বাংলাদেশ

চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার উচ্চাবিলাষী বাজেট

জাতীয় সংসদ অধিবেশনে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ বছরের বাজেটের আকার চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। তবে সুশীল সমাজ ও অর্থনীতিবিদরা এই বাজেটকে একটি উচ্চাবিলাষী বাজেট বলে অভিহিত করছেন।

৭ জুন, বৃহস্পতিবার চলতি অধিবেশনের দুপুরে বাজেট উপস্থাপন শুরু করেন অর্থমন্ত্রী।

আবুল মাল আবদুল মুহিতের ব্যক্তিগত ১২তম বাজেট পেশ এটি। আগামী অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের মাধ্যমে একাধারে ১০ বার বাজেট দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছেন তিনি। এর আগে ১৯৮০-এর দশকে এরশাদের শাসনামলেও দুটি বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেটে মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৮.৩ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা সমূহের প্রায় ৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ বিবেচনায় নিলে বাজেটের আকার দাঁড়াবে প্রায় ৪ লাখ ৭২ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা (জিডিপির ১৮.৬ শতাংশ)। অনুন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা (জিডিপি’র ১১.৫ শতাংশ) এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা।

বাজেট উপস্থাপনের পরের দিন অর্থাৎ ৮ জুন বিকেল আড়াইটায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

এর আগে ২০১৭ সালের ১ জুন ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছিল।

একনজরে ২০১৮-০৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আয় ও ব্যয়


রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা :
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এতে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।

রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) উৎস হতে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা (জিডিপির ১১ দশমিক ৭ শতাংশ) সংগ্রহ করা হবে।

এনবিআর বহির্ভূত সূত্র হতে কর রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা (জিডিপির ০.৪ শতাংশ)। এ ছাড়া, কর-বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরিত হবে ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা (জিডিপির ১.৩ শতাংশ)।

পাশাপাশি আসছে অর্থ বছরে জিডিপিতে ৭.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার।

ঘাটতি ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা :
বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪.৯ শতাংশ। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ৫৪ হাজার ৬৭ কোটি টাকা (জিডিপির ২.১ শতাংশ) এবং অভ্যন্তরীণ সূত্র হতে ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা (জিডিপির ২.৮ শতাংশ) সংগ্রহ করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা হতে সংগৃহীত হবে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা (জিডিপির ১.৭ শতাংশ) এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থকে আসবে ২৯ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা (জিডিপির ১.২ শতাংশ)।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বৈদেশিক সহায়তার যে বিশাল পাইপলাইন গড়ে তোলা হয়েছে, তার ব্যবহার বাড়াতে পারলে অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপর নির্ভরশীলতা যথেষ্ঠ কমানো সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস এবং সে প্রচেষ্টা আমরা চালিয়ে যাব, যাতে ক্রমাগত বৈদেশিক সহায়তা ববহারের হার বৃদ্ধি পেতে পারে।’

জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭.৮ শতাংশ :
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘চলতি বছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলাম ৭.৪ শতাংশ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ৭.৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ করেছে। মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প সূচক জানুয়ারি ২০১৭-এর তুলনায় জানুয়ারি ২০১৮ সময়ে প্রায় ১৪.০ শতাংশ বেড়েছে। বন্যার কারণে অর্থবছরের প্রথম দিকে কৃষিখাতে উৎপাদন ব্যাহত হলেও ভর্তুকি, কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও অন্যান্য সহায়ক কার্যক্রমের প্রভাবে আমন ও বোরোর উৎপাদন সন্তোষজনক হয়েছে। সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরে ৪০৭ লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত ভোগ ও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা শক্তিশালী হয়েছে যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রবৃদ্ধির ওপর।’

করমুক্ত আয় সীমা অপরিবর্তিত :
বাজেটে করমুক্ত আয়ের সাধারণ সীমা ও করহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘করমুক্ত আয়ের সীমা কি হবে তা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি যে উন্নত দেশগুলোতে করমুক্ত আয়সীমা সাধারণভাবে মাথাপিছু আয়ের ২৫ শতাংশের নীচে থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে করমুক্ত আয়সীমা সাধারণত মাথাপিছু আয়ের সমান বা তার কম থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে করমুক্ত আয়ের সীমা মাথাপিছু আয়ের প্রায় দ্বিগুণের মতো। আমাদের করমুক্ত আয়ের সীমা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের তুলনায় অনেক বেশি। করমুক্ত আয়ের সীমা বেশি হলে কর প্রদানে সক্ষম বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি করজালের বাইরে থেকে যান। এতে করের ভিত্তি দুর্বল থাকে।’

বর্তমানে করমুক্ত আয়ের সীমা সাধারণ করদাতার জন্য ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, নারী ও ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের করদাতা ৩ লাখ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি করদাতা ৪ লাখ ও গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতা ৪ লাখ ২৫ হাজার।

দাম বাড়বে যেসব ক্ষেত্রে :
যেসব পণ্যের দাম বাড়বে, সেসবের মধ্যে রয়েছে–এনার্জি ড্রিংক, প্রসাধন সামগ্রী, সানস্ক্রিন সানগ্লাস, আফটার শেভ লোশন, সিগারেট, সিরামিক বাথটাব, ফিলামেন ল্যাম্প, পলিথিন, ১ হাজার থেকে ১৬০০ স্কয়ার ফিট ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন ফি বাড়বে, লিপস্টিক, পুরনো ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ফি, আমদানি মোবাইল ফোন, বিদেশি চকোলেট, কফি, গ্রিন টি, আমদানি করা বাদাম, আমদানি মধু, ইউপিএস, আইপিএস, স্টাবিলাইজার, ছাপাখানার পণ্য, প্লাস্টিক ব্যাগ, মোবাইল ব্যাটারি চার্জার, নেলপলিশ, অ্যালকোহল বিক্রয়কারী হোটেল রেস্তরাঁয় সেবার মান, হেলিকপ্টার সেবা, বিড়ি, জর্দা, গুল, সোস্যাল মিডিয়া ও অনলাইন লাইন কেনাকাটা।

দাম কমবে যেসব ক্ষেত্রে :
যেসব পণ্যের দাম কমবে, তার মধ্যে রয়েছে–কৃষিজমির রেজিস্ট্রেশন ফি, রড, সিমেন্ট, হাইব্রিড মোটরকার, ক্যানসারের ওষুধ, টায়ার-টিউব তৈরির কাচামাল, কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ, ডে কেয়ার হোম সার্ভিস, দেশি মোটর সাইকেল, আমদানি পল্ট্রি খাদ্য, দেশীয় রেফ্রিজারেটরের কম্প্রেসার, গুঁড়ো দুধ, পাউরুটি।

নারীদের জন্য বরাদ্দ বাড়ছে :
প্রস্তাবিত বাজেটে নারী উন্নয়নে এক লাখ ৩৭ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখতে প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

নারী উন্নয়নে বাজেটের ২৯.৬৫ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। এ হার জিডিপির ৫.৩৪ শতাংশ।

মন্ত্রী বলেন, ‘গত ৯ বছরে জাতীয় বাজেটে নারীদের জন্য বরাদ্দ পাঁচগুণ বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার ২৪৮ টাকা। গত অর্থবছরে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১২ হাজার ১৯ কোটি টাকা। এ হার ছিল মূল বাজেটের ২৭.৯৯ শতাংশ।’

গত সাত বছরে বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ২২ শতাংশ এবং মোট বাজেটের তুলনায় নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বরাদ্দ ছিল প্রায় ২৩ শতাংশ।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে নারী শিক্ষার প্রচার ও প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া অবহেলিত এবং শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী নারী এবং দরিদ্র কর্মী মায়েদের সামাজিক নিরাপত্তার অধীনে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা হয়েছে।’

 এলএবাংলাটাইমস/এন/এলআরটি