আন্তর্জাতিক

গাজা যুদ্ধ: বিশ্বকে এখন দুই রাষ্ট্র সমাধানে এগিয়ে যেতেই হবে

ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। এই আন্দোলনকে ইসরায়েলের স্বীকৃতি দেওয়ার সময় হয়েছে। ইসরায়েল দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে হাঁটলে তা হামাসকে পুরস্কৃত করবে এমন নয়, বরং এতে ইসরায়েল নিজেও লাভবান হবে। গত ৭ অক্টোবরের ভয়ংকর ঘটনা পরিষ্কার করেছে, ফিলিস্তিনিদের জন্য সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া ইসরায়েল কখনোই সন্ত্রাসের আতঙ্ক থেকে মুক্ত হতে পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যের সব পক্ষের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে আলাপ-আলোচনা করা এবং কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব প্রতিরোধ ও সমাধানে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে নিশ্চিত করেছে, হতাশা খুব সহজেই ক্রোধে পরিণত হতে পারে এবং তারপর সেটি অবর্ণনীয় আক্রোশে রূপ নিতে পারে। সেই একই অভিজ্ঞতা থেকে আন্দাজ করতে পারি, ন্যায্য এবং মর্যাদাপূর্ণ মীমাংসার আশাবাদ সত্যিকার অর্থে যখন দেখা যায়, তখন সহিংসতার হুমকি দ্রুত কমে যায়।  
৭ অক্টোবরের হামলার মূল কারণ উপলব্ধির অর্থ কখনোই নিরপরাধ মানুষ হত্যাকে ন্যায্যতা দেওয়া নয়। ইসরায়েলকে সর্বশক্তি দিয়ে এ ধরনের হামলা প্রতিরোধ করার অনুমতি ও অধিকার আন্তর্জাতিক আইন দিয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ও তাঁর অন্ধ সমর্থকেরা মূল কারণকে অস্বীকার করে চলেছেন। তাঁরা রাজনৈতিক সমাধানের পথে হাঁটতে অস্বীকার করে যাচ্ছেন। এটি আরও সন্ত্রাসী হামলাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। এটি এখন বিশেষ সত্য হয়ে উঠেছে যে অনেক সাধারণ ও নিরীহ ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ার অসামঞ্জস্যপূর্ণ বর্বরতার কারণে বাস্তুচ্যুত, আঘাতপ্রাপ্ত এবং ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আমি সবখানে সব সময় বলে থাকি, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার নৈতিক, আইনি এবং রাজনৈতিক যুক্তি বরাবরই জোরালো। জাতিসংঘের প্রায় ১৪০টি সদস্যদেশ (যদিও এগুলোর প্রায় সবই বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশ) ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়ার পক্ষে। গাজা যুদ্ধ এখন ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ইস্যুটিকে নতুন প্রাসঙ্গিকতা দিয়েছে। আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক দেশ এখন ইসরায়েলের অস্থিরতাকে কেবল ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাকে চিরস্থায়ী হাতিয়ার হিসেবে দেখছে না; বরং তারা এই বেপরোয়া আচরণকে ইসরায়েলের নিজেদের দুর্দশাকেও চিরস্থায়ী করার ‘গ্যারান্টি’ হিসেবে দেখছে।
বৈশ্বিক আলোচকদের মধ্যে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র গঠন ইস্যুতে দ্বিমত থাকে, তাহলে কোনো শান্তি আলোচনা সফল হবে না। এই মতপার্থক্য দূর করার একমাত্র উপায় হলো বিষয়টি বিশ্ববাসীকে সুস্পষ্টভাবে দেখানো যে শুধু আরব এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র গঠনের দাবির পক্ষে নয়, বরং যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশ্বিক উত্তরের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত সব পশ্চিমা দেশ ফিলিস্তিনের আলাদা রাষ্ট্র গঠনকে সমর্থন করে।
৯ এপ্রিল অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং এক ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে জানিয়েছেন, এর আগে যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, নরওয়ে—এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে যে বিবেচনা করেছিল, সেটিকে বাস্তবভিত্তিক ধরে নিয়ে তাঁর দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি সত্য, যেকোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য টাইমিং বা লাগসই মুহূর্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়ে চলতি মাসেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সাধারণ পরিষদে ভোট হওয়ার কথা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য কয়েকটি দেশ অবশ্য এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ইচ্ছুক না-ও হতে পারে। যাহোক, যাত্রার গন্তব্য পরিষ্কার এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ তৈরি হচ্ছে। অনেকে বলতে পারেন, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার এসব প্রতিশ্রুতি আসলে লোকদেখানো ও ছেলে ভোলানো তৎপরতা। কারণ, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান বেপরোয়া বসতি নির্মাণ কর্মসূচি যে আঞ্চলিক বিভক্তির সৃষ্টি করেছে, তা দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে এখন কার্যত অসম্ভব করে তুলেছে বলে মনে হচ্ছে।
দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বিষয়ে ইসরায়েলের বিরোধিতা এবং নিজস্ব এক রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বিষয়ে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন—উভয়ই দিন দিন বেড়েছে এবং ৭ অক্টোবরের হামলার পর সে অবস্থা আরও দৃঢ় হয়েছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, একটি দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ, এটি আন্তর্জাতিকভাবে অপ্রতিরোধ্যভাবে পছন্দের নীতি হিসেবে এখনো টিকে আছে এবং ইসরায়েলের নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থেই এটি দরকার। বহু বছর ধরে অনেক বিশ্লেষক দাবি করে আসছেন, ইসরায়েল একই সঙ্গে একটি ইহুদি রাষ্ট্র, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং ঐতিহাসিক জুদেয়া ও সামারিয়া অঞ্চলের পুরোটা অধিকার করে রাখা একটি রাষ্ট্র হতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য কোনো রাষ্ট্রের থাকতে পারে না (এটি আমার সাবেক বস অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বব হ্যাওয়াকের মতো)। বরং ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করবে। যদি বৈশ্বিক আলোচকদের মধ্যে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র গঠন ইস্যুতে দ্বিমত থাকে, তাহলে কোনো শান্তি আলোচনা সফল হবে না। এই মতপার্থক্য দূর করার একমাত্র উপায় হলো বিষয়টি বিশ্ববাসীকে সুস্পষ্টভাবে দেখানো যে শুধু আরব এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র গঠনের দাবির পক্ষে নয়, বরং যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশ্বিক উত্তরের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত সব পশ্চিমা দেশ ফিলিস্তিনের আলাদা রাষ্ট্র গঠনকে সমর্থন করে। এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস