বাংলাদেশ

বনসাই সমাহারে মুগ্ধ প্রকৃতিপ্রেমীরা

হাজার হাজার
বছর ধরে আমাদের এই পৃথিবীকে
প্রাকৃতিকভাবে বাসযোগ্য, সবুজ ও শীতল
রাখতে এবং মনোমুগ্ধতায় ভরিয়ে দিতে
অত্যন্ত সহায়ক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রাখছে গাছ। অনেকেই বলে থাকেন, গাছ
হচ্ছে প্রকৃতির এক অন্যতম সেরা ও সুন্দর
সৃষ্টি। গাছের উপকারিতার বর্ণনা
সহজেই শেষ করার নয়। গাছ পছন্দ করেন
না এমন মানুষ বোধহয় দুর্লভ। কালের
পরিক্রমায় এই গাছকে নিয়ে পরীক্ষা-
নিরীক্ষা ও গবেষণা কম হয়নি। গাছ
নিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের এমনই একটি
গবেষণার ফল হচ্ছে বনসাই। যা
প্রকৃতিপ্রেমীদের এক অনাবিল আনন্দ
দিয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে।বনসাইয়ের
দিকে দৃষ্টি পড়লে যে কোন মানুষেরই মন
অনাবিল আনন্দে ভরে যেতে বাধ্য।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত
বাংলাদেশেও বনসাই শিল্পীদের
সংখ্যা যেমন দিন দিন বাড়ছে তেমনি
বনসাইয়ের প্রতি সাধারণ মানুষের
আগ্রহও বাড়ছে সমানতালে। প্রকৃতি
রক্ষায় দেশের জন্য এটি একটি খুবই
ইতিবাচক দিক। আর এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত
প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে চলছে
বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি। এই
সোসাইটির আয়োজনে গতকাল থেকে
ঢাকার ধানম-িতে শুরু হয়েছে চার
দিনব্যাপী ১৭তম বার্ষিক বনসাই
প্রদর্শনী। ধানম-ির ২৭ নম্বর সড়কের ২০
নম্বর বাসায় মহিলা ভলান্টারি
এসোসিয়েশনের অডিটোরিয়ামে
আয়োজিত এই বনসাই প্রদর্শনী চলবে
আগামী ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। প্রতিদিন
সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই
প্রদর্শনী দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
গতকাল সকালে দেশের খ্যাতিমান চিত্র
ও ভাস্কর্য শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে
এই বনসাই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের
রাষ্ট্রদূত মাসাতু ওয়াতানা, বিশিষ্ট
সংগীত শিল্পী রফিকুল আলম ও
আয়োজনের পৃষ্ঠপোষক গ্রীণ ডেলটা
ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা
পরিচালক ফারজানা চৌধুরী বিশেষ
অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটির সভাপতি
নাজমা শফিকের সভাপতিত্বে এই
অনুষ্ঠানে সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক
মোহাম্মদ আনিসুল হকসহ অন্যান্য
সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। বিপুল সংখ্যক
প্রকৃতিপ্রেমী এই বনসাই প্রদর্শনীতে
ভিড় করেন। প্রদর্শনী শুরু হওয়ার সাথে
সাথেই বেশ কিছু দুর্লভ ও আকর্ষণীয়
বনসাই বিক্রীও হয়ে যায়। প্রকার ও
আকারভেদে এক হাজার টাকা থেকে শুরু
করে দুই লক্ষ টাকা পর্যন্ত বনসাইয়ের মূল্য
নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রদর্শনীতে ৫০
বছরের পুরনো একটি দৃষ্টিনন্দন দেশী বট
গাছের বনসাই ছিলো সকলের আকর্ষণের
কেন্দ্রবিন্দু। তবে এটি শুধু প্রদর্শনের
জন্যই রাখা হয়েছে।আয়োজক সূত্রে
জানা গেছে, দেশী ও বিদেশী প্রায় ১০০
প্রজাতির এক হাজারেরও বেশি বনসাই
প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। তবে
আমাদের দেশীয় প্রজাতির গাছের
সংখ্যাই অনেক বেশি। দেশীয় প্রজাতির
গাছের বনসাইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
হচ্ছে বট, পাকুর, নিশিন্দা, সুন্দরী,
কাঞ্চন, কতবেল, তেঁতুল, হিজল, শেওড়া,
কৃষ্ণচূড়া, কামিনী, ডুমুর, নারিকেল,
নাগলিঙ্গম, বাগানবিলাস, প্রেমনা, বকুল
ইত্যাদি। আর বিদেশী প্রজাতির গাছের
মধ্যে রয়েছে ফাইকাস, চীনাবট, পুকেন্টি,
জুনিপার, ঝুমুর, সাফেলারা ইত্যাদি।
বনসাই সোসাইটির ঢাকা এবং ঢাকার
বাইরের প্রায় শতাধিক সদস্য তাদের
তৈরী করা বনসাই নিয়ে এই প্রদর্শনীতে
অংশ নিয়েছেন। ঢাকার উত্তরার বনসাই
শিল্পী গোলাম হাবীবের ৩০ বছর পুরনো
একটি সুন্দরী গাছের বনসাই এই
প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে, যার মূল্য দুই
লক্ষ টাকা। সিলেটের কুলাউড়া থেকে
এই প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন বনসাই
শিল্পী সেলিনা পারভীন লাভলী। তিনি
বিভিন্ন প্রজাতির ৭টি বনসাই নিয়ে এই
প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছেন। তবে এবারের
এই বনসাই প্রদর্শনীর অন্যতম আকর্ষণ
হচ্ছে সেলিনা পারভীনের সৃষ্ট
নারিকেল গাছের বনসাই। যা এদেশে
বিরল। তার এই নারিকেলের বনসাইটির
বয়স চলছে ১০ বছর এবং তিনি এটিকে
বিক্রী না করে সবসময় নিজের কাছেই
রাখবেন বলে ঠিক করেছেন। প্রথমবারের
মত এই প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে সেলিনা
পারভীন লাভলী তার প্রতিক্রিয়ায়
বলেন, ‘আমরা বনসাই তৈরি করি
প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং নিজের
মনকে প্রশান্তি দেয়ার লক্ষ্যে। তবে
প্রথমবার এবারের প্রদর্শনীতে অংশ
নিয়ে আমি সকলের কাছ থেকে যে সাড়া
ও উৎসাহ পেয়েছি, তা আমাকে
ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। এই
অনুপ্রেরণা আমাকে বনসাইয়ের প্রতি
আরো বেশি আকৃষ্ট করবে।’প্রদর্শনীতে
অংশ নেয়া ঢাকার ধানম-ি নিবাসী
বনসাই শিল্পী ও বনসাই সোসাইটির
কোষাধ্যক্ষ সৈয়দা আমিনা হক মিনার
বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় বনসাই শোভা
পাচ্ছে। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য
হচ্ছে ১৫ বছরের পুরনো তেঁতুল গাছের
দৃষ্টিনন্দন বনসাইটি। যার মূল্য ৭০ হাজার
টাকা।বনসাই প্রদর্শনীতে আসা দর্শকদের
অভিব্যক্তি দেখে একটি বিষয় খুব সহজেই
নিশ্চিত হওয়া গেল- বর্তমান প্রযুক্তি
নির্ভর, বিরক্তিকর আন্তরিকতাবিহীন এই
জটিল যুগেও মানুষ যে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার
জন্য এখনও প্রকৃতির কাছেই বার বার
ছুটে আসেন। অর্থ-বিত্ত, গাড়ী-বাড়িসহ
বিলাসবহুল জীবনের চেয়েও মানুষের
মনের প্রকৃত সুখ যে এখনও প্রকৃতির
মাঝেই সীমাবদ্ধ, সেটারই এক বাস্তব
প্রতিফলন দেখা গেল এই বনসাই
প্রদর্শনীতে আসা দর্শকদের অভিব্যক্তি
দেখে। প্রদর্শনীতে ঢাকার বসুন্ধরা
থেকে আগত বৃক্ষপ্রেমী নাসিমা আক্তার
ডলি তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেন,
‘আমরা তো ঢাকার চার দেয়ালের মাঝে
বন্দী। আমাদের আশপাশে গাছপালার
কোন ছায়াও দেখিনা। এই নির্মমতায়
তাইতো কোথাও গাছ দেখার সুযোগ
পেলেই সেখানে ছুটে যাই। এই বনসাই
প্রদর্শনীতে একসাথে এত বেশি গাছ, এত
বেশি সবুজ দেখে আমি দারুণভাবে মুগ্ধ,
অভিভূত। এজন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ
জানাই বাংলাদেশ বনসাই
সোসাইটিকে।’