আন্তর্জাতিক

ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফা ভোট গ্রহন

ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোটে শুক্রবার একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে কিছু সহিংসতা ছাড়া মোটামুটি নির্বিঘ্নেই ভোটগ্রহণ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের তিনটি আসন—কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়িতে শুক্রবার ভোটগ্রহণ হয়। ২১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মোট ১০২টি আসনে ভোট নেওয়া হয়েছে। বিকেল ৫টা পর্যন্ত সারা ভারতে গড় ভোট পড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ।
আর নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের তিনটি আসনে বিকেল ৩টা পর্যন্ত গড় ভোট পড়েছে ৬৬ শতাংশ।
শুক্রবার যেখানে ভোট নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে অরুণাচল প্রদেশ, মনিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরার মতো উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো যেমন আছে, তেমনই রয়েছে মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, ভারতশাসিত কাশ্মীরের মতো রাজ্যও। ভোট হয়েছে তামিলনাডুতেও। এটিই একমাত্র রাজ্য যেখানে সবগুলো আসনের জন্য একই দিনে ভোট নেওয়া হয়েছে।
আবার লাক্ষাদ্বীপ, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলেও ভোট হয়েছে শুক্রবার। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী শুক্রবার সাড়ে ১৬ কোটিরও বেশি মানুষের ভোট দেওয়ার কথা ছিল দুই লাখ নির্বাচন বুথে।
শুক্রবার যে আসনগুলোতে ভোট হয়েছে, সেই সব আসনে ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ৪১টিতে জয়ী হয়েছিল। আর কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট জিতেছিল ৪৫টিতে।
এ দিন যেসব কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা ভোটে লড়ছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নীতিন গডকড়ি, ভূপেন্দ্র যাদব, কিরেন রিজিজু, জিতেন্দ্র সিং, অর্জুন রাম মেঘাওয়াল, নিশীথ প্রামাণিক, সর্বানন্দ সোনওয়াল। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষের যেসব নেতা প্রথম দিনেই প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন কংগ্রেসে গৌরব গগৈ, ডিএমকের কানিমোঝি।
এ রাজ্যে শুক্রবার যে তিনটি আসনে ভোট হয়েছে তার সবকটিই উত্তরবঙ্গের আসন। এর মধ্যে কোচবিহার আসনটিতে বৃহস্পতিবার রাত থেকে বিক্ষিপ্ত অশান্তি শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিগত নির্বাচনে ২০২১ সালে এই আসনের অন্তর্গত শীতলখুচিতে নির্বাচনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালিয়েছিল।
ভোটের দিন নিহত হয়েছিলেন পাঁচ জন। এবার তাই বাড়তি নজর ছিল কোচবিহারের ওপরে। এক সময় বামফ্রন্ট, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ফরওয়ার্ড ব্লকের আধিপত্য ছিল এই জেলায়। তারপর তৃণমূল কংগ্রেস সেই জায়গা দখল করে নেয়। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে বিজেপি এখানে বড় শক্তি হয়ে উঠেছে, আসনটি গত নির্বাচনে বিজেপিই জিতেছিল। এই কেন্দ্র থেকেই ভোটে দাঁড়িয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক।
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন মধ্য ফলিমারি নামের একটি গ্রামে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই ব্যাপক বোমাবাজি চলেছে। আর শুক্রবার সকালে বেশ কয়েকটি তাজা বোমা উদ্ধার করে পুলিশ। আবার মাথাভাঙ্গা এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীদের বিজেপির লোকেরা মারধর করেছে, বুথ-শিবির জ্বালিয়ে দিয়েছে—এসব অভিযোগও পাওয়া গেছে। শীতলখুচিতে আবার বিজেপির এক কর্মীকে কোপানোর অভিযোগ এসেছে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মারধর, হাতাহাতি, বিজেপির এক বুথ এজেন্টকে ‘অপহরণ’—এ রকম নানা ছোটখাটো অশান্তির খবর পাওয়া গেছে। তবে বড় কোনো ঘটনার খবর বিকেল পর্যন্তও নেই। অন্যদিকে সকাল থেকে শান্তই ছিল পাশের কেন্দ্র জলপাইগুড়ি। বিকেলে ওই আসনের অন্তর্গত ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির বিজেপি বিধায়ক একটি বুথে পরিদর্শনের জন্য যেতে গেলে নিরাপত্তাবাহিনী তাঁকে আটকিয়ে দেয়। এ নিয়ে বিজেপি কর্মী ও পুলিশের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচন কমিশন ওই ঘটনার প্রতিবেদন চেয়ে পাঠিয়েছে। বিকেলে ওই এলাকাতেই দ্বিতীয়বার অশান্তি বাঁধে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে। তৃতীয় যে আসনে ভোট হয়েছে, সেই আলিপুরদুয়ারে অবশ্য শান্তিতেই ভোটগ্রহণ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তার দপ্তরে তিনটি আসন থেকে ৪৬৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে।
এক বছর ধরে অশান্ত থাকা মণিপুরের দুটি আসনের জন্য ভোট নেওয়া শুরু হতেই একটি বুথের সামনে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা গুলি চালাতে শুরু করে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, মৈরাঙয়ের থামানপোক্পি এলাকার একটি বুথে এই ঘটনা ঘটেছে। কারও হতাহতের খবর নেই। তবে গুলি শুরু হতেই ভোট দেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন এদিক-ওদিক পালাতে শুরু করেন। একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে প্রায় ১০ সেকেন্ড ধরে লাগাতার গুলির শব্দ শোনা গেছে। এ ছাড়া সংবাদ সংস্থা এএনআই মণিপুরের একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের ভিডিও শেয়ার করেছে এবং ইম্ফল পূর্বের ডিসিকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘কয়েকজন নারী নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ করার পরে ইম্ফলের একটি বুথে ভোটদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরে নির্বাচন কর্মকর্তা বুথটাই বন্ধ করে দেন বলে এএনআই জানিয়েছে। মনিপুরে মূলত হিন্দু মেইতেইদের সঙ্গে আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে জাতিগত সংঘর্ষ চলছে গত বছর মে মাস থেকে। ওই সংঘর্ষে দুই পক্ষের দুই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। মহাতারকারা ভোটের লাইনে
শুক্রবার যেসব রাজ্যে ভোট নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে একমাত্র তামিলনাডুতেই সবকটি আসনে এক দিনেই ভোট হয়েছে। ওই রাজ্যে ৩৯টি লোকসভা আসন আছে। দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যে চিত্র তারকারা বরাবরই অতি জনপ্রিয়, কেউ কেউ তো আবার সুপার হিরো। তামিলনাডুর চলচ্চিত্র জগতের বহু তারকাই রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। ভোটের দিন এঁদের সামনে থেকে দেখতে পাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে বাড়তি আকর্ষণ। সংবাদ সংস্থা এএনআই জানাচ্ছে, তামিল চলচ্চিত্রের মহাতারকা রজনীকান্ত তাঁর বুথে ভোট দিতে এলে অন্য ভোটারদের নমস্কার জানান, তাঁদের সঙ্গে ছবিও তোলেন। তাঁর ভোট দেওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। রজনীকান্ত ছাড়াও কমল-হাসান, ধানুষ, ভিজয় সেথুপথি, নায়িকা তৃষা কৃষ্ণানরাও ভোট দিতে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। ভোট দেওয়ার পর এরা কাউকেই ছবি তুলতে বাধা দেননি। মনে করা হয়, এ দিন নিজেদের ভক্তদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের সেতু তৈরি করা এই নায়ক-নায়িকাদের জনসংযোগ টিমই পরিকল্পনা করে দেয়।
আন্দামানের আদিবাসীরা যেমন শুক্রবার ভোট দিয়েছেন, তেমনই আবার বিশ্বের সব থেকে কম উচ্চতার নারীও ভোট দিলেন এ দিন। আবার উত্তরাখণ্ডে একই পরিবারের তিন প্রজন্মের সদস্যরা একসঙ্গে ভোট দিতে গিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারের কাছে স্ট্রেইট আইল্যান্ডের আদিবাসীরাও ভোট দিয়েছেন শুক্রবার। গ্রেট আন্দামানিজ জনজাতির মাত্র ৫০ জন এখন জীবিত আছেন। ওই স্ট্রেইট আইল্যান্ডের বাসিন্দা গ্রেট আন্দামানিজদের ৩৭ জন শুক্রবার ভোট দিয়েছেন বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তাদের ছবিও দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে। ভারতের ইংরেজি সংবাদ পোর্টাল এনডিটিভি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বের সব থেকে কম উচ্চতার ব্যক্তি হিসেবে গিনেস বুক অব রেকর্ডসের স্বীকৃতি পাওয়া জ্যোতি কিষাণজী আমঘে শুক্রবার মহারাষ্ট্রের নাগপুরে তাঁর বুথে ভোট দিতে এসেছিলেন সকালেই। জ্যোতির উচ্চতা দুই ফুটের থেকে সামান্য বেশি। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, পরিবারের এক সদস্যের কোলে চেপে ভোট দিতে আসেন ৩০ বছর বয়সী জ্যোতি। ‘প্রিমর্ডিয়াল ডোয়ার্ফিজম’ নামে একটি জিনঘটিত সমস্যার কারণে তাঁর উচ্চতা বাড়েনি। তবে এর মধ্যেও জ্যোতি ভারতীয় আর হলিউডের চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। তাঁকে নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক তথ্যচিত্রও হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের হয়ে কিছু দিন আগে তিনি সবাইকে ভোট দেওয়ার আপিলও জানিয়েছিলেন। এ দিন তিনি এসেছিলেন বার্বি ডলের মতো লাল একটি পোষাকে, ঠোঁটে ছিল গাঢ় লাল লিপস্টিক। বুথে ঢোকার আগে তাঁর ছবি তোলার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিলেন জ্যোতি। নাগপুর শহরেই শুক্রবার ভোট দিয়েছেন হিন্দু পুণরুত্থানবাদী সংগঠন আরএসএসের প্রধান মোহন ভগবত। নাগপুরেই আরএসএসের প্রধান কার্যালয়। এবার নাগপুর থেকে বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন এই আসনেরই গত দুবারের সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গডকড়ি। তিনি বিজেপির সাবেক সভাপতিও।  উত্তরাখণ্ডে দেখতে পাওয়া গেছে একই পরিবারের তিন প্রজন্মের সদস্যরা সবাই একসঙ্গে ভোট দিতে এসেছেন। দেরাদুনের একটি ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের বাইরে প্রভা শর্মা, তাঁর দুই মেয়ে আর দুই নাতনীর সঙ্গে ভোট দিতে এসে সাংবাদিকদের চোখে পড়ে যান। হাসিমুখেই ছবি তোলার আবদার মেটাচ্ছিলেন তাঁরা। নির্বাচন কমিশন শুক্রবার এমন বেশ কিছু বুথের ছবি দিয়েছে, যেগুলোকে দেখলে বিয়ে বাড়ি বলে মনে হতে পারে। সুন্দর করে সাজানো ওইসব বুথকে তারা মডেল ভোট গ্রহণ কেন্দ্র বলে চিহ্নিত করেছে। কিছু বুথ আছে, যেখানে ভোটকর্মী থেকে শুরু করে নিরাপত্তাকর্মী—সবাই নারী। এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস