কলাম

দেশ কি দ্বিমুখী সংকটে?

বাংলাদেশে করোনার দুর্যোগ হঠাৎ করে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক রোগী শনাক্ত হচ্ছে। মার্চ মাসেই প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা ৫-৬-এ নেমে এসেছিল। এই সংখ্যা ৪৫-এ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাইরোলোজিস্টরা মনে করেন, মৃতের সংখ্যা যদি ৫ জনে সীমিত থাকে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করা যায়।

গত কয়েক দিনে মৃতের হার জানিয়ে দিচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। এজন্য অবশ্য জনগণকে দায়ী করতে হয়। রাজধানীর রাজপথ, শপিং সেন্টার এবং আরও অন্যান্য স্থানে যেখানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়, দেখা যেত সেসব স্থানে বেশিরভাগ মানুষই মাস্ক না পরে ঘুরাফেরা করছে।

এছাড়া বিয়ে-শাদির উৎসব ও পার্টি দেওয়া বেড়ে গিয়েছিল। এসব অনুষ্ঠানাদিতে ব্যাপক মানুষ জমায়েত হতো, কিন্তু এদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব কমপক্ষে তিন ফুট হওয়া তো দূরের কথা, হয়ে পড়েছিল ১-২ ফুট। করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, ঢাকার কোনো হাসপাতালে করোনা রোগীর জন্য সিট পাওয়া যাচ্ছে না। আইসিইউ বেডগুলোর সবই ক্রিটিক্যাল রোগীতে পরিপূর্ণ।

নতুন ক্রিটিক্যাল রোগীরা আইসিইউ সেবার জন্য যে কোনো পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে ইচ্ছুক হলেও তারা বেড পাচ্ছেন না। এদিকে টিকাদান অভিযানও সংকটের মুখে পড়তে পারে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। যারা টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তারা দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিনের অভাবে না-ও পেতে পারেন। ফলে প্রথম ডোজ থেকে প্রাপ্তব্য উপকারিতা ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

আশা করব, টিকার নতুন চালান দেশে এসে পৌঁছাবে। শুধু ১টি দেশ থেকে টিকা কেনার সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত হয়েছে বলে মনে করা যায় না। যদিও বাংলাদেশ ৩ কোটি ডোজ টিকার দাম আগাম পরিশোধ করেছে, তবুও বাংলাদেশে টিকার চালান পাঠাতে ধানাই-পানাই করা হচ্ছে। অজুহাত দেওয়া হচ্ছে নিজ দেশের জনগণের চাহিদা পূরণের। আমি বেশ কয়েক সংখ্যা আগে করোনার টিকা নিয়ে লিখতে গিয়ে উত্তর ও দক্ষিণের ব্যবধান সম্পর্কে লিখেছিলাম।

উত্তরের ধনী দেশগুলো অর্থ ও প্রতিপত্তি খাটিয়ে টিকার মজুত গড়ে তুলছে। দক্ষিণের গরিব দেশগুলো এর ফলে প্রয়োজনীয় টিকা সংগ্রহ করতে পারছে না। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মিডিয়াতে টিকার রাজনীতি এবং রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন লেখা হচ্ছে। কিন্তু এসব লেখালেখির ফলে কোনোরকম প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয় না।

এই অবস্থায় নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমরা কী করতে পারি? আমাদের অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সাবান দিয়ে হাত ধোয়া কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, দৈহিক দূরত্বের নির্দেশনা মেনে চলা এবং মাস্ক ব্যবহার করা-এই নিয়মগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে। মাস্ক ব্যবহার করতে গিয়ে নাসাপথ না ঢেকে মাস্কটি থুতনির নিচে ঝুলিয়ে রাখলে তা কোনো কাজে আসে না।

নিয়ম মেনে সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করলে অবশ্যই কিছু সুফল পাওয়া যাবে। নিয়মিত মাস্ক ব্যবহারের ফলে সংক্রমণ কী হারে হ্রাস পায় সে সম্পর্কে কোনোরকম বৈজ্ঞানিক তথ্য চোখে না পড়লেও অনুমান করতে পারি নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করলে সংক্রমণ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রেহাই পাওয়া সম্ভব হবে।

প্রশ্ন হলো, স্বাস্থ্যবিধিগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। সচেতনতা ও সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ আমাদের চালচলনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসটির নতুন স্ট্রেইন এসে পড়েছে। এই নতুন স্ট্রেইন খুব দ্রুত ছড়ায় এবং অল্প সময়ের মধ্যে ট্র্যাজিক পরিণতির সৃষ্টি করে।

বর্তমানে যেভাবে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে, তা লক্ষ করে প্রশ্ন জাগে এটা কি নতুন স্ট্রেইনের আক্রমণ? সরকারকে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। একদিকে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার-প্রচারণা জোরদার করতে হবে। সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক প্রচারণা জোরদার করার জন্য সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের টিভি ও রেডিওতে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য পেশের সুযোগ দিতে হবে।

এ ছাড়া নামকরা চিকিৎসক এবং বুদ্ধিজীবীদেরও এ প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। তাহলে মানুষ এ ব্যাপারে সাবধান হবেন। তাছাড়া করোনাবিরোধী মাস পালনের কথাও ভাবা যেতে পারে, যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বাস্থ্যবিধি অমান্যকারীদের ওপর জরিমানা ধার্য করতে পারে।

করোনা সংকটের সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে খাদ্য ঘাটতির শঙ্কা। গত ১ মার্চ অর্থনীতিভিত্তিক দৈনিক বণিকবার্তা প্রধান সংবাদ শিরোনাম করেছে, ‘খাদ্য ৭৪ লাখ টন ঘাটতির শঙ্কা’। এই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘স্বাধীনতার পর ৫ দশকে খাদ্যশস্যের উৎপাদন দেশে ৩ গুণ বেড়েছে। বৈশ্বিক চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন তৃতীয় অবস্থানে। এ কারণে কোভিডকালেও খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে হয়নি বাংলাদেশকে।

কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এসে খাদ্যশস্য নিয়ে এ উচ্ছ্বাস এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে আসছে। করোনাজনিত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বড় ধরনের খাদ্য ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। খাদ্যশস্যের দামে এর প্রভাবও দেখা যাচ্ছে। মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) গ্লোবাল এগ্রিকালচারাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্কের (গেইন) প্রতিবেদনের তথ্যেও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি পরাশক্তি। মার্কিন সরকার কেবল তাদের নাগরিকদের এবং নিজ দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহেই নিয়োজিত থাকে না। যেহেতু দেশটি বিশ্বপ্রভুর আসনে থাকতে চায়, সেজন্য তারা দুনিয়ার সব দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক তথ্যসমূহ সাফল্যের সঙ্গেই সংগ্রহ করে। কারণ, এসব তথ্য যুদ্ধবিগ্রহ, বিদ্রোহ এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। আমেরিকা যা কিছু করে, তা অস্ত্র উৎপাদনকারী শিল্পের স্বার্থেই করে।

ইউএসডি’র ‘গ্রেইন অ্যান্ড ফিড আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনের প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে (২০২০-২১) দেশে চালের উৎপাদন হবে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টন, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টন কম। যদিও এ সময় দেশে খাদ্য পণ্যটির চাহিদা থাকবে প্রায় ৩ কোটি ৫৯ লাখ টন। সেই হিসাবে দেশে এবার চালের ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ১১ লাখ টনে।

অন্যদিকে এ সময় দেশে গমের চাহিদা থাকবে প্রায় ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টন। যদিও উৎপাদন হবে মাত্র ১২ লাখ ২০ হাজার টন। সব মিলিয়ে দেশে এবার প্রায় ৭৪ লাখ ৩০ হাজার টন খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) দেশে মোট চাল উৎপাদন হয়েছিল ৩ কোটি ৮৭ লাখ ২৪ হাজার টন।

চলতি অর্থবছরে এই উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ কোটি ৯৬ লাখ টন। যদিও ইউএসডিএ’র প্রক্ষেপণ বলছে, এবার চালের উৎপাদন হবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। ইউএসডিএ’র ভাষ্যমতে, এ ঘাটতি পূরণের জন্য আমদানিনির্ভরতায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে বাংলাদেশকে।

সেক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরে শুধু গমই আমদানি করতে হবে প্রায় ৬৬ লাখ টন। সব মিলিয়ে দেশে এবার খাদ্য ঘাটতি মেটাতে চাল ও গম আমদানি করতে হতে পারে ৭৭ লাখ টন। সেক্ষেত্রে এবার স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হতে পারে বাংলাদেশকে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারি কিংবা বেসরকারি খাতে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির কোনো তৎপরতা গণমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে না। ঘাটতি যদি এতই বিশাল হয়, তাহলে দেশের নেতৃস্থানীয় সংবাদপত্রগুলো নিশ্চুপ কেন? বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের চাহিদা নিরূপণ করতে গিয়ে জনসংখ্যার বয়স কাঠামো কতটুকু বিবেচনায় নেওয়া হয় সেটা স্বচ্ছ নয়। অল্প বয়সি শিশুরা ভাত কম খাবে, যুবক ও শারীরিক শ্রমে নিয়োজিত লোকেরা বেশি পরিমাণে ভাত খাবে এবং ষাটোর্ধ্ব বয়সের লোকেরা কম পরিমাণে খাবে-এই ধারণার ভিত্তিতেই মাথাপিছু খাদ্যশস্যের চাহিদা প্রাক্কলন করতে হবে।

বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন পরিসংখ্যান নির্ধারণে সনাতনি পদ্ধতি অনুসৃত হয়। একজন অভিজ্ঞ কৃষককে ধানের একটি প্লট দেখিয়ে কোনাকুনিভাবে প্লটটিকে দুটি ত্রিভুজে বিভক্ত করে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন্ অংশে ফলন কী পরিমাণ হবে? কৃষক অভিজ্ঞ হলে পাকা ফসল দেখে বলতে পারে ফলনের পরিমাণ কত।

এভাবে সারা দেশের জন্য দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্ধারিত প্লটসমূহের উৎপাদনকে ভিত্তি করে দেশীয় উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এই কাজটি করেন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মাঠকর্মীরা। তারা কতটা সততার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করেন এ ব্যাপারে সন্দেহ করার কারণ আছে বৈকি। খাদ্যশস্য আমদানিতে বিদেশি মুদ্রার মজুতে হাত দিতে হবে।

বলা হচ্ছে, এখন বাংলাদেশে যে ফরেন রিজার্ভ আছে, তাতে নয় মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব। এত বিপুল পরিমাণ চাল ও গম আমদানি করতে হলে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হবে বৈকি। ফরেন রিজার্ভের টাকা ভেঙে পদ্মা সেতুর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।

এমনিতেই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হওয়ায় ব্যয় বেড়েছে। গুণগত দিক থেকে পদ্মা সেতুর জন্য যে খরচ করা হচ্ছে, তা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত এমন প্রশ্ন যে কোনো ভালো অর্থনীতিবিদ উত্থাপন করতেই পারেন। সমস্যা হলো, সত্যি সত্যি যদি খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি হয়েই যায়, তাহলে কোথা থেকে এই শস্য আমদানি করা হবে? খাদ্যশস্য আমদানি নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়।

কোনো কোনো দেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে খাদ্যশস্য পাঠায়নি। ইউএসডিএ’র তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে বুঝতে হবে করোনার টিকা ঘাটতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে খাদ্যশস্য ঘাটতি। গত বছর কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পায়নি। এ নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক আলোচনা হয়েছে।

কিন্তু এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার তেমন কোনো সিরিয়াস প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে না। অমর্ত্য সেন মনে করেন, কোনো দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র থাকলে খাদ্য সমস্যা সরকার এড়িয়ে যেতে পারে না। আমরা বলব, সামনের দিনগুলোতে মানুষ যেন মৌলিক খাদ্য নিয়ে কষ্টে না পড়ে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ