ধর্ম

ঈদুল ফিতরে করণীয়

মনির হোসেন হেলালীঈদ শব্দটি আরবি। এর অর্থ বারবার ফিরে আসা, ঘুরে ফিরে আসা, জমায়েত

হওয়া, খুশি, আনন্দ, অভ্যাস ইত্যাদি। এমন দিনকে ঈদ বলা হয় যে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি

প্রতি বছর বারবার ফিরে আসে। এটা আরবি শব্দ ‘আদা-ইয়াউদু’ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। আবার

অনেকে বলেন, এটা আরবি শব্দ ‘আদত’ বা অভ্যাস থেকে উৎপন্ন। কেননা মানুষ ঈদ উদযাপনে

অভ্যস্ত। সে যাই হোক, যেহেতু এ দিনটি বারবার ফিরে আসে এবং মুসলমানরা এ দিনে তাদের

প্রভুর নির্দেশ পালন করে আনন্দ পায় তাই এর নামকরণ করা হয়েছে ঈদ।এ শব্দ দ্বারা এ দিবসের

নাম রাখার তাৎপর্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দিবসে তার বান্দাদের নিয়ামাত ও অনুগ্রহ দ্বারা

বারবার ধন্য করেন ও তাঁর ইহসানের দৃষ্টি বারবার দান করেন। যেমন রমযানে পানাহার নিষিদ্ধ

করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। সদকায়ে ফিতর, হজ-যিয়ারত, কুরবানির

গোশত ইত্যাদি নিয়ামত তিনি বারবার ফিরিয়ে দেন। আর এ সকল নিয়ামত ফিরে পেয়ে ভোগ করার

জন্য অভ্যাসগতভাবেই মানুষ আনন্দ-ফুর্তি করে থাকে।ঈদের একাধিক অর্থ থাকলেও আমাদের

দেশের অধিকাংশ মানুষ ঈদ বলতে খুশিই বুঝে থাকে। এ খুশির ঈদ আমাদের মাঝে আসে প্রতি

বছর দু’বার। একটিকে আমরা বলি ঈদুল ফিতর বা রোযার ঈদ, আর অন্যটিকে বলে থাকি ঈদুল

আযহা বা কুরবানির ঈদ। ঈদুল ফিতর মাহে রমযানে পূর্ণ এক মাস সিয়াম সাধনা পালনের মাধ্যমে

তাকওয়া অর্জন ও ক্ষুধাতুরের কষ্ট অনুভব করার সাথে সম্পৃক্ত।ইসলামে ঈদের প্রচলনমহান আল্লাহ

রাব্বুল আলামিন মুসলিম উম্মাহর প্রতি রহমত হিসেবে যেসব নিয়ামাত দান করেছেন তার মধ্যে ঈদ

অন্যতম। হাদীসে এসেছেথ ‘রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনাতে আগমন করলেন

তখন মদিনাবাসীদের দুটো দিবস ছিল যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলইহি

ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন এ দু’ দিনের কী তাৎপর্য আছে? মদিনাবাসীগণ উত্তর দিলেন, আমরা

মূর্খতার যুগে এ দুই দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম

বললেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দুই দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটো দিন

দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর।’ [আবু দাউদ-১১৩৪]ঈদের দিনের আমলঈদ একটি

ইবাদাতের নাম। এ দিনটি আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামাত। কিন্তু আমরা অনেকেই এ দিনকে

নিয়ামাত হিসাবে গ্রহণ করি না। এ দিনে এমন অনেক কাজ রয়েছে যা আমাদের জন্য ইবাদাত,

আবার এমন বহু কাজ আছে যা বর্জন করা আমাদের উপর আবশ্যক। নিচে ঈদের দিনে করণীয় ও

বর্জনীয় বিষয়গুলো আলোচনা করা হল :ঈদের দিনে করণীয় ফযরের নামায জামাতে আদায়

করাঈদের দিন ভোর বেলা ফযর নামায জামাতে আদায় করার মাধ্যমে দিনটি শুরু করতে হবে।

আবূ হুরায়রা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

যদি তারা ইশা ও ফযর নামাযের মধ্যে কী আছে তা জানতে পারতো তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ

দুটি নামাযের জামায়াতে শামিল হতো। [বুখারী ও মুসলিম] পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন ও সুগন্ধি

ব্যবহার করাঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন।

কেননা এদিনে সকল মানুষ সলাত আদায়ের জন্য মিলিত হয়। ইবনে উমার রাদি আল্লাহু আনহু

থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে, তিনি ঈদুল-ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।

ইবনে উমার রাদি আল্লাহু আনহু থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত যে, তিনি দুই ঈদের দিনে সর্বোত্তম

পোশাক পরিধান করতেন। [বায়হাকি] ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি আলেমদের

কাছ থেকে শুনেছি তারা প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার ও সাজ-সজ্জাকে মোস্তাহাব বলেছেন।

[আল-মুগনি : ইবনে কুদামাহ]। ইবনুল কায়্যিম রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, নবী কারীম সল্লাল্লাহু

আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’ ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। [যাদুল

মায়াদ] এ দিনে সকল মানুষ একত্রে জমায়েত হয়, তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত হল তার প্রতি

আল্লাহর যে নিয়ামাত তা প্রকাশ করনার্থে ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় স্বরূপ নিজেকে সর্বোত্তম সাজে

সজ্জিত করা। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদি আল্লাহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি

ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দার উপর তাঁর প্রদত্ত নিয়ামাতের প্রকাশ

দেখতে পছন্দ করেন।’ [সহীহ আল-জামে] হেঁটে ঈদগাহে যাওয়াঈদের সলাত আদায়ের জন্য

তাড়াতাড়ি ঈদ গাহে যাওয়া। হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। হাদীসে এসেছে, আলী রাদি আল্লাহু আনহু

থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সুন্নাত হল ইদগাহে হেঁটে যাওয়া। ইমাম তিরমিজি হাদীসটি বর্ণনা করে

বলেন, হাদীসটি হাসান। তিনি আরো বলেন, অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম এ অনুযায়ী আমল করেন

এবং তাদের মত হল পুরুষ ঈদগাহে হেঁটে যাবে, এটা মোস্তাহাব। আর গ্রহণযোগ্য কোন কারণ ছাড়া

যানবাহনে আরোহণ করবে না।এক পথে গিয়ে অন্য পথে আসাঈদগাহে এক পথে গিয়ে অন্য পথে

ফিরে আসা সুন্নাত। জাবের রাদি আল্লাহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি

ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন। [সহীহ বুখারী] অর্থাৎ যে পথে ঈদগাহে যেতেন সে

পথে ফিরে না এসে অন্য পথে আসতেন। এটা এ জন্য যে, যাতে উভয় পথের লোকদেরকে সালাম

দেয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। [যাদুল-মায়াদ]তাকবীর দেয়াকুরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ

তোমাদের সহজ চান, কঠিন চান না, আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করতে পারো এবং তিনি

তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব প্রকাশ কর এবং যাতে তোমরা শোকর

কর।’ [সূরা আল বাকারাহ : ১৮৫] হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি

ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন।

ঈদের সলাত শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন। যখন সলাত শেষ হয়ে যেত তখন আর

তাকবীর পাঠ করতেন না। ইবনে উমার রাদি আল্লাহু ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিনে ঈদগাহে

আসা পর্যন্ত উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করতেন। ঈদগাহে এসে ইমামের আগমন পর্যন্ত এভাবে তাকবীর

পাঠ করতেন। শেষ রমযানের সূর্যাস্তের পর থেকে ঈদুল ফিতরের সলাত শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবীর

পাঠ করবে। বিশেষভাবে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে যখন বের হবে ও ঈদগাহে সলাতের অপেক্ষায় যখন

থাকবে তখন গুরুত্বসহকারে তাকবীর পাঠ করবে।ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময় করাঈদ উপলক্ষে

পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময়

করা যায়। যেমন : (ক) হাফেয ইবনে হাজার রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘জোবায়ের ইবনে

নফীর থেকে সঠিক সূত্রে বর্ণিত যে, রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবায়ে

কিরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়ামিনকা’ অর্থ-

আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আপনার ভাল কাজগুলো কবূল করুন’ [ফতহুল বারী] (খ) ‘ঈদ

মুবারক’ বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। তবে প্রথমে উল্লেখিত বাক্য দ্বারা শুভেচ্ছা বিনিময়

করা উত্তম। কারণ সাহাবায়ে কিরাম রাদি আল্লাহু আনহুম এ বাক্য ব্যবহার করতেন ও এতে

পরস্পরের জন্য কল্যাণ কামনা ও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দু’আ রয়েছে। ঈদের সলাতের

পূর্বে খাবার গ্রহণঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সলাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা এবং ঈদুল

আযহার দিন ঈদের সলাতের পূর্বে কিছু না খেয়ে সলাত আদায়ের পর কুরবানির গোশত খাওয়া

সুন্নাত। বুরাইদা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল

ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আযহার দিনে ঈদের সলাতের পূর্বে খেতেন না।

সলাত থেকে ফিরে এসে কুরবানির গোশত খেতেন। [আহমদ]ঈদের সলাত আদায় ও খুতবা শ্রবণ

করাজামায়াতের সাথে ঈদের সলাত আদায় করতে হবে। ঈদের সলাতের পর ইমাম দুটো খুতবা

দেবেন। সে খুতবায় তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রশংসা ও গুণ-গান, অধিক পরিমাণে তাকবীর

পাঠ করবেন। তবে ঈদের সলাত আদায়কারীকে ঈদের খুতবা শুনতেই হবে এমন কথা নেই। যেমন

হাদীসে এসেছে, আব্দুল্লাহ বিন সায়েব রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী

কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের সলাত শেষ

করলেন, বললেন, (আমরা এখন খুতবা দেব। যার ভাল লাগে সে যেন বসে আর যে চলে যেতে চায়

সে যেতে পারে।) [আবূ দাউদ]