ফুকুশিমার দাই-ইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘দূষণমুক্ত’ পানি সমুদ্রে ফেলা শুরু করেছে জাপান। স্থানীয় সময় বুধবার (২৪ আগস্ট) দুপুর থেকে পানি সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া শুরু হয়। তবে চীনসহ জাপানের প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের অভিযোগ, জাপানের এই পদক্ষেপ এ অঞ্চলের সামুদ্রিক পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। পাশাপাশি মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়েও দেখা দিতে পারে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালক প্রতিষ্ঠান টোকিও বিদ্যুৎ–শক্তি কোম্পানির (টেপকো) কর্মকর্তারা বলেছেন, পানি ছাড়ার প্রক্রিয়া শুরু করার আগে বুধবার একটি পরীক্ষা চালানো হয়। এতে দেখা গেছে, পানিতে ট্রিটিয়ামের উপস্থিতি ছিল প্রতি লিটারে ১৫০০ ব্যাকেরেলের চেয়ে কম। এই মাত্রার নিরাপত্তার পরিমাপকে গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। আগামী ১৭ দিনে টেপকো প্রায় ৭ হাজার ৮০০ টন বিশুদ্ধ করে নেওয়া পানি সমুদ্রে ছাড়বে। পর্যায়ক্রমে সেই কাজ চালিয়ে যাওয়া হবে।
২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা দাই-ইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটে। এর ভিন্ন একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গলে যাওয়া জ্বালানি শীতলীকরণে ব্যবহৃত পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চত্বরে জমা হতে থাকে। পানির পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকায় এই সমস্যা ভিন্ন মাত্রা নেয়। দ্রুত সমাধান খুঁজে পেতে উদ্যোগী হতে সরকারের পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালক কোম্পানি বাধ্য হয়।
তেজস্ক্রিয়তায় দূষিত সেই পানির চূড়ান্ত ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা যায়, সেই উপায় খুঁজে দেখছিলেন দেশের বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্বও। সহজ সমাধান হিসেবে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া কিংবা মাটির গভীরে বিশেষ আধারে জমা করে রাখার মতো বিকল্প পরিকল্পনাও করা হয়ছিল। কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করে কোন পথ অবলম্বন করা উচিত, তা নিয়ে অনেক দিন ধরে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি জাপান।
জাপানের বিজ্ঞানীরা শেষ পর্যন্ত পানি বিশুদ্ধ করে তেজস্ক্রিয়তা মুক্ত করে নেওয়ার পর সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ও ফুকুশিমার মৎস্যশিল্পের কঠোর বিরোধিতার মুখে সিদ্ধান্ত কার্যকর করা থেকে জাপানকে বিরত থাকতে হয়। বিশুদ্ধ করে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ তেজস্ক্রিয় উপাদান সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও ক্ষতিকর ট্রিটিয়াম কিছু পরিমাণে হলেও পানিতে থেকে যায়। পানিতে থেকে যাওয়া ট্রিটিয়াম ঠিক কতটা ক্ষতিকর, তা নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। জাপান বলছে, বিশুদ্ধ করে নেওয়ার পর থেকে যাওয়া ট্রিটিয়াম হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পানযোগ্য পানিতে এর যে পরিমাণ উপস্থিতি অনুমোদনযোগ্য বলে সুপারিশ করা হয়েছে, তার চেয়ে কম। তবে জাপানের প্রতিবেশীদের অনেকেই জাপানের সেই যুক্তি মেনে নিতে রাজি হয়নি।
জাপান সরকার শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) শরণাপন্ন হয়। পরে সংস্থাটি জাপানে একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠায়। নানা রকম পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে দলটি জানায়, বিশুদ্ধ করে নেওয়া পানি সমুদ্রে ফেলা হলে মানবজীবন ও সমুদ্র পরিস্থিতির ওপর কোনো রকম হুমকি হয়ে তা দেখা দেবে না। আইএইএর বিশেষজ্ঞ মতামতের সঙ্গে সংগতি রেখে জাপান সরকার শেষ পর্যন্ত পানি সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের চত্বরে রাখা বড় বড় আধারে জমা হওয়া পানি সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়ার কাজ শেষ করতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে। শীতল করে নেওয়ায় ব্যবহৃত পানির সঙ্গে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সময়ে বৃষ্টির পানি ও ভূগর্ভের পানি যুক্ত হওয়ায় পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্র চত্বরে ১৩ লাখ ২৪ হাজার টন পানি মজুত রাখা আছে। সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার আগে এই পানির সঙ্গে সমুদ্রের পানি মিশিয়ে নিয়ে এটাকে আরও তরল করে নেওয়া হবে। তাই সমুদ্রে ফেলা পানির মোট পরিমাণ হবে এর চেয়ে অনেক বেশি।
জাপানের এই পদক্ষেপের কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে চীন। চীন সরকারের পক্ষ থেকে জাপানের এই পদক্ষেপকে স্বার্থপরমূলক ও কাণ্ডজ্ঞানহীন আখ্যায়িত করা হয়েছে। তারা বলেছে, জাপানের সমুদ্র ও অন্যান্য খাদ্য আমদানির ওপর আরোপিত নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করে নিতে চীনকে এটা বাধ্য করবে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার সরাসরি এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা না করলেও পক্ষেও কোনো কথা বলেনি। দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষমতাসীন দক্ষিণপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে জাপান সরকারের সম্পর্ক ভালো। তাই সিউলকে সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে হচ্ছে।
অপর দিকে, জাপানের ভেতরে অনেকেই বিষয়টি নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন না হলেও ফুকুশিমা জেলার মৎস্য শিল্প খাত এর বিরোধী। আন্তর্জাতিক বাজারে স্থানীয় পণ্যের সুনামহানির আশঙ্কা থেকে স্থানীয় মৎস্যজীবীরা এর বিরোধিতা করছেন। তাঁরা বলছেন, সমুদ্রে পানি ছেড়ে দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত বিদেশে তাঁদের পণ্য রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস