খেলাধুলা

ঘিঞ্জি মহল্লা থেকে বিশ্বমঞ্চে কিলিয়ান এমবাপ্পে

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের উত্তরাংশের একটি অনুন্নত আর দরিদ্র এলাকা- নাম বন্ডি। অনেক নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত এলাকাটির বাসিন্দাদের রয়েছে নানা অভিযোগ। প্যারিসের বিখ্যাত প্রশস্ত সড়ক আর উন্নত জীবনের ছোয়া নেই এখানে। নেই পর্যটক টানার মতো কোন ব্যবস্থা।

প্যারিস বিশ্বের উন্নত নগরীগুলোর একটি হলেও তার একটি অংশে বিরাজ করছে অনুন্নত পরিবেশ, যাকে তুলনা করা যায় ‘প্রদীপের নিচে অন্ধকার’ হিসেবে। এলাকাটির বেশির ভাগ বাসিন্দাই স্বল্প আয়ের। নিজেদের বাড়ি নেই বেশিরভাগেরই। সোস্যাল হাউজিং নামক সরকারি প্রকল্পের অধীনে নির্মিত বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বাস করেন তারা। এলাকাটির বেশিরভাগ বাড়িই সোস্যাল হাউজিংয়ের। বেকারত্বের মাত্রা অনেক বেশি। নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও অন্য এলাকাগুলোর চেয়ে অনেক কম।

তবে এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই মহল্লাটির মানুষ আজ গর্বের সাথে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন। শুধু ফ্রান্সই নয়, বিশ্বমঞ্চেই আজ পা পড়েছে বন্ডি নামক অনুন্নত মহল্লা থেকে উঠে আসা বীরদের। ফ্রান্সের বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম নায়ক কিলিয়ান এমবাপে বন্ডি এলাকার সন্তান। আলজেরীয় মুসলিম মা আর ক্যামেরুন থেকে আসা অভিবাসী বাবার সন্তান এমবাপে আজ বিশ্ব মঞ্চের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন। মাত্র উনিশ বছর বয়সেই তিনি করেছেন বিশ্বজয়।

বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্স দলের কনিষ্ঠতম এই সদস্য দেশকে শিরোপা এনে দেয়ার পাশাপাশি নিজেকেও নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। কিশোর সুলভ গড়ন আর সর্বদা হাসিমাখা মুখের এই তরুণই মূহুর্তে চরম নির্মমতায় দুমড়ে মুচড়ে দেন প্রতিপক্ষের ডিফেন্স। তার গতি আর অসাধারণ ড্রিবলিংয়ের সাথে তাল মেলাতে হিমশিম খায় বাঘা বাঘা ডিফেন্ডাররাও। কিংবদন্তী পেলের পর দ্বিতীয় কিশোর ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করার রেকর্ড গড়েছেন।

বন্ডি এলাকার ‘এএস বন্ডি ক্লাবে’ শুরু এমবাপের ফুটবল ক্যারিয়ার। এখান থেকেই প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে পৌছে গেছেন বিশ্ব মঞ্চে। আজ তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি বিশ্বের সেরা ফুটবল ক্লাবগুলোর। এখানে তার সাবেক কোচ অ্যান্তোনিও রিকার্ডি একবার বলেছিলেন, ‘আমি তাকে যখন কোচিং করাতে শুরু করি তখন তার বয়স মাত্র ছয় বছর। সে সময় অন্য সব শিশুর চেয়ে এমবাপে অনেক এগিয়ে ছিলো। তার ড্রিবলিং ও গতি ছিলো অসাধারণ। ওই ক্লাবে ১৫ বছর কোচিং করিয়েছি, তার মতো এমন প্রতিভা আর দেখিনি।’

মহল্লার এই ক্লাব থেকে এমবাপে সরাসরি যোগ দেন পেশাদার লিগের ক্লাব মোনাকোতে। ২০১৫ সালে ফ্রান্সের লিগ-১ এর ম্যাচে তার অভিষেক হয় পেশাদার ফুটবলে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ক্লাবটিকে প্রথমবারের মতো লিগ শিরোপা এনে দেন এমবাপে। এক বছর পর ১৮০ মিলিয়ন ইউরো ট্রান্সফার ফিতে যোগ দেন ফ্রান্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মেইতে।

বন্ডির মানুষরা আজ গর্ব করেন এমবাপেকে নিয়ে। তারা বুঝতে শিখেছেন স্বপ্ন থাকলে তা কোন সীমাবদ্ধতাই মানবে না। একদিন ধরা দেবেই হাতে। এমবাপের শৈশবের ক্লাব এএস বন্ডির কিশোর ফুটবলার ১৪ বছর বয়সী ইয়ানিস জ্যাঁ আলজাজিরাকে বলেন, ‘তিনি আমার এই মহল্লা থেকে উঠে এসেছে সেটা ভাবতে গর্ব হয়। আমি একদিন তার মতো হতে চাই।’

এমবাপেও ছিলেন এমন একজন স্বপ্নবাজ তরুণ। শৈশব থেকেই তার বাড়ির দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পোস্টার। সিআরসেভেনকে আদর্শ মেনে এমবাপে বড় হয়েছেন। রোনালদোর মতোই অসাধারণ গতি আর দক্ষতা নিয়ে বেড়ে উঠেছেন। আজ তিনি রোনালদোরই প্রতিদ্বন্দ্বী, রোনালদোকে বিক্রি করে দিয়ে স্পেনের ক্লাব রিয়ালমাদ্রিদ কিনতে চাইছে এমবাপেকে।

শুধু এমবাপে নয়, ফ্রান্সের এবারের বিশ্বকাপ জয়ী দলের মাতুইদি ও কন্তে এই এএস বন্ডি ক্লাব থেকে উঠে এসেছেন। এলাকাটির শিশু, কিশোর, তরুণরা তাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এখান থেকেই বিশ্বমঞ্চে উঠে আসার। ১৭ বছর বয়সী লুতফি বিচারেফ বলেন, ‘কেউ যখন জিজ্ঞেস করে আমি কোন ক্লাবে খেলি- গর্বের সাথে বলি এএস বন্ডির নাম, কারণ এমবাপে এখান থেকেই উঠে এসেছেন। এক নামেই তারা চিনে ফেলে ক্লাবটিকে।

এলএবাংলাটাইমস//এলআরটি