আন্তর্জাতিক

দক্ষিণ কোরিয়ান নারীদের সন্তান ধারণে আগ্রহ নেই

ইয়েজিন নিজের অ্যাপার্টমেন্টে বন্ধুদের জন্য দুপুরের খাবার রান্না করছিলেন। রাজধানী সিউলের উপকণ্ঠের বাড়িটিতে একাই থাকেন ‘সুখি’ মানুষটি।   খাওয়ার সময় তাদের মধ্যে একজন তার ফোনে একটি কার্টুন ডাইনোসরের মিম দেখাচ্ছেন। মিমটিতে লেখা, সাবধান, নিজেদের আমাদের মত বিলুপ্ত হতে দিও না। এটি দেখে উপস্থিত নারীরা হেসে উঠেন। ইয়েজিন (৩০) একজন টেলিভিশন প্রযোজক৷ তিনি বেলেন, ‘এটা মজার, কিন্তু অন্ধকারও। কারণ আমরা জানি, আমরাই আমাদের বিলুপ্তির কারণ হতে পারি।’ সে বা তার বন্ধুদের কারও সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা নেই। তারা এমন একটি ক্রমবর্ধমান নারী কমিউনিটির অংশ যারা সন্তান নিতে চান না। দক্ষিণ কোরিয়ার জন্মের হার বিশ্বের সর্বনিম্ন। প্রতি বছর এই হার কেবলই কমতে থাকে। বুধবার প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালে দেশটির জন্মহার আরও ৮ শতাংশ কমে ০.৭২ শতাংশে নেমে এসেছে। একজন নারী তার জীবনে কতজন সন্তান নিতে চান, জন্মহার সেই বিষয়টি নির্দেশ করে। কোনো দেশের জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে এ হার ২.১ থাকা উচিৎ। দক্ষিণ কোরিয়াতে এখন নারীদের মধ্যে সন্তান না নেওয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা চলতে থাকলে দেশটির জনসংখ্যা ২১০০ সালের মধ্যে অর্ধেকে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ বিশ্বব্যাপী, উন্নত দেশগুলোতে জন্মহার কমছে। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো চরম পরিস্থিতি কোনো দেশেই নেই। দেশটির ভবিষ্যৎ মারাত্মক বলে অনুমান করা হচ্ছে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে, দেশের বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবায় অংশ নেওয়ার যোগ্য ৫৮ শতাংশ কমে যাবে এবং প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার বয়স ৬৫ বছরের বেশি হবে। এটি দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি, পেনশনগ্রহীতা ও দেশের নিরাপত্তা নিয়ে এতটাই খারাপ পূর্বাভাস দেয় যে, রাজনীতিবিদেরা এ অবস্থাকে ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ বলে ঘোষণা করেছেন। জন্মহার বাড়াতে এশিয়ার দেশগুলো রয়েছে নানা রকমের প্রণোদনা। যে দম্পতিদের সন্তান রয়েছে তাদের নগদ অর্থ প্রদান করা হয়, মাসিক আবাসন ও বিনামূল্যে ট্যাক্সি, হাসপাতালের বিল এমনকী চিকিৎসা সেবাও দেওয়া হয় শুধু বিবাহিতদের জন্য। কিন্তু এই ধরনের আর্থিক প্রণোদনা কাজ করেনি। রাজনীতিবিদদের আরও ‘সৃজনশীল’ সমাধান খোঁজার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ইয়েজিন যখন ২০ বছর বয়সের দিকে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন তিনি সামাজিক রীতিনীতিকে পাশ কাটিয়ে গেছেন। দক্ষিণ কোরিয়াতে একক জীবনযাপনকে মূলত একজনের জীবনের একটি অস্থায়ী পর্যায় হিসেবে দেখা হয়। তারপর পাঁচ বছর আগে, তিনি বিয়ে না করার ও সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, ‘কোরিয়ায় মনের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। যে গৃহস্থালির কাজ করবে ও সমানভাবে সন্তানের যত্নও নেবে। আর যে নারীদের শুধু সন্তানই আছে (উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত নন) তাদের প্রতি সদয় আচরণ করা হয় না।’ ২০২২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় মাত্র ২ শতাংশ শিশুর জন্ম বিয়ে ছাড়া হয়েছে। ‘চিরস্থায়ী কর্ম চক্রে বাঁধা জীবন’ বিয়েসাদি, সন্তান নেওয়ার পরিবর্তে টেলিভিশনে নিজের ক্যারিয়ার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইয়েজিন। তার মতে, এই পেশায় থাকার পাশাপাশি সন্তান ধারণ ও তাকে লালন পালন করার মতো যথেষ্ট সময় পাওয়া যায় না। কোরিয়াতে কাজের সময় কুখ্যাতভাবে অনেক বেশি। ইয়েজিন তার অফিসে ৯টা–৬টা কাজ করেন। তবে, সাধারণত রাত ৮টার আগে অফিস থেকে বের হতে পারেন না। এর বাইরে আছে অতিরিক্ত সময়ের কাজ। যখন বাড়িতে ফেরেন, তখন ঘর পরিষ্কার ও ঘুমানোর আগে কিছু শরীরচর্চা করার সময় পান। ইয়েজিন বলেন, ‘আমি আমার কাজ ভালোবাসি। এটি আমাকে দারুণ পূর্ণতা দেয়। তবে কোরিয়ায় কাজ করা কঠিন। আপনি কাজের এক বিরতিহীন চক্রে বাঁধা পড়বেন।’ ইয়েজিন আরও বলেন, চাকরিতে আরও ভাল করার জন্য অবসর সময়ে পড়াশোনার চাপ রয়েছে। কোরিয়ানদের এই মানসিকতা রয়েছে যে আপনি যদি ক্রমাগত আত্ম-উন্নতির জন্য কাজ না করেন তবে আপনি পিছিয়ে যাবেন এবং একজন ব্যর্থ মানুষে পরিণত হবেন। এই আমাদের দ্বিগুণ কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।’ ইয়েজিনের সঙ্গে থাকা নারীদেরও একই ভয়। যদি তারা সন্তানের জন্য সময় নেয়, তাহলে হয়তো কাজ করতে পারবে না।

এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস