আন্তর্জাতিক

মসজিদে নৃশংসতার ১০ মিনিট আগে প্রধানমন্ত্রীকে মেইল করেন ব্রেনটন

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে নৃশংসতার ঘটনায় গোটা বিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠেছে। একইসঙ্গে শোক প্রকাশ করছেন সবাই।

গতকাল শুক্রবার জুমার নামাযরতদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় অস্ট্রেলীয় বংশোদ্ভূত উগ্রপন্থী ব্রেনটন টারান্ট। এতে দুই বাংলাদেশিসহ ৪৯ জন মুসলিম নিহত ও ৪৮ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে বেশিরভাগেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক।

অল্পের জন্য এই হামলা থেকে বেঁচে যায় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা। তারাও সেখানে জুমার নামায পড়তে গিয়েছিলেন। তবে, মসজিদে প্রবেশের আগেই গুলির ঘটনা নিয়ে এক নারী সতর্ক করলে তারা দৌড়ে প্রাণে রক্ষা পান।

এই হামলার ঘটনায় নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্দা আর্ডার্নের কার্যালয় নিশ্চিত করেছে, ক্রাইস্টচার্চের মসজিদ আল-নূরে হামলার ১০ মিনিট আগে বন্দুকধারী ব্রেনটন টারান্ট তার উদ্দেশ্য একটি ‘ইশতেহার’র মাধ্যমে ই-মেইল করেন।

শুধু প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় নয়, আরও ৭০ জনের কাছে এটি পাঠান ব্রেনটন। এদের মধ্যে বিরোধী প্রধান রাজনীতিক সিমন ব্রিজ, সংসদের স্পিকার ট্রেভর মালার্ডও রয়েছেন বলে খবর দিয়েছে নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড।

প্রধানমন্ত্রী জাসিন্দা আর্ডার্নের মুখপাত্র জানিয়েছেন, রাজনীতিকদের বাইরে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমের কর্তা ব্যক্তিদের একই মেইল পাঠানো হয়েছে। তবে, নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড এই তালিকায় নেয়।

প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র বলেন, ‘ইশতেহারটি এমনভাবে সাজানো ছিল যে, হামলাটি ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। এতে কেন হামলা করছেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন ব্রেনটন। কিন্তু, কোথাও তিনি এটা বলেননি, আমি অমুক স্থানে হামলা চালাতে যাচ্ছি। ফলে জানার পরও এই হামলা থামানোর মতো কোনো সুযোগ ছিল না।’

ই-মেইলটি পাঠানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ই-মেইল ঠিকানায়, আর্ডার্নের ব্যক্তিগত ঠিকানায় নয়। যিনি প্রধানমন্ত্রীর ই-মেইল দেখাশোনা করেন, তিনি এ বিষয়ে নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পার্লামেন্ট নিরাপত্তাবাহিনীকে অবগত করেন। পরে তারা বিষয়টি পুলিশকে জানায়।

ভয়াবহ এই হামলার ঘটনায় ব্রেনটনসহ চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। হামলার ঘটনা সরাসরি সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করেন তিনি। পাশাপাশি অনলাইনে প্রকাশ করেন হামলার উদ্দেশ্য নিয়ে ৭৪ পৃষ্ঠার একটি তথাকথিত ইশতেহার, যেখানে তার সহিংস কট্টর দক্ষিণপন্থী মতাদর্শ তুলে ধরেন।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের ভাষায়, ব্রেনটন টারান্ট আসলে একজন ‘উগ্র দক্ষিণপন্থী সন্ত্রাসবাদী’।

হামলার ঘটনার যে ১৭ মিনিটের ভিডিও এবং তার আগে যে সুদীর্ঘ ইশতেহার টারান্ট প্রকাশ করেছে, তা থেকে তার চিন্তা ও মতাদর্শ সম্পর্কে কী ধারণা পাওয়া যায়?

বিবিসি বলছে, ব্রেন্টন টারান্ট যখন অস্ত্র বোঝাই গাড়ি নিয়ে আল-নূর মসজিদের দিকে যাচ্ছে, তখন তার গাড়িতে যে গানটি বাজছিল, সেটি একটি সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদী রণসঙ্গীত। ‘চেটনিকস’ নামে পরিচিত সার্বিয়ান প্যারামিলিটারি ইউনিট ১৯৯২-৯৫ সালের বসনিয়ান যুদ্ধের সময় এটিকে তাদের কুচকাওয়াজ সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহার করতো।

এই সঙ্গীতে বসনিয়ান সার্ব নেতা রাদোভান কারাদযিচের প্রশংসা রয়েছে। গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রাদোভান কারাদযিচ দোষী সাব্যস্ত হন। মুসলিম ও অভিবাসীদের হত্যার কারণে যেসব লোকের সাজা হয়েছে, তাদের অনেকের নাম লেখা আছে ব্রেনটন টারান্টের আগ্নেয়াস্ত্রগুলিতে।

একটি বন্দুকের গায়ে লেখা ‘ফর রদারহ্যাম’। যুক্তরাজ্যের রদারহ্যামে শিশুদের ওপর এশিয়ান মুসলিম পুরুষদের যৌন নিপীড়নের যে কেলেঙ্কারির ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল, সেই ঘটনাকেই এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া অটোম্যান সাম্রাজ্যের সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোর ঐতিহাসিক অনেক লড়াইয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বিভিন্ন শব্দ লেখা ছিল তার অস্ত্রশস্ত্রে।

অস্ট্রেলিয়ান গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ব্রেনটন টারান্ট সিডনি থেকে প্রায় ৬শ’ কিলোমিটার উত্তরের একটি শহর গ্রাফটনের লোক। তার সাবেক বস ট্রেসি গ্রে দাবি করছেন, ব্রেনটনের মধ্যে তিনি কখনো কোনো চরমপন্থী চিন্তা-ভাবনা বা পাগলামি আচরণ দেখেননি।

তবে, দীর্ঘ ইশতেহারে টারান্ট লিখেছে, ২০১৭ সালে ইউরোপ ঘুরে আসার পর সে এই হামলার পরিকল্পনা শুরু করে। বিশেষ করে, সে উল্লেখ করেছে সুইডেনে একটি লরি চালিয়ে ইসলামিক স্টেটের সমর্থক এক ব্যক্তির চালানো এক হামলার কথা। এ ছাড়া আছে ফ্রান্সে ইমানুয়েল ম্যাক্রর মতো লোকের প্রেসিডেন্ট হওয়া এবং ফ্রান্সে যে জাতিগত বৈচিত্র, তা নিয়ে ক্ষোভ-হতাশার কথা।

এতে যে ধরনের ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ তুলে ধরা হয়েছে, তা সাম্প্রতিককালে অনলাইনে দ্রুত প্রসার লাভ করছে। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীদের একটি ব্যাপক আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীও তৈরি হচ্ছে।

এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মূল কথা হলো- ইউরোপীয়রা ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তাদের তুলনায় নিকৃষ্ট এবং বিপজ্জনক জাতি ও সংস্কৃতির দাপটে। মূলত মুসলিমদের নিয়ে ঘৃণা এবং ভীতি ছড়ানোর সাংকেতিক আলোচনা বলে মনে করা হয় এসব আলোচনাকে।

এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে আরও বলা হচ্ছে, পশ্চিমা দুনিয়ায় যে অভিবাসীদের আসার হার বেড়েই চলেছে, এর পেছনেও রয়েছে ষড়যন্ত্র। বিশ্ব পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখতে বড় বড় রাষ্ট্র এবং করপোরেশনগুলো ‘হোয়াইট জেনোসাইড’ বা ‘শ্বেতাঙ্গ গণহত্যায়’ উৎসাহ যোগানোর নীতি নিয়েছে। এই ইশতেহারে এন্টি সেমিটিক (ইহুদি বিদ্বেষী) এবং নব্য নাৎসীবাদী কথাবার্তাও আছে।

পশ্চিমা দুনিয়ায় যে উগ্র ডানপন্থী শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটছে, তার পেছনে এ ধরনের ‘ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্বের’ বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। নানা ধরনের গোপন গোষ্ঠী ফেসবুকে এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব প্রচারণা চালাচ্ছে জোরে-শোরে।