বাংলাদেশ

পাতি সরালি পাখির অভয়ারণ্য রামগর চা-বাগানের জলাশয়

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী ফেনী নদী ঘেঁষে রামগড় চা-বাগানের অবস্থান। খাগড়াছড়ি জেলার প্রবেশদ্বার এ চা-বাগান। প্রায় ১৪শ একর আয়তনের বাগানের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ৫০ একরের একটি বিশাল জলাশয়। সবুজ চা-বাগানের মধ্যে সারি-সারি নারিকেলগাছ ঘেরা এ বিশাল জলাশয়টি শত বছরের পুরোনো। এটি পাতি সরালি হাঁসসহ বিভিন্ন অতিথি পাখির অভয়াশ্রম। তবে সরালি-ই এ জলাশয়ের শত বছরের স্থায়ী বাসিন্দা, চা-পরিবারের সদস্য। নিরাপত্তা ও খাদ্যের অভাব না থাকায় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করে এরা।
পাতি সরালি (Dendrocygna javanica) ডেনড্রোসিগনিডি গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত এক প্রজাতির হাঁস। ইংরেজি নাম Lesser Whistling Duck। এরা ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানীয় পাখি। এদের বাদামি বর্ণের লেজ আছে যা সাধারণত লুকানো থাকে। যখন এরা সোজা হয়ে উড়ে, তখন তাদের দেহের বাকি অংশের তুলনায় মাথা কিছুটা নিচু হয়ে থাকে। এরা খুবই ধীরে উড়ে কিন্তু পাখা খুব দ্রুত নাড়ায়। পাতি সরালি নিশাচর পাখি। এরা দিনের বেলায় বিশ্রাম নেয়। পাতি সরালি সব সময় একটি বড় পরিবারের সঙ্গে থাকে।
এদের প্রধান খাবার হলো পানিতে থাকা গুল্ম, ধানখেতের ধান, ছোট মাছ, ব্যাঙ, অমেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন শামুক, কেঁচো ইত্যাদি। পাতি সরালির প্রজননকাল সাধারণত বর্ষাকাল। এদের প্রজননকাল এলাকার খাবারের প্রাচুর্যের ওপর নির্ভরশীল। এরা ক্ষুদ্র ডাল ও ঘাস দিয়ে গাছের গোড়ায় বাসা বানায়। স্ত্রী পাখি একসঙ্গে ৭ থেকে ১২টি সাদা ডিম পাড়ে। ডিমগুলোতে পিতামাতা উভয়ে তা দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ২২ থেকে ২৪ দিন সময় লাগে। ছোট সরালি, সরাল, শরাল, গেছো/শিঙ্গেল হাঁস নামেও পরিচিত। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল হয়ে চীন ও ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত এদের আবাস এলাকা বিস্তৃত। দেহের দৈর্ঘ্য ৩৮ থেকে ৪২ সেন্টিমিটার ও ওজন ৪৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম। এরা শিস দিয়ে হুই-হুয়ি হুই-হুয়ি স্বরে ডাকে।
চা-বাগানের জলাশয়ের বাসিন্দা পাতি সরালির সঙ্গে লেনজা হাঁস, পিং হাস, বালি হাঁস, বড় সরালি, কাইম, মদনা, গঙ্গা কবুতর, কালাকোড়া ও পিয়ারির পাশাপাশি নাম না জানা অনেক অতিথি পাখির বিচরণও দেখা যায়। শীতে নানা প্রজাতির অতিথি পাখিও এসে জড়ো হয় এ জলাশয়ে। শীতের সকালের সোনালি রোদে পাতি সরালিসহ অন্য পাখিদের সঙ্গে বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা আর গাঙচিলের মতো দেশীয় পাখি একাকার হয়ে যায় মিলনমেলায়। সারা বছরই মুখরিত থাকে অসংখ্য পাখপাখালির কলকাকলিতে। কখনো জলকেলি, কখনো খুনশুটিতে কিংবা গলা ছেড়ে সুর তুলে ঝাঁকে ঝাঁকে আকাশে উড়ছে এসব পাখি। এদের দলবদ্ধ বিচরণ সহজেই মন কেড়ে নেয় যে কারো। সবুজ চা-বাগানের অপরূপ সৌন্দর্য যেন আরো বাড়িয়ে দেয় এসব পাখি। রামগড় চা-বাগানের বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মচারী রাখাল চন্দ্র বণিক বলেন, প্রায় ৮০ বছর আগে এ চা-বাগানেই তার জন্ম। জন্মের পর থেকেই জলাশয়ে ঝাঁকে-ঝাঁকে পাখির বসবাস দেখে আসছেন। ১৯১৬ সালে বাগানটির সৃষ্টি। জলাশয়টি তারও আগের এবং প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি। বিশাল এ ডোবা দেশীয়জাতের নানা মাছসহ জলজ প্রাণী ও জলজ উদ্ভিদে পরিপূর্ণ ছিল। এ কারণেই বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এ জলাভূমিটি বেছে নেয়। তিনি আরো বলেন, বাগানের শ্রমিক-কর্মচারী কেউ কখনো পাখিগুলোকে মারা কিংবা বিরক্ত করে না। ফলে চা-পরিবারের সদস্য হিসেবেই পাখিগুলো সারা বছর বসবাস করে। বাগানের ব্যবস্থাপক শওকত বাহার সোহাগ বলেন, বাগানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদের খান স্যার পাখিগুলোর ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। পাখির আবাসস্থল জলাশয়টিতে সার্বক্ষণিক চার জন পাহারাদার নিয়োজিত থাকে। কেউ যেন পাখি মারা কিংবা কোনো রকম বিরক্ত করতে না পারে এজন্য কঠোর নির্দেশ তার। তাই বাগানের সবাই এ ব্যাপারে খুব সজাগ ও সতর্ক। তিনি আরো বলেন, শুধু জলাশয় নয়, বাগানের গাছে-গাছেও পাখিদের বসবাসের জন্য বাসা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ফলে পুরো বাগানই পাখিদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে।   এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস