বাংলাদেশ

বোমার আঘাতে ভেংগে গেল সাঞ্জুর পরিবারের স্বপ্ন

মায়ের কোলে চড়ে দেড় বছরের কায়েস
এসেছিল হোসেনী দালান এলাকায়। বোমার
আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলো মা ও শিশু। গতকাল
ঢামেক থেকে তোলা ছবি। ছবি : কালের
কণ্ঠ
দেড় বছরের শিশু কায়েস, কী হয়েছে তা
বোঝার বয়স হয়নি তার। অবাক চোখে সে
বারবার তাকাচ্ছে সবার দিকে। যন্ত্রণায়
কেঁদে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। তারপর আবার
অবাক অপলক চাহনি। মায়ের কোলে চড়ে
কায়েসও গিয়েছিল তাজিয়া মিছিলে। এখন
তার ঠিকানা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ
হাসপাতালের ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিছানা।
কায়েসের মা হালিমা বেগমও আহত
হয়েছেন। তাঁর প্রশ্ন-'কেন বোমা মারল?
কারা মারল? কেউ এমন বোমা কোনো সময়
মারেনি। এমন ঘটনা ঘটতে পারে জানলে
আমার বাচ্চারে নিয়া আমি তো সেইখানে
যাইতাম না।'
পুরান ঢাকার কসাইটুলী থেকে স্ত্রী-
সন্তানকে নিয়ে তাজিয়া মিছিলে অংশ
নিতে যান কায়েসের বাবা মনির হোসেন।
বোমার আঘাতে তিনিও আহত হয়েছেন।
শিশুসন্তানের পাশের শয্যায় শুয়ে
কাতরাচ্ছেন মা-বাবাও।
বোমার আঘাতে আহত হয়েছে অনেকেই।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক)
হাসপাতালের হিসাব মতে, শুক্রবার রাতে
ঘটনার পর সেখানে ৭৫ জনকে নেওয়া হয়; ১৬
জন এখনো চিকিৎসাধীন। হাসপাতালে
নেওয়ার পরই মৃত ঘোষণা করা হয়
কেরানীগঞ্জের কিশোর সাজ্জাদ হোসেন
সাঞ্জুকে (১৬)। স্বজনরা জানায়, সপ্তম
শ্রেণির ছাত্র সাঞ্জুই ছিল তার পরিবারের
স্বপ্ন।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ জনের মধ্যে
দেড় বছরের কায়েসসহ আছে চার শিশু।
নিউরোসার্জারি, অর্থোপেডিক ও
ক্যাজুয়ালটি বিভাগে চিকিৎসাধীন তারা।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, তিনজনের
অবস্থা আশঙ্কাজনক।
আবাসিক সার্জন ডা. কে এম রিয়াজ
মোর্শেদ বলেন, 'শুক্রবার রাত সোয়া ২টা
থেকে ভোর পর্যন্ত ৭৫ জনকে এখানে আনা
হয়। ১৬ জনকে আমরা ভর্তি করেছি।
বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে
দেওয়া হয়েছে।'
এদিকে মিটফোর্ড হাসপাতাল সূত্রে জানা
গেছে, সেখানে ৩২ জন প্রাথমিক চিকিৎসা
নিয়েছে। তাদের সবাইকেই ছেড়ে দেওয়া
হয়েছে।
সাঞ্জুর পরিবারে মাতম : পাঁচ ভাই দুই
বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল সাজ্জাদ
হোসেন। আদর করে সবাই সাঞ্জু বলে ডাকত।
চড়াইল নুরুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম
শ্রেণির ছাত্র ছিল সে। তাকে নিয়ে মা-
বাবার আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ ছিল না।
ছেলে বড় হয়ে মা-বাবার দুঃখ ঘুচাবে, বড়
চাকরি করবে, ভাই-বোনদের দেখবে-এ রকম
অসংখ্য স্বপ্ন দেখতেন বাবা সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত পিয়ন
নাসির মিয়া। কিন্তু বোমা হামলায়
সন্তানের মৃত্যুতে তাঁদের স্বপ্নেরও মৃত্যু
হয়েছে। হামলায় আহত হয়েছেন সাঞ্জুর
ভাবি সুমী (২৮), ভাতিজি সাজিয়া সুলতানা
(১১) ও ভাবীর মা আয়শা বেগম (৬০)।
সাঞ্জুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা
বলে জানা গেছে, নাসির মিয়ার পৈতৃক
বাড়ি পুরান ঢাকার বাবুবাজারে।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সামান্য
জমিতে বাড়ি করলেও পরিবারের
সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় সেটি ভাড়া
দিয়ে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া-
হাবিবনগরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। শত
চেষ্টা করেও অন্য সন্তানদের পড়ালেখা
করাতে পারেননি। ব্যতিক্রম ছিল সাঞ্জু।
সে ছিল মেধাবী। তাকে নিয়ে তাঁরা অনেক
স্বপ্ন বুনেছিলেন। নাসির মিয়া রাজধানীর
হাম্মাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
থেকে অবসর নিয়েছেন। দুই মেয়েকে বিয়ে
দিয়েছেন। লেখাপড়া না জানায় চার ছেলে
ভালো চাকরি পায়নি। তাই ছোট ছেলে
সাঞ্জুই ছিল ভরসা। পরিবারে সচ্ছলতা
আনতে বুড়ো বয়সে তিনি বংশালের একটি
ছাপাখানায় শ্রমিকের কাজ নেন।
কেরানীগঞ্জের বাসায় কথা হয় নাসির
মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, 'বাবারে! আমার
কলিজাটা ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। ওরে
নিয়া কত স্বপ্ন দেখছি। সব শেষ।' পাশেই
পুত্রশোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মা
রাশিদা বেগম।
সাঞ্জুর বড় ভাই রাশেদ বলেন, তাঁর শিশুপুত্র
সিহাবের মানত ছিল। এ জন্য তিনি স্ত্রী,
শাশুড়ি ও দুই সন্তানকে নিয়ে হোসেনী
দালানে যেতে মনস্থির করেন। সাঞ্জুও
যাওয়ার আবদার করায় তাকে সঙ্গে নেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে,
কেরানীগঞ্জে প্রথম জানাজা ও
বাবুবাজারে দ্বিতীয় জানাজা শেষে
শনিবার বিকেলে রাজধানীর আজিমপুর
কবরস্থানে সাঞ্জুকে দাফন করা হয়েছে।
হাসপাতালে আহাজারি : আইসিইউয়ের
বাইরে জামালের ছেলে মো. রিপন বলে,
'পোস্তায় আমাদের বাসা। বাবা লেইস-
ফিতা বিক্রি করতেন। তিনিই আমাদের
সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
মহররমে কিছু অতিরিক্ত আয়ের আশায় তিনি
গিয়েছিলেন হোসেনী দালান এলাকায়।'
কাঁদতে কাঁদতে সে বলে, 'এখন আমাদের কী
হবে?'
১০ বছরের শিশু সোহানের পাশে বসে কেঁদে
বুক ভাসাচ্ছেন মা পারভিন আক্তার। তাঁর
সামনেই যন্ত্রণায় ছটফট করছে শিশুটি।
পারভিন জানান, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে
সোহান। বাবা মো. সেলিমের হাত ধরে
আশুরার মিছিলে যোগ দিতে এসেছিল সে।
তিনি জানান, পেটে অপারেশন করে
স্প্লিন্টার বের করতে হবে।
আহত নূর হোসেনের পা দুটি থেকে প্রচুর
রক্তক্ষরণ হয়েছে। সঙ্গে আহত হয়েছে ছোট
ভাই জনিও। নূর হোসেন বলেন, স্ত্রী, সন্তান
ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে তাজিয়া মিছিলে
অংশ নিতে যান তিনি। হোসেনী দালানের
ভেতরেই ছিলেন তাঁরা। দ্বিতীয়বার বোমা
ফাটার পর হ্যান্ডমাইকে দালান থেকে বের
হতে বলেন আয়োজকরা। তখনই ভিড়ের মধ্যে
তৃতীয় বোমাটি ফাটে।
রিনা আক্তার ভাই সানোয়ার হোসেন ও শিশু
ভাগ্নে হাসানকে নিয়ে যান তাজিয়া
মিছিলে। রিনার শরীরে আঘাত কিছুটা কম
হলেও সানোয়ারের দুই পা, হাত ও কপালে
বড় আঘাত। রিনা বলেন, 'ভাগ্নেকে
মিছিলের সামনে নিব বইলা মানত
করছিলাম। আমাদের তিন বোনের একটাই
ছেলে...।'
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের
সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) খাজা আবদুল
গফুর বলেন, হাসপাতালে অতিরিক্ত ডাক্তার
ও নার্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব সুবিধাই
আছে। দু-একজনের অবস্থা খারাপ আছে।
তবে চিকিৎসায় সংকট নেই।