কলাম

চাল নিয়ে চালাকি হচ্ছে; চালবাজি হচ্ছে?

কৃষকের ঘরে ধান উঠেছে। অথচবেড়েই চলেছে চালের দাম।চালের দাম কবে কমবে? নাকি তেল চিনির মতো দাম বেড়েছেতো বেড়েছেই। আসলেচাল নিয়ে চালাকি হচ্ছে; চালবাজি হচ্ছে? তা স্পষ্ট! বাজারে চালের দাম বাড়লেও, সরকার বলছে সংকট নেই। চাল উৎপাদন এবং রেকর্ড উদ্বৃত্তের আশা অথচ বাজারে দাম বাড়ছে, হচ্ছে আমদানিও। আমদানির পরও কমছে না চালের দাম। ঘটনাটা কী?
প্রশ্ন সামনে আসেই। চালের বাজার কি ফের পড়ল সিন্ডিকেটের খপ্পরে? চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিলগুলো দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় প্রভাব পড়েছে বাজারে। আর মিল মালিকরা বলছেন, ধানের সরবরাহ কম। আর সরকার অব্যাহতভাবে চাল বাড়তি দাম নিয়ে একটি বিব্রতকর অবস্থা অনুভব করছে। ব্যবসায়ী এবং সরকারদলীয় সিন্ডিকেট বরাবরই অন্যান্য পণ্যেও সাথে চালের বাজারও উদ্ধমূখী করে রাখে। সরকার চায় জনগণকে সস্তায় চাল খাওয়াতে, কিন্তু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারনে তা কুলিয়ে উঠতে পারে না। সরকার এ ব্যাপারে হার্ডলাইনে না গেলে কুলিয়ে উঠতে পারবেও না। জনগনও আর সস্তায় চাল পাবে না। জনগনকে একটু স্বাভাবীক মূল্যে চাল দিতে চাইলে সরকারকে ঢিলেঢালা  ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করলে হবে না মোটেও। এ ব্যাপারে সরকার সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অনেক বেশি কঠোর এবং আন্তরিক হতে হবে। ব্যবসায়ীক লুটেরারা চালের দাম বাড়িয়ে অর্থের পাহাড় গড়লেও গরীবের চাল কিনতে নাভিশ^স উঠেছে। এ নিয়ে সরকার সমালোচিতও হচ্ছে বেশ। সরকার নিজেও জানে এবং আমরা যারা ভোক্তা তারাও জানি চালের দাম আর আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব না তবে কিছুটা সহনীয় করা যায় বৈকি! এর জন্য সরকারকে অনেব বেশি কঠোর হতে হবে।
পত্রিকান্তে জানা গেছে, ১৫ দিনের ব্যবধানে বাজারে সব ধরনের সরু চালের দাম বস্তায় সর্বোচ্চ ৩শ’ থেকে সাওে ৩শ’ টাকা বেড়েছে। মোটা চাল বেড়েছে বস্তা প্রতি আড়াইশ থেকে ৩ শ’। ভায়টা এখানেই যে চালের দাম বৃদ্ধি অব্যহতরয়েছে। সরকারের তাবদ হুঙ্কার কোন কাজেই আসছে না। কেবল মুখে মুখে নয়, চালের বাজার কারসাজিতে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এখনই। মনে রাখতে হবে, এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চালের দাম যেকোনো মূল্যে নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। পত্রিকার খবরে আরও জানতে পারি, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে জিরাশাইল সিদ্ধ বস্তায় ৩০০ টাকা বেড়ে গিয়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৪০০ টাকায়। এছাড়া মিনিকেট সিদ্ধ ২০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৬০০ টাকা, পাইজাম সিদ্ধ বস্তায় ৩০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৫৫০ টাকা, কাটারিভোগ সিদ্ধ ২০০ টাকা বেড়ে গিয়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা, কাটারিভোগ আতপ বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়ে গিয়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৭০০ টাকা, মিনিকেট আতপ ১৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৬৫০ টাকা, পাইজাম ২০০ টাকাবেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ টাকা, স্বর্ণা সিদ্ধ ২৫০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৪০০ টাকা, নাজিরশাইল সিদ্ধ ২০০ টাকা বেড়ে ৩ হাজার ৬৫০ টাকা এবং মোটা সিদ্ধ চাল২ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকায়।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির বক্তব্য এমন, দেশে চালের অভাব নেই, যা প্রয়োজন সে পরিমাণ চাল বাজারে আছে। চালের বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এটা যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে।ফল কিন্তু শূন্য। তেলে, চিনির দাম বেড়েছে; কমেনি আর। বরাবরই সকল পণ্যে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা রাতারাতি দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা তা দেখছি। চাল, তেল, পিয়াজ সব কিছুর দামই নিয়ন্ত্রণের বাইওে চলে যায়। এটা হচ্ছেতো হচ্ছেই। সরকার কিছু করতে পারছে না কেন। এটও প্রশ্ন এ যাবত কয়জন াসিন্ডিকেট ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে? দৃশ্যমান কোন ফল আমরা পাইনি। বরাবরই অসৎ ব্যবসায়ীরা ধরাছোয়ার বাইওে থাকে যা অত্য›ত দু:ক্ষজনক এবং তা মোটেও কারো কাম্য নয়।
সচরাচরই একটা কথা আমরা শুনি তা হলো- দেশে নাকি চালের উৎপাদন বেড়েছে;জনগনের চাহিদা পূরণ করার পর উদ্বৃত্ত থাকছে চাল এমন তথ্য সরকার দফতর থেকে আমরা পাই। এর পরও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না কিছুতেই। কেন?দেশে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার শুল্ক কর ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করলেও ফল মিলেনি তাতে। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা শুল্ক কর ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন। চালের শুল্ক  কমানো হলেও কি চালের দাম আদৌ কমবে? তবে কিছুটা আশার আলো মিলছে, প্রধানমন্ত্রী চালের দাম নিয়ন্ত্রণে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ব্যবসায়ীরা কারসাজি করছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষ করে করপোরেট ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা চালের কারবারে নেমেছেন তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলা হয়েছে।তাই ধান-চাল সংক্রান্ত অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে সাঁড়াশি অভিযানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বড় শিল্পগোষ্ঠীর যারা চালের ব্যবসায় নেমেছে, তারা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে কিভাবে বাজার উত্তপ্ত করছে তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। তাদের এ সংক্রান্ত ব্যবসার অনুমোদন আছে কিনা খতিয়ে দেখতে হবে। মূল্য স্বাভাবিক রাখতে অতিদ্রুত তেলের মতো চালের বাজারেও বিশেষ অভিযান চালানোর জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এসব নির্দেশ যথাযথ কার্যকর হলে সুফল মিলতে পারে। এও সত্য ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী একটি অস্থির অবস্থা চলছে। যারা কারনে সারা বিশে^ই পণ্যের দাম বাড়ছে।তবে বাংলাদেশে যেভাবে বাড়ে ততটা বাড়েনা কোথাও।
চালের বাজার কেন বেসামাল তা খতিয়ে দেখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য, বাণিজ্য ও কৃষি- এই তিন মন্ত্রণালয়কে তিনি এ নির্দেশনা দেন। তার আলোকেই গ এই তিন মন্ত্রণালয় গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। পত্রিকার জানা গেছে, খাদ্য মন্ত্রণালয় আটটি টিম করে দিয়েছে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের টিমও চালের বাজারে অভিযানে নেমেছে। কিন্তু তাদের অভিযান ছিল রাজধানী ঢাকার পাইকারি ও খুচরা চালের বাজারে। যেখান থেকে অভিযান শুরু করার কথা- সেই মিল পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করা মানে গোড়াতেই গলদ। কারণ চালের বাজারের মূল সিন্ডিকেট বা কারসাজি হয় মিল পর্যায়ে এবং মাঠ পর্যায়ে ধানের বাজারে। গোড়ায় হাত না দিলে চালের বাজারের মূল সমস্যার কোনো সমাধান হবে না বা সঙ্কট কাটবে না বলেও মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আগেই আভাস দিয়েছিল যে, এ বছরের শেষে প্রায় সাড়ে ৫৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে, অথচ বাজারে সব ধরনের চালের দামই বেড়ে যাছে কেন? ধান বা চালেরতো কোনো সংকট নেই!যদিও প্রত্যাশার চেয়ে উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে এ বছর। তারপরেও সেটি খুব একটা বেশি নয়, বলেই কোনো সংকট তৈরি হয়নি। তাহলে বাজারে চালের দাম বাড়ছে কেন? এবারও হয়তো চাল সিন্ডিকেট আকামটা করল! চালের দামের ঊর্ধ্বগতিতে ভয়াবহ সংকটে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে, গত এক বছরে শুধু মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ৪৮ শতাংশ। বাজারে বেসরকারি হিসাবে মোটা চালের দাম বেড়েছে এক বছরে কেজিপ্রতি কমপক্ষে ১৫ টাকা, তিন মাসে বেড়েছে ৮ টাকা।
এক তথ্যে জানা যায়, দেশে দৈনিক চাল সরবরাহের প্রয়োজন ৯৪ হাজার মেট্রিক টন। আর সরবরাহ আছে ৮০ হাজার মেট্রিক টনের মতো। চালের দাম কমানোর ব্যাপারে সরকার সচেষ্ট। সরকারের কঠোর পদক্ষেপেও বাজারে চালের দাম কমেনি বরং আরও বেড়েছে। সরকারি কোনো পদক্ষেপেই সিন্ডিকেটমুক্ত হতে পারছে না চালের বাজার। এ অবস্থায় চালের অসাধু ব্যবসায়ী, মজুতদার ও সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মূল্য নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত সাতটি মনিটরিং মাঠে রয়েছে। এর পরও সিন্ডিকেট মিল মালিকদের কারসাজি বন্ধ হয়নি। দাম বাড়ার কোনো কারণ না থাকলেও অস্থির হয়ে উঠছে চালের বাজার। এদিকে আমদানির প্রভাব নেই চালের বাজারে। দেশের বাজারে আমদানিকৃত চালের বিক্রি শুরু হলেও তার প্রভাব মিলছে না বাজার দরে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আড়তগুলোতে চালের দাম না কমে বরং প্রতি বস্তায় ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা বেড়েছে। আমদানি করা এসব চালের মান ভালো না হওয়ায় আড়তদাররা এই সুযোগ নিচ্ছে বলে জানায় চালের খুচরা বিক্রেতারা। ফলে এখনো চড়াই রয়েছে চালের বাজার। কয়েক দফা শুল্ক কমিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কয়েক লাখ টন চাল আমদানি করা হলেও বাজারে এর তেমন কোনোই প্রভাব নেই। এর ফলে অসাধু চাল ব্যবসায়ীরাই লাভবান হয়েছেন কিংবা হচ্ছেন।
 বিশ্ব বাজারে চালের দাম তেমন বাড়েনি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চালের পর্যাপ্ত মজুত আছে। বিপুল পরিমাণ চাল সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আমদানি করা হয়েছে। আরও আমদানি করা হচ্ছে। তাহলে চালের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না কেন? চালের দাম কমানোর জন্য সরকারের নানা রকম উদ্যোগ আমরা লক্ষ্য করেছি। কিন্তু তাতেও খুচরা বাজারে চালের দাম না কমে উল্টো অনেক বেড়েছে। চাল নিয়ে চাল সিন্ডিকেটদেও এই অনৈতিক কারসাজিকে হালকাভাবে নেয়ার অবকাশ নেই। স্বেচ্ছাচারী কিংবা অসাধু ব্যবসায়ীরা যা করছে তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। চালের দাম আরও বাড়তে পারে, এমন গুজবও ছড়িয়ে দেয়া হয়। এতে চালের দাম বাড়তে থাকে। যারা চাল নিয়ে চালবাজি করছে সরকার তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? অনেকটা রহস্যজনকভাবে চালের দাম বেড়েছে। ভাবা কি যায় ২৫ টাকার চাল লাফাতে লাফাতে কোথায় উঠেছে?
এভাবে চালের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই। প্রশ্ন হলো এখানে কারা চাল নিয়ে খেলছে? যারা খেলাটা খেলেছে তাদের চিহ্নিত করে নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন? আমাদের দেশের মানুষের দুর্ভাগ্য যে, সব সময় কিছু অসাধু মানুষ গরিব মানুষকে নিয়ে খেলে। এ খেলা আগে বন্ধ করতে হবে। চাল নিয়ে এই অনৈতিক কারসাজিকে ক্ষুদ্রভাবে নেয়ার অবকাশ নেই। তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। এভাবে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। সরকারের তরফ থেকে চালের দাম বৃদ্ধির খবরকে অস্বীকার করা হয়নি। তবে দায়টা কার তা স্পষ্ট করা দরকার। আসলে এ দেশে ভোক্তা স্বার্থ বলে কিছু নেই। যদি থাকতো তাহলে চালের বাজারে এমন অরাজক তৈরি হতো না।
এ দেশে চালের দাম বাড়ে, ডালের দাম বাড়ে, বেগুন, তেল, লবণ, চিনির দাম বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। কারণে বাড়ে, আকারণে বাড়ে। আমরা মনে করি, চালের বাজার এবং চালবাজদের ব্যাপারে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। বিত্তহীনদের স্বার্থে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চালের দাম কমিয়ে আনার দিকে নজর দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অতি মুনাফাখোর অতিলোভী ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।কেবল মুখে মুখে নয়, চালের বাজার কারসাজিতে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।