বাংলাদেশ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী নাম শেখ হাসিনা

 শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী নাম। প্রায় দেড় দশক ধরে তিনি দেশ শাসন করেছেন, এবং তার নেতৃত্বকে অনেকে আয়রন লেডি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সেই আয়রন লেডি উনার জন্য এমন এক সমাপ্তি অপেক্ষা করছিল যা কেউ কল্পনাও করেনি। ক্ষমতার অপব্যবহার, একগুঁয়েমি, অহংকার, এবং জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি অবজ্ঞার কারণে শেষ পর্যন্ত তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিরল ও নজিরবিহীন ঘটনা। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি, এবং নানা অপকর্মের কারণে জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগ, যা মূলত আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন, তাদের বিভিন্ন অপকর্ম ও দুর্নীতি, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, সহিংসতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার, সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড সরকারের বিরুদ্ধে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং সরকারের প্রতি আস্থা কমিয়ে দেয়। এর ফলে জনগণের মধ্যে একটি পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, যা হাসিনা সরকারের পতনের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জনগণের এই অসন্তোষ এবং ক্ষোভ পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়, যা সরকারের স্থিতিশীলতায় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনে তার দৃঢ়তা এবং কঠোর নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছে। তবে এই দৃঢ়তা এবং একগুঁয়েমি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়েছে এক ধরনের অহংকারে, যা শেষ পর্যন্ত তার পতনের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার তাগিদে তার মধ্যে একধরনের অতি আত্মবিশ্বাস দেখা দিয়েছিল, যা তাকে জনগণের চাহিদা ও মনোভাব থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার শাসনামলে বিরোধীদের দমন-পীড়ন এবং ক্রসফায়ার ও খুনের ঘটনাগুলো সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সরকার বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ঘুম, খুন, এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ারের মতো কঠোর পদ্ধতি ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব কার্যক্রম সাধারণ মানুষের মনে ভীতি এবং অসন্তোষ উভয়ই জন্ম দেয়। জনগণ এই ধরনের নিপীড়নমূলক কার্যকলাপকে গণতন্ত্রের পরিপন্থী ও মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে দেখে, যা সরকারের প্রতি আস্থাহীনতা এবং অসন্তোষের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে, সরকার বিরোধী মতামত ও আন্দোলনের সংখ্যা বাড়ে, এবং জনমনে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা আরও দৃঢ় হয়। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে তাদের প্রতি 'রাজাকার' শব্দ ব্যবহার করেন। এই মন্তব্য ছিল তার অহংকারের একটি প্রকাশ, যা ছাত্রদের মধ্যে আরও বেশি ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং তাদের আন্দোলন আরও তীব্র করে তোলে। এই ধরনের অবমাননাকর মন্তব্য শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বিরোধিতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হাসিনার সরকার ছাত্রদের বৈধ দাবিগুলোকে অবজ্ঞা করার প্রবণতা দেখিয়েছিল, যা তাদের শাসনের ওপর জনগণের আস্থা কমিয়ে দেয়। ২০২৪ সালে শিক্ষার্থীরা যখন কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন শুরু করে, তখন সরকার তাদের দাবিগুলো বিবেচনা না করে বরং কঠোরভাবে দমন করার চেষ্টা করে।শান্তিপূর্ণভাবে চলতে থাকা এই আন্দোলনকে সরকারের পক্ষ থেকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করার চেষ্টা করা হয়।এর ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে এবং জনগণের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব আরও জোরালো হয়ে ওঠে। আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রচুর প্রাণহানি ঘটে, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সরকারের এই কঠোরতা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনের পতন ঘটাতে সাহায্য করে। জনগণের মধ্যে এই ধারণা জন্মায় যে, হাসিনা সরকার জনগণের কণ্ঠরোধ করতে চায় এবং গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায়। এই ধারণা তার পতনের জন্য অন্যতম একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে তার সরকারের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে অর্থ পাচার এবং অর্থনৈতিক মন্দা তার শাসনের অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সরকারের ব্যর্থতা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়ে তোলে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা জনগণের জীবনের মানকে প্রভাবিত করেছে এবং তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সরকারের ওপর থেকে জনগণের আস্থা চলে যায়। একই সঙ্গে, সরকারের অপ্রয়োজনীয় খরচ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়িয়ে তোলে। শেখ হাসিনার সরকার ব্যর্থতার দায় স্বীকার না করে বরং বিরোধীদের দমন করার নীতি অবলম্বন করে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে এবং জনগণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা দ্রুত কমিয়ে দেয়। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কও সংকটে পড়ে। বিশেষ করে ভারতের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি তার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করে। ভারতের প্রতি নির্ভরশীলতার ফলে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বেড়ে যায়, এবং তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে স্বাধীনতার চেতনার বিপরীত মনে করতে শুরু করে। এই আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ব্যর্থতা শেখ হাসিনার সরকারের ওপর থেকে জনগণের আস্থা কমিয়ে দেয় এবং বিরোধীদের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। শেখ হাসিনার ভারত-নির্ভর নীতি তাকে রাজনৈতিকভাবে আরও বিচ্ছিন্ন করে তোলে, এবং তার শাসনের অবসানের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শেখ হাসিনার সরকার এই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি এবং ভোট ডাকাতির অভিযোগের সম্মুখীন হয়, যা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ওপর একটি কালো ছায়া ফেলেছিল। জনগণের মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে, শেখ হাসিনা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চাচ্ছেন এবং তার ক্ষমতা ধরে রাখতে যে কোনো উপায়ে ব্যর্থ হচ্ছেন।এই বিতর্কিত নির্বাচনের ফলে জনগণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা কমে যায় এবং বিরোধীরা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সরকারের একনায়কতন্ত্রের নীতি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অবজ্ঞা তার পতনকে আরও ত্বরান্বিত করে। শেখ হাসিনার পতন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে। এই ঘটনা আমাদের শিখিয়েছে যে, জনগণের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করা, একগুঁয়েমি ও অহংকারের ভিত্তিতে শাসন করা, এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ব্যর্থ হওয়া শেষ পর্যন্ত যে কোনো সরকারের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তার পতন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতা ও সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। ক্ষমতার অপব্যবহার, জনগণের মতামতের প্রতি অবজ্ঞা, এবং গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করার পরিণাম শেষ পর্যন্ত নেতিবাচক হয়। ভবিষ্যতের নেতা ও সরকারগুলির জন্য এই ঘটনা একটি সতর্ক সংকেত, যা তাদের শাসনের নীতি ও পদ্ধতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।বাংলাদেশের জনগণ এখন একটি নতুন নেতৃত্বের সন্ধানে রয়েছে, যারা গণতন্ত্র, সুশাসন, এবং জনগণের কল্যাণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। শেখ হাসিনার শাসনের পতন একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। শেখ হাসিনার শাসনের পতনের পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত হবে।এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ক্ষমতার অহংকার ও একগুঁয়েমি শেষ পর্যন্ত যে কোনো নেতার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, এবং জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়া কোনো সরকারের টিকে থাকার সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।   এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস