তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ও নাটোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক।
এলাকাবাসী জানান, উপজেলা পরিষদের পরবর্তী চেয়ারম্যান হতে নির্বাচনী মাঠে নেমেছিলেন উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি কামরান হাসান কামরুল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম ভোলা, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ও কলম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য দেলোয়ার হোসেন- এ চার প্রার্থীও। কিন্তু নিজের শ্যালককে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতাতে বাকি প্রার্থীদের নির্বাচন না করার নির্দেশ দেন প্রতিমন্ত্রী পলক। সেজন্য একজনকে পুকুর উপহার দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। তবে বেঁকে বসেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দেলোয়ার হোসেন। প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় ১৫ এপ্রিল সোমবার তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে মারধর করেছেন লুৎফুল হাবীবের ঘনিষ্ঠরা। এখন তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার যুবলীগ নেতা সুমন আহমেদ গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নাটোরের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী লুৎফুল হাবীবের পক্ষ নিয়েই তারা দেলোয়ার হোসেনকে অপহরণ ও মারধর করেছেন, যার ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে।  
নির্বাচনী মাঠে চার প্রতিদ্বন্দ্বী থাকায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হওয়া নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক লুৎফুল হাবীবের। সংকট মোকাবিলায় প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২৯ মার্চ তার ঢাকার বাসায় সমঝোতা বৈঠক হয়। সেখানে ছিলেন জাহেদুল ইসলাম ভোলাসহ সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস, আরিফুল ইসলাম, মাওলানা রুহুল আমিন ও পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবীব রুবেল। সেখানে লুৎফুল হাবীবকে একক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। সে সময় একক প্রার্থী হিসেবে শ্যালককে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন পলক। সে ধারাবাহিকতায় এলাকায় ফিরে নির্বাচন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন প্রার্থী জাহেদুল ইসলাম ভোলা। হুমকির স্বরে প্রতিমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের কথা অপর তিন প্রার্থীকে জানালেও নির্বাচন থেকে দুজন সরে যান বলে জানিয়েছে দেশের একটি জাতীয় দৈনিক। প্রতিমন্ত্রীর বাসায় এ গোপন বৈঠকের কথা স্বীকার করেছেন সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওহিদুর রহমান শেখ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস। সেই বৈঠকের একটি ছবিও আছে ইত্তেফাকের এই প্রতিবেদকের কাছে। তাদের মধ্যে ওহিদুর রহমান বলেন, ঢাকায় যেদিন সমঝোতা বৈঠক হয়েছে, সেদিন তিনি অসুস্থ ছিলেন। একারণে ওই সভায় অংশ নিতে পারেননি। ওই সমঝোতা বৈঠকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক লুৎফুলকে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই কথা জানালেন সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌসও। তিনি বলেন, প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে নির্বাচনকে ঘিরে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় কয়েক দফায় বৈঠক করা হয়েছে। সবশেষ ২৯ মার্চ প্রতিমন্ত্রীর শ্যালকসহ দুই প্রার্থীকে নিয়ে প্রতিমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রার্থীদের সম্মতিতে প্রতিমন্ত্রীর শ্যালককে একক প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত হয়। চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোলার কয়েকজন সমর্থক জানান, দুই প্রার্থীকে হুমকি দিয়ে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাহেদুল ইসলাম ভোলাকে প্রায় কোটি টাকা দামের একটি পুকুর উপহার দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছেন প্রতিমন্ত্রী পলকের লোকজন।  
একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে প্রতিমন্ত্রীর শ্যালকের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়েছে ঈদের আগেই। কিন্তু লুৎফুল হাবীবের ফাঁকা মাঠে ঢুকে পড়েন দেলোয়ার হোসেন। তিনি সোমবার মনোনয়নপত্র জমা দিতে সশরীরে নাটোর জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে যান। এদিন প্রথমে এই প্রার্থীর দুই ভাই কলম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দীন মুন্সিকে এবং বিকেল ৪টার দিকে প্রার্থীকে নির্বাচন কার্যালয়ের সামনে থেকে কালো মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। সিসিটিভি ফুটেজে প্রতিমন্ত্রী পলক ও প্রার্থী লুৎফুলের ঘনিষ্ঠজনদের অপহরণ করতে দেখা গেছে। অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার দেলোয়ারের চাচাতো ভাই আছের উদ্দীন ব্যাপারী বলেন, চেয়ারম্যান প্রার্থী প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক লুৎফুল হাবীবের নির্দেশে মোহন আলী নেতৃত্বে দেলোয়ারকে অপহরণ করে নির্যাতন করা হয়। এদিন রাতে অচেতন অবস্থায় সড়কের ধারে দেলোয়ারকে পাওয়া যায়। সেখান থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। পরে জ্ঞান ফিরলে তাকে সাধারণ ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

দেলোয়ারের বড় ভাই এমদাদুল হক বলেন, ছোট ভাই দেলোয়ার নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ায় প্রতিমন্ত্রীর ইশারায় দলীয় লোকজন তার ভাইকে অপহরণ করে নির্যাতন করেছে।  এদিকে অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার লুৎফুল হাবীব রুবেল বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী দেলোয়ারকে তার অনুসারীরা কেন তুলে নিয়ে গেছেন তা তিনি জানেন না। এই ঘটনায় তার কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকার দাবি করেন তিনি। আর এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব না হলেও তার ব্যক্তিগত সহকারী সাদ্দাম হোসেন জানান, প্রতিমন্ত্রী সিঙ্গাপুরে গেছেন। নাটোরের পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম জানান, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যারা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ সক্রিয় অবস্থানে রয়েছে। এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস