বাংলাদেশ

আবার 'না' ভোট চালুর পক্ষে ইসির কর্মকর্তারা

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইন
প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যার
সম্মুখীন হয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
উপজেলা এবং তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে
অনিয়মের নতুন মাত্রাও দেখা গেছে।
আগামী নির্বাচনে এসব বিষয়ের পুনরাবৃত্তি বন্ধ
করতে বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশকে
(আরপিও) যুগোপযোগী করার কথা ভাবছে
কমিশন। এ বিষয়ে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন
কর্মকর্তাদের মতামত নেওয়া হয়েছে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের জন্য মাঠ
কর্মকর্তাদের অভিমতে 'না' ভোটের বিধান
চালু করাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব উঠে এসেছে।
আরপিও যুগোপযোগী করার জন্য মতামত
চেয়ে গত ১১ জুন পাঁচ শতাধিক জেলা ও
আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাকে চিঠি দেয় ইসি।
চিঠিতে সংসদ নির্বাচন পরিচালনার মূল আইন
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২-কে
যুগোপযোগী করার জন্য বাস্তবতার নিরিখে
কোনো অনুচ্ছেদে সংশোধন,
সংযোজন, বিয়োজন করা প্রয়োজন কি না তা
যাচাই করে মতামত দেওয়ার জন্য বলা হয়। ইসি
সচিবালয় ও নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের
কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও এ বিষয়ে মতামত
চাওয়া হয়।



নির্বাচন কর্মকর্তারা আরপিওর বেশ কিছু ধারায়
সংশোধনের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এ
ব্যাপারে একজন কমিশনার বলেন, 'সম্প্রতি অনুষ্ঠিত
তিন সিটি নির্বাচনে বেশ কিছু নতুন অনিয়ম
কমিশনের চোখে পড়েছে। এসব অনিয়ম
এখনই বন্ধ না করা হলে ইসি ও নির্বাচনব্যবস্থার ওপর
আস্থা হারাবে মানুষ। তাই বাস্তবতার নিরিখে আরপিও
সংশোধনীর জন্য বেশ কিছু বিষয়ে জেলা
ও আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের মতামত নিয়েছে
কমিশন।'
ইসির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতামত
পর্যালোচনা করে দেখা গেছে,
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় 'সশস্ত্র
বাহিনী'কে ফিরিয়ে আনা, একাধিক প্রার্থী
সমান ভোট পেলে 'লটারির নিয়ম' বাদ দিয়ে
নতুন করে ভোটাভুটির বিধান করা এবং
স্বতন্ত্রপ্রার্থীদের ১ শতাংশ ভোটারের
সমর্থনের তালিকা দেওয়ার বিধান বাদ দেওয়ার
সুপারিশ এসেছে। এ ছাড়া ডিজিটাল প্রচারণার নানা দিক
যুক্ত করা, হলফনামায় অসত্য তথ্য প্রদান বা তথ্য
গোপন করলে এবং মনোনয়নপত্র দাখিল
থেকে ভোটগ্রহণের আগ পর্যন্ত
যেকোনো সময়ে তা ধরা পড়লে
প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান যুক্ত
করার বিষয়গুলোও উঠে এসেছে।
নির্বাচনে অনিয়ম ঠেকাতে রিটার্নিং অফিসারকে
ভোটকেন্দ্র বন্ধের ক্ষমতা দেওয়া ও ব্যয়
রিটার্নে সঠিক তথ্য দিয়েছে কি না তা যাচাইয়ের
ওপর বেশি জোর দিয়েছে কমিশন। মাঠপর্যায়
থেকেও এ দুটি বিষয়ে ব্যাপক সাড়া পাওয়া
গেছে।
বিদ্যমান আরপিওতে হলফনামায় অসত্য তথ্য প্রদান বা
তথ্য গোপন করলে এবং মনোনয়নপত্র যাচাই-
বাছাইয়ের সময়ে কেউ আপত্তি না জানালে
ভোটগ্রহণের আগে ওই প্রার্থীর
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নির্বাচন
কর্মকর্তাদের নেই। ভোটকেন্দ্রে
অনিয়ম বা হামলার ঘটনা ঘটলে কেন্দ্র বন্ধের
ক্ষমতা শুধু প্রিসাইডিং অফিসার ও নির্বাচন কমিশনের
রয়েছে। এবার রিটার্নিং অফিসারকেও কেন্দ্র
বন্ধের ক্ষমতা দেওয়া, দাখিলকৃত রিটার্ন সঠিক কি না
তা যাচাই করা, রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থায়ন, ইসির
আয়োজনে একমঞ্চে সব প্রার্থীর
প্রচারণার বিষয়গুলো আরপিওতে আনার প্রস্তাব
রয়েছে বলে জানা গেছে।
খুলনার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মজিবুর রহমান তাঁর
প্রস্তাবে 'না' ভোট চালুর পক্ষে মত
দিয়েছেন। একই সঙ্গে কোনো
আসনে ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে ফের
ভোটগ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন তিনি। 'না'
ভোট চালুর প্রস্তাব দিয়েছেন সিলেটের
আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা এজহারুল হকও।
নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন প্রার্থীরা যথাসময়ে
না দিলে কঠোর হওয়ার পক্ষেও মত দেন
তিনি। দুই বা ততধিক প্রার্থী সমান ভোট
পেলে লটারি প্রথা বাদ দিয়ে ফের
ভোটের প্রস্তাব দিয়েছেন রাজশাহীর
নির্বাচন কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার। আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা
বাহিনীকেও অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মত
দিয়েছেন তিনি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার
ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১ শতাংশ ভোটারের
সমর্থনের বিধান বাদ দেওয়ার পক্ষে মত
দিয়েছেন ভোলার নির্বাচন কর্মকর্তা মো.
আবু সাঈদ। একই সঙ্গে সকাল ৮টা থেকে
বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণের পরিবর্তে
সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত
ভোটগ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন তিনি।
খাগড়াছড়ির জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা তাঁর প্রস্তাবে
বলেছেন, জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার
নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের রিটার্নিং
অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি
সংশোধন করা যেতে পারে। বর্তমানে
জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী
কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ
দিচ্ছে কমিশন। দেশের ভেতরে
যেকোনো প্রার্থী যাতে অনলাইনে
মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেন, সে
সুযোগ আরপিওতে রাখা যেতে পারে- এমন
প্রস্তাব করেছেন ইসির জ্যেষ্ঠ সহকারী
সচিব মইনুদ্দিন খান। চট্টগ্রাম জেলার একজন
আঞ্চলিক কর্মকর্তা বলেন, 'বর্তমান
প্রেক্ষাপটে আইনটিকে আরো
যুগোপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক করার জন্য
বেশ কয়েকটি নতুন বিষয় যোগ করার বিষয়ে
আমরা মত দিয়েছি। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে
নির্বাচনের অনেক কিছুতেই পরিবর্তন
এসেছে। প্রার্থীদের জন্য যে ব্যয়
নির্ধারণ করা হয়েছে বাস্তবে তার কয়েক গুণ
বেশি ব্যয় হয়ে থাকে। এটা কমিশনও জানে।
তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও
প্রার্থীর ব্যয় বাড়ানো, ডিজিটাল প্রচারণার
সুযোগ দেওয়াসহ বেশ কিছু বিষয় সংযোজন
করার প্রস্তাব দিয়েছি।'
নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বলেন,
আরপিওতে সংশোধনী আনার লক্ষ্যে
মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতামত সংগ্রহ করা
হয়েছে। আইনটিকে যুগোপযোগী
করতেই নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের
প্রস্তাব চাওয়া হয়েছিল। তাঁদের প্রস্তাবগুলো
পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ
নেওয়া হবে। তবে এ আইন সংস্কার নিয়ে
সংলাপ করা হবে কি না তা সিইসির নেতৃত্বে
পুরো কমিশন ভেবে দেখবে।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে
নাগরিকরা প্রথমবারের মতো 'না ভোট'
দেওয়ার সুযোগ পায়। ২০০৭-০৮ সালের
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৩১(ক) ধারায় 'না
ভোট' দেওয়ার বিধান ছিল। ওই অধ্যাদেশের
৪০(ক) ধারায় উল্লিখিত অন্য একটি বিধানে বলা হয়, যদি
'না ভোট' সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থীর
ভোটকে ছাড়িয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে
নতুন করে নির্বাচন হবে। পরে নোটিশের
বিবাদীরা (সরকার ও নির্বাচন কমিশন) 'না
ভোটের' বিধান বাতিল করে গণপ্রতিনিধিত্ব
আদেশ সংশোধন করে।