Poetry of Kazi Nazrul Islam in English Translation প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে, নজরুল
ইনস্টিটিউট ঢাকা থেকে। বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১২ তে, চতুর্থ পরিশোধিত
সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১৪ তে। সম্পাদক মুহম্মদ নূরুল হুদা। ১২ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী এবং তাঁর কবিতা-গান-গদ্য ইত্যাদি প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলা
একাডেমী ও নজরুল ইনস্টিটিটের ভ’’’মিকা ও অবদান বর্ণিত হয়েছে । এই সম্পাদকীয় নিবন্ধ
থেকেই আমরা জানতে পারি যে নজরুল ইনস্টিটিউট কাজী নজরুলের হারিয়ে যাওয়া দুটি পাণ্ডুলিপি
উদ্ধার করেছে। সাহিত্যিক উদ্ধার কাজ বিশেষ গৌরব ও তাৎপর্যের। বরিশালের ভূমেন্দ্র গুহ ও
কুষ্টিয়ার আবুল আহসান চৌধুরী এরকম কিছু পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের কাজ করেছেন। শতাধিক বছর
আগে রপ্রুরস্থ ‘রংপুর সাহিত্য পরিষৎ’ সাংগঠনিকভাবে তৎপর হয়ে বিপুলসংখ্যক পাণ্ডুলিপি উদ্ধার ও
সংরক্ষণ কাজ সম্পাদন করেছেন।
Poetry of Kazi Nazrul Islam in English Translation গ্রন্থের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বিনম্র
স্বীকারোক্তির ভাষায় বলা হয়েছে যে এ-পর্যন্ত (২০১৪) মাত্র দু’শ নজরুল-কবিতা ও গানের ইংরেজি
অনুবাদ করা হয়েছে , যে সংখ্যাটি মহান সৃষ্টিপ্রজ ওই কবির প্রায় ৩৫০০ কবিতা ও গানের সংখ্যার
একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ বটে। তবে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে যে আগামী দিনের নজরুল গবেষক ও
অনুবাদগণ এ-কাজে এগিয়ে আসবেন এবং অনুবাদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রাখবেন। এক ভাষার
কবিতা অন্য ভাষায় অনুবাদ করা যাবে কি-না , এ নিয়ে সন্দেহের দোলা আছে। সম্পাদকীয়তে সেই
সন্দেহটির কথাও জানান দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে নজরুলের কবিতা ও গানের শব্দানুষঙ্গ
এবং অন্তঃসলিলাসঙ্গীতপ্রবাহ কোনো অনুবাদকের অনুবাদেই সন্তোষজনকভাবে অনূদিত হয়নি।
সম্পাদক মহোদয় তাঁর বাংলা ইংরেজি উভয় ভাষায় যুগপ পাণ্ডিত্য, পারঙ্গমতা ও নির্মীতির যে স্বাক্ষর
কবিতা, প্রবন্ধ ,অনুবাদ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দান করেছেন এবং ভারত, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, ও
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেভাবে স্বীকৃিতপ্রাপ্ত হয়েছেন তা সত্ত্বেও তিনি সবিনয়ে মেনেছেন যে
একজন শক্তিমান ইংরেজ কবি ব্যতীত নজরলের কবিতা ও গানের সফল ইংরেজি অনুবাদ সম্ভবপর
হতে পারে না। তিনি কোনো হঠকারিতা করতে চান নি, বরং সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ দিক নির্দেশনার ভাষায়
বলেছেন যে, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় ঋদ্ধ ও কবিত্ববোধসম্পন্ন একদল আগ্রহী অনুবাদক যদি
কোনো অভিজ্ঞ ইংরেজ কবির সান্নিধ্যে ও নেতৃত্বে নজরুল কবিতা ও গানের অনুবাদে প্রবৃত্ত হয়, তা
হলেই এমন একটি মহতী উদ্যোগ সফল পরিণতিতে ধন্য হতে পারে।
poetry of Kazi Nazrul Islam in English Translation (Volume One) থেকে নজরুলের
‘বিজয়িনী’ কবিতার মূল পাঠ, আব্দুল হাকিমকৃত ইংরেজি অনুবাদ ও ইংরেজি কবি উইলিয়াম
রাদিচে কৃত অনুবাদের পাঠ পাশাপাশি উপস্থাপন করে আমরা একটি উপলব্ধিতে আসতে পারি।
বিজয়িনীর মূল পাঠ এরকম:
বিজয়িনী
হে মোর রাণী ! তোমার কাছে হার মানি আসিম আজ শেষে।
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে।
আমার সমর- জয়ী অমর তরবারি
দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, হয়ে ওঠে ভারী ,
এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি,
এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে।।
ওগো জীবন-দেবি!
আমায় দেখে কখন ফেল্লে চোখের জল,
আজ বিশ্ব-জয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল
আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে
বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত তূণ আমার আজ তোমার মালায় পূরে,
আমি বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে ।।
আব্দুল হাকিম অনুবাদ করেছেন এরকম:
ONE WHO IS VICTORIOUS
O My Queen! To thee I give the plam
in token of the victory in the end-
My flag of victory now lies at the feet,
My world-conquering immortal Excalibur
Is languishing day by day, and now unwieldy, heavy-
And let me make it over to thee in
acknowledgement of my defeat,
And around thy locks of hair let me
entwine these laurels
O my guardian Angel!
The tears thou didst once shed at my sight
Make today the stupendous citadel of this
world-conqueror totter and tumble
Today on the crest of this rebel’s
blood-red chariot,
Victorious Nymph! there doth fly the
skirt of thy green garment,
All my quiver doth now carry thy garland,
I am victorious today in bursting into a
flood of tears.
উইলিয়াম রাদিচে অনুবাদ করেছেন এরকম:
VICTORESS
O my queen
Today at last I accept defeat
My battle-flag lies at your feet
My immoral sword of victory
Is tired now and heavy.
I cosign to you the weight of it now,
I make my surrender a wreath round your eyes,
O goddess of my life,
When you look at me with tears in your eyes,
Great world-conquering waves seem to roll and rise.
Today in my rebel’s chariot of blood,
you are the ride;
Your fluttering sari has become Heaven’s border;
All my arrows are yours, your garland their quiver
Only by floating in your tears
can I now be a conquerer.
মূল কবিতাটি একটি সমিল কবিতা, অথচ আব্দুল হাকিমের অনুবাদে মিলের কোনো নমুনা নেই।
অর্থের ব্যত্যয় তো আছেই, যেমন; “আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে’ ইংরেজিতে
হয়েছে;
‘My flag of victory now lies at the feet’ GB at the feet, যদি at thy feet’ হতো, মেনে
নিতাম। কিন্তু, at the feet কার চরণ, তা “নির্ণয় ন জানি”। ইংরেজি অনুবাদের শেষ দুলাইনে
আব্দুল হাকিম কর্তৃকারক- কর্মকারক উলটপালট করে ফেলেছেন। তিনি নয়ন জলের মৃদু টলমল
অবস্থাকে বন্যার ঝোড়ো তা-বে রূপান্তর করেছেন।
“All my quiver doth now carry the garland, I am victorious today in bursting into a
flood of tears.” অথচ, সহজ কথাগুলোর সরল ইংরেজি অনুবাদে রাদিচে কত সুস্বাদু ও অনবদ্য;
“All my arrows are yours, your garland their quiver
Only by floating in your tear,
Can I now be a conqueror,
কোনো অনুবাদের মূল বিষয় হচ্ছে, অনুবাদযোগ্য টেক্সটির অনুধাবন- তার অর্থ ও প্রতীকের, শব্দ ও
ইংগিতের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং সবকিছু মিলে একটি Cohesiveness । রাজু আলাউদ্দিনের সাথে
সাক্ষাৎকারে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন,arts bdnews24.com এর সুবাদে
আমরা সেটি পড়েছি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় প্রকাশিত নজরুলীয় কবিসত্তার ‘অচেতন-চিতে চেতন’
সুলভ প্রমত্ততা, উন্মত্ততা, সিজোফ্রেনিয়া লক্ষণাক্রান্ত অগ্লিলাভা উদ্গীরণ– এসব কিছুরই একটি
Method আছে; “There is method in his madness” । এই madnessকে গণ্য করা হয়
উত্তর-আধুনিক সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হিসেবে। মুহম্মদ নূরুল হুদা অন্যত্র এই
সিজোফ্রেনিয়াতুল্য মত্তমাতঙ্গোচ্ছ্বাসের চারিত্র্য ব্যাখ্যা করেছেন। বিশ্বসাহিত্যে আধুিনকবাদের
উন্মেষকাল ধরা হয় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে; কিন্তু নজরুল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দেই আধুনিক কবিতা তো
বটেই, এমন কি উত্তর-আধুনিক, উত্তর উপনিবেশবাদী কবিতা উপহার দিয়েছেন। শুধু বাংলা
ভূখণ্ডের বিবেচনাতেই নয়, বিশ্বসাহিত্য পরিমণ্ডল বিবেচনায় ও নজরুলসাহিত্য অগ্রণী। অথচ,
‘বিদ্রোহী’ অনুবাদ করতে গিয়ে নজরুলের তালিক-বৈতালিক উত্তর-আধুনিক তাৎপর্য অনুধাবনে
অক্ষম সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন নজরুলীয় উপমা-উৎপ্রেক্ষা সমাহারকে Inconsistencies (অসংলগ্নতা)
আখ্যা দিয়েছেন। ‘বিদ্রোহী’তে ভাবের ও ছন্দের উল্লম্ফন আছে, উচ্ছ্বাস ও উদ্ভাস আছে, কিন্তু তাকে
অসংলগ্নতার অভিযোগে অপাংক্তেয় করে দিয়ে ইংরেজি অনুবাদ কাংক্ষিত সৌন্দর্য ও ব্যঞ্জনা লাভ
করবে কোন ভিত্তি থেকে ? তবে, মঙ্গলের কথা এই যে, বিজ্ঞ ও স্বনামধন্য এই অধ্যাপক- শিক্ষক
সবিনয়ে স্বীকার করেছেন তাঁর স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গীর সীমাবদ্ধতা। তিনি পাদটীকায় লিখেছেন,
But I found that a literal rendering would result in rhymes. But I found that a literal
rending would result in a version which would not only fail to convey the superb
beauty of the poem but even expose it to the ridicule of foreign readers not familiar
either with the idiom of the Bengali language or with non-western mythology. I have
therefore pruned away lines which I thought would not translate well and also tried to
avoid the repetitions which would tire the reader’s ear in English. The translation is
consequently slightly shorter than the original. শুধু মহাভারতীয় পুরাণ, গ্রিক পুরাণ, মিশরীয়
পুরাণের অসবর্ণ উচ্চারণে বিব্রত ও বিপন্ন ছিলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, তা-ই নয়, অনুবাদের
প্রাক্কালে তাঁর অবহেলাও কম ছিল না। যেমন, মূল কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ লাইন,
‘আমি তূরীয়ানন্দে ছুটি চলি, একি উন্মাদ! আমি উন্মাদ’ তিনি বাদ দিয়ে গেছেন। কবীর চৌধুরী স্যার
লাইনটির অনুবাদ করেছেন,
Maddened with an intense joy I rush forward,
I am insane ! I am insane!,
‘তূরীয়ানন্দ’ হচ্ছে তূর্যবাদনসহযোগে উদ্যাপিত আনন্দ, সেক্ষেত্রে লাইনটির ইংরেজি অনুবাদ দাঁড়াবেÑ
In rapture with the sound of band I rush forward,
How ecstatic I am! how overwhelmed I am!
‘উন্মাদ’ শব্দটির জন্য কবীর চৌধুরী স্যার অনূদিত Insane শব্দটি এখানে প্রযোজ্য বলে মনে হয় না।
‘বিদ্রোহীর’ পঞ্চম অনুচ্ছেদে আছেÑ
‘আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!’
কবীর চৌধুরী এর ইংরেজি করেছেন,
I am the new youth of dawn’
নজরুলের অরুণ বা ঊষার সূর্য হচ্ছে খুনরাঙা সূর্য, রক্তলাল সূর্য। অধ্যাপক আবুল ফজল-রবীন্দ্রনাথ
পত্রালাপে ‘খুন’ শব্দটির কথা মনে পড়ে এবং রবীন্দ্রনাথ এর অর্থ-মাহাত্ম্য গ্রহণ করেছিলেন, তাও
মনে পড়ে। শব্দটি প্রসঙ্গে নজুরুলের নিজস্ব ব্যাখ্যাও আছে তাঁর প্রবন্ধে। সেক্ষেত্রে ‘আমি অরুণ খুনের
তরুণ’ ও I am the crimson-red youthful sun’ ধরণের একটি তেজীভাবাপন্ন অনুবাদ দাবি করে।
‘বিদ্রোহী’র তৃতীয় অনুচ্ছেদের ‘আমি ভরা তরী করি ভরাডুবি, আমি ভীম ভাসমান মাইন’ এর
অনুবাদ কবীর চৌধুরী বাদ দিয়ে গেছেন। তাঁর অনুবাদে আরো অনেক লাইন, অনেক দৃশ্যকল্প বাদ
পড়ে গেছে। অপর অনুবাদক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনও ‘বিদ্রোহী’র অনেকগুলো লাইন এবং অনুচ্ছেদ
বাদ দিয়েছেন এই যুক্তি দেখিয়ে যে ইংরেজরা ভারতীয় পুরাণ বুঝতে কষ্টবোধ করবে। সাদামাটা
ইংরেজি শব্দ সমাহারে বিদ্রোহীর ভাষান্তর করেছেন সাজেদ কামাল। মূল কবিতার শব্দচয়নে
Assonance, Consonance, alliteration, oxymoron, তাবৎ শব্দশৈলীর যে রূপবদলপ্রবণ Tempo
ও gusto সেসব তঁর অনুবাদে অনুপস্থিত। নজরুল কবিতায় যে শোণিতে সমুদ্রপাত ঘটে, তরঙ্গে
তরঙ্গে ওংকার ওঠে, তা এখানে নেই। এই উপাদানগুলো বরং কিছুটা খোঁজ করে পাওয়া যায়
প্রাচীনদের মধ্যে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের অনুবাদে, অপেক্ষাকৃত পরবর্তীদের মধ্যে মুহম্মদ নুরুল
হুদার অনুবাদে। আব্দুল হাকিম নজরুলের ‘অরুণ খুনের তরুণ’কে বানিয়েছেন ‘Purple dawn’!
আসলে ‘Purple red’ হচ্ছে অস্তায়মান সূর্যের ম্লান-লাল আভা, Oxford Dictionary তাই বলছে।
‘অরুণ খুনের তরুণ’ রক্ত হতে পারে crimson red । সাজেদ কামাল করেছেন I am the youth of
new blood’, সে অনুবাদ আরো ম্যাজম্যাজে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কবি যখন বলেন, ‘বলবীর– চির
উন্নত মম শির’- তখন তিনি নিজের বুকের দিকেই নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলির মাথা ঠেকিয়ে উদ্দেশ করেন
আপন সত্তাকে, আপনাকে। কবিতাটির উদ্বোধনী অনুচ্ছেদের বক্তব্যটি মূলত একটি প্রোলগ্। এর
উপস্থাপনা আধুনিকবাদী কবিতার Super-ego পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে টি.এস.এলিয়ট ১৯১৪
খ্রীস্টাব্দে উপহার দেন তাঁর যুগান্তকারী কবিতা, The love song of J. Alfred Prufrok. সেই
কবিতার প্রারম্ভিক You, আর নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বল শব্দের উহ্য ‘তুমি’–একই
সাহিত্যকৌশলবর্তী। এ ধরণের আঙ্গিকে আমি ও তুমি একই সত্তার এপিঠ ওপিঠ। প্রথম অনুচ্ছেদটি
প্রোলগ্ হিসেবে উপস্থাপনের পর কবি চলে যান আপন সত্তার বহুমুখী উদ্ভাসনে, Dramatic
Monologue পদ্ধতিতে, যে পদ্ধতিতে ভিক্টোরিয়ান কবি রবার্ট ব্রাউনিং তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের পরাকাঠা
প্রদর্শন করেছেন। ‘বিদ্রোহী’র আমি স্বয়ম্ভু সত্তার বাঙময়তা নিয়ে উপস্থিত, যে কণ্ঠস্বরে বহুস্বর আছড়ে
পড়ে। মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁর এক উজ্জ্বল আবিষ্কার প্রবন্ধে ‘বিদ্রোহী’র কন্ঠস্বরকে আখ্যায়িত
করেছেন Polyphonic Voice.তিনি বলেছেন,
“আসলে এই সৃষ্টিবিশ্ব অসংখ্য আমি’র যোগফল হয়ে একটি সামষ্টিক আমি। তাই, আমির মৌলার্থ
যেকোনো সচেতন সত্তা। যা দৃশ্যমান তা হল এই ‘আমি’র বহুরূপতা, যা নানা রূপকে বিভাজিত,
উদ্ভাসিত।”
(আমার মাটির কায়া, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আজমাইন পাবলিকেশন্স্, ঢাকা; ফেব্রুয়ারী ২০১৫)
অথচ, অনুবাদক আব্দুল হাকিম ‘বিদ্রোহী’র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনুবাদ করেছেন They ও Thou–
তুমি সর্বনাম পদ ব্যবহার করে:
Thou art ever indomitable, imperious and cruel,
Thou art the chief actor of Annihilation,
Thou art cyclone, thou art destruction
Thou art the Dread, the curse of the world
নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘কামালপাশা’ ও ‘আনোয়ার’-এর ইংরেজি করেছেন মুহম্মদ নূরুল হুদা।
অনুবাদের ভাষায় মূলের অর্থ, ভাব, ব্যঞ্জনা ও গতি একই সাথে ধারণ করার পাশাপাশি Lyrical
Qualityও সার্থকভাবে ধারণ ও উপস্থাপন করেছেন তিনি। মুহম্মদ নূরুল হুদা বাংলা ও ইংরেজি উভয়
ভাষায় কাব্যচর্চা করছেন। তিনি কবিতার শিক্ষকও। অনুবাদের শিক্ষাও তাঁর কাছে পেয়েছি আমরা।
‘কামালপাশা’ কবিতায় তুর্কী নায়ক মোস্তফা কামালকে অভিনন্দন জানানোর যে আবেগসঞ্জাত
উচ্চারণ নজরুলের ভাষায় আছে, মুহম্মদ নূরুল হুদার ইংরেজি অনুবাদে তা-ই পাওয়া যায়;
কামাল, তুনে কামাল কিয়া ভাই!
হো হো কামাল, তুনে কামাল কিয়া ভাই!
এর ইংরেজি তিনি করেছেন–
Kamal, what a wonder you’ve worked!
Ho Ho Kamal, what a wonder you’ve worked!
কবিতাটি মধ্যপর্যায়ে,
ইস্! দেখেছিস্! ঐ কারা ভাই সাম্লে চলেন পা,
ফস্কে মরা আধ-মরাদের মাড়িয়ে ফেলেন বা!
ও তাই শিউড়ে উঠে গা!
হাঃ হাঃ হাঃ !
মরলো যে সে মরেই গেছে,
বাঁচলো যারা রইল বেঁচে।
এই তো জানি সোজা হিসাব! দুঃখ কি আর আঁঃ?
মরায় দেখে ডরায় এরা! ভয় কি মরায়? বাঃ।
হাঃ হাঃ হাঃ
মুহম্মদ নূরুল হুদা’র ইংরেজি অনুবাদ,
Look around! make steps with caution
lest you trample the dead in your motion!
We shiver seeing the dead
Ha Ha Ha!
Those who have died are, indeed, dead.
The survivors live well and fed
That’s the simple equation we know, why sorry?
They fear seeing the dead. Don’t get lost, don’t worry.
Ha Ha Ha
এই অনুবাদটিতে মূল কবিতার অর্থ, ছন্দ, ব্যঞ্জনা ও গতিবেগ– সবই এসেছে বলে আমার প্রতীতি।
মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁর ‘বুদ্ধদেব বসুর কাব্যানুবাদ প্রসঙ্গে’ নামক প্রবন্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের
পাশাপাশি আর একটি কথা বলেছেন তা হলো: “মূল রচয়িতা বাণীর পাশাপাশি কী অভিপ্রায় ব্যক্ত
করতে চেয়েছিলেন,” সে সম্পর্কে সম্যক ধারণায় পৌঁছতে হবে অনুবাদককে। “কোনো শব্দ বা
বাক্যের অর্থ অস্পষ্ট রেখে এই পর্যায়টি অতিক্রম করা যাবে না, তাহলে গোড়ায় গলদ থেকে যাবে।
…. আক্ষরিক অনুবাদের পাশাপাশি প্রতিি বাক্য ও অনুচ্ছেদের মধ্যে যে অর্থসঙ্গতি আছে তারও
সতর্ক অন্তর্বয়ন অতি জরুরি। তা না হলে পুরো টেক্সটি খাপছাড়া হয়ে যেতে পারে।” (নজরুলের
শিল্পসিদ্ধি ও বিদ্রোহী; মুহম্মদ নূরুল হুদা; আজমাইন পাবলিকেশনস্, ঢাকা ২০১৫)
‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার ইংরেজি অনুবাদে কবীর চৌধুরী স্যার সমিল শব্দের ব্যবহার করেছেন।
মিলাত্মক শব্দ উপহার দেওয়ার কারণে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ পড়তে গিয়ে একটি সাংগীতিক
অনুরণন উপলদ্ধি করা যায়। যেমন,
দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুশিয়ার।
এর অনুবাদ হয়েছে,
You have to cross in the darkness of the night
A desert vast and a hill of great height,
And an ocean, fathomless and dark
Travelers beware and look sharp.
খুব গীতল ও প্রাণোচ্ছ্বল ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেরও, যেখানে মূল বাংলায় আছেÑ
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া ওঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।
ইরেজিতে-
Age-old grievances have declared a fight,
The deprived heart is demanding its right,
Your must take them along, the poor and the weak,
You must make them strong, no longer mild and meek,
এখানে মধ্যমিল, অন্ত্যমিল দুটোই আছে। কিন্তু, শুরুর দিকে, দুস্তর পারাবারের বাংলা অর্থ যেখানে
সুপ্রশস্ত সমুদ্র, দৈর্ঘ-প্রস্থের দিক থেকে অনতিক্রম্য সেখানে কবীর স্যার ইংরেজি অনুবাদে an
ocean, fathomless and dark করলেন, সমুদ্রের গভীরতা বিবেচনায় নিলেন কেন, তা বুঝতে
পারলাম না।
আমি ‘বিদ্রোহী’ অনুবাদকগণের প্রতি পরম শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। সেই সাথে আশাবাদ ব্যক্ত করছি
যে, এই বিখ্যাত কবিতাটি সহ নজরুলের জনপ্রিয় অন্য কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদে
সাহিত্যসক্ষম সুধীজন প্রত্যেকেই এগিয়ে আসবেন। আমার মনে আছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা, ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বইমেলার উদ্বোধনী ভাষণে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কর্মসমূহে ইংরেজি
অনুবাদ বিষয়ে তাগিদ উচ্চারণ করেছিলেন। নজরুল সাহিত্যের যে অনুবাদ গ্রন্থটি নজরুল
ইনস্টিটিউট পূর্বাহ্নেই করেছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। গ্রন্থটি কালে কালে বৃহত্তর ও
ঋদ্ধতর হতে থাকবে– এটাই প্রত্যাশা। আগামীতে বাংলা একাডেমীসহ আরো অন্যান্য সাংগঠন-
প্রতিষ্ঠান অনুবাদের মহতীকর্মে ব্রতী হবেন এবং বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব ও আধুনিকতার সংবাদ সারা
বিশ্বে প্রচারের দায়িত্ব পালন করবেন, কাম্য সেটাই। সেক্ষেত্রে বিশ্ববাসী জানবে যে একুশে ও
একাত্তরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি উচ্চারণে সক্ষম।
ইনস্টিটিউট ঢাকা থেকে। বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১২ তে, চতুর্থ পরিশোধিত
সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১৪ তে। সম্পাদক মুহম্মদ নূরুল হুদা। ১২ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী এবং তাঁর কবিতা-গান-গদ্য ইত্যাদি প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলা
একাডেমী ও নজরুল ইনস্টিটিটের ভ’’’মিকা ও অবদান বর্ণিত হয়েছে । এই সম্পাদকীয় নিবন্ধ
থেকেই আমরা জানতে পারি যে নজরুল ইনস্টিটিউট কাজী নজরুলের হারিয়ে যাওয়া দুটি পাণ্ডুলিপি
উদ্ধার করেছে। সাহিত্যিক উদ্ধার কাজ বিশেষ গৌরব ও তাৎপর্যের। বরিশালের ভূমেন্দ্র গুহ ও
কুষ্টিয়ার আবুল আহসান চৌধুরী এরকম কিছু পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের কাজ করেছেন। শতাধিক বছর
আগে রপ্রুরস্থ ‘রংপুর সাহিত্য পরিষৎ’ সাংগঠনিকভাবে তৎপর হয়ে বিপুলসংখ্যক পাণ্ডুলিপি উদ্ধার ও
সংরক্ষণ কাজ সম্পাদন করেছেন।
Poetry of Kazi Nazrul Islam in English Translation গ্রন্থের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বিনম্র
স্বীকারোক্তির ভাষায় বলা হয়েছে যে এ-পর্যন্ত (২০১৪) মাত্র দু’শ নজরুল-কবিতা ও গানের ইংরেজি
অনুবাদ করা হয়েছে , যে সংখ্যাটি মহান সৃষ্টিপ্রজ ওই কবির প্রায় ৩৫০০ কবিতা ও গানের সংখ্যার
একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ বটে। তবে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে যে আগামী দিনের নজরুল গবেষক ও
অনুবাদগণ এ-কাজে এগিয়ে আসবেন এবং অনুবাদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রাখবেন। এক ভাষার
কবিতা অন্য ভাষায় অনুবাদ করা যাবে কি-না , এ নিয়ে সন্দেহের দোলা আছে। সম্পাদকীয়তে সেই
সন্দেহটির কথাও জানান দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে নজরুলের কবিতা ও গানের শব্দানুষঙ্গ
এবং অন্তঃসলিলাসঙ্গীতপ্রবাহ কোনো অনুবাদকের অনুবাদেই সন্তোষজনকভাবে অনূদিত হয়নি।
সম্পাদক মহোদয় তাঁর বাংলা ইংরেজি উভয় ভাষায় যুগপ পাণ্ডিত্য, পারঙ্গমতা ও নির্মীতির যে স্বাক্ষর
কবিতা, প্রবন্ধ ,অনুবাদ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দান করেছেন এবং ভারত, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, ও
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেভাবে স্বীকৃিতপ্রাপ্ত হয়েছেন তা সত্ত্বেও তিনি সবিনয়ে মেনেছেন যে
একজন শক্তিমান ইংরেজ কবি ব্যতীত নজরলের কবিতা ও গানের সফল ইংরেজি অনুবাদ সম্ভবপর
হতে পারে না। তিনি কোনো হঠকারিতা করতে চান নি, বরং সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ দিক নির্দেশনার ভাষায়
বলেছেন যে, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় ঋদ্ধ ও কবিত্ববোধসম্পন্ন একদল আগ্রহী অনুবাদক যদি
কোনো অভিজ্ঞ ইংরেজ কবির সান্নিধ্যে ও নেতৃত্বে নজরুল কবিতা ও গানের অনুবাদে প্রবৃত্ত হয়, তা
হলেই এমন একটি মহতী উদ্যোগ সফল পরিণতিতে ধন্য হতে পারে।
poetry of Kazi Nazrul Islam in English Translation (Volume One) থেকে নজরুলের
‘বিজয়িনী’ কবিতার মূল পাঠ, আব্দুল হাকিমকৃত ইংরেজি অনুবাদ ও ইংরেজি কবি উইলিয়াম
রাদিচে কৃত অনুবাদের পাঠ পাশাপাশি উপস্থাপন করে আমরা একটি উপলব্ধিতে আসতে পারি।
বিজয়িনীর মূল পাঠ এরকম:
বিজয়িনী
হে মোর রাণী ! তোমার কাছে হার মানি আসিম আজ শেষে।
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে।
আমার সমর- জয়ী অমর তরবারি
দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, হয়ে ওঠে ভারী ,
এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি,
এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে।।
ওগো জীবন-দেবি!
আমায় দেখে কখন ফেল্লে চোখের জল,
আজ বিশ্ব-জয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল
আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে
বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত তূণ আমার আজ তোমার মালায় পূরে,
আমি বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে ।।
আব্দুল হাকিম অনুবাদ করেছেন এরকম:
ONE WHO IS VICTORIOUS
O My Queen! To thee I give the plam
in token of the victory in the end-
My flag of victory now lies at the feet,
My world-conquering immortal Excalibur
Is languishing day by day, and now unwieldy, heavy-
And let me make it over to thee in
acknowledgement of my defeat,
And around thy locks of hair let me
entwine these laurels
O my guardian Angel!
The tears thou didst once shed at my sight
Make today the stupendous citadel of this
world-conqueror totter and tumble
Today on the crest of this rebel’s
blood-red chariot,
Victorious Nymph! there doth fly the
skirt of thy green garment,
All my quiver doth now carry thy garland,
I am victorious today in bursting into a
flood of tears.
উইলিয়াম রাদিচে অনুবাদ করেছেন এরকম:
VICTORESS
O my queen
Today at last I accept defeat
My battle-flag lies at your feet
My immoral sword of victory
Is tired now and heavy.
I cosign to you the weight of it now,
I make my surrender a wreath round your eyes,
O goddess of my life,
When you look at me with tears in your eyes,
Great world-conquering waves seem to roll and rise.
Today in my rebel’s chariot of blood,
you are the ride;
Your fluttering sari has become Heaven’s border;
All my arrows are yours, your garland their quiver
Only by floating in your tears
can I now be a conquerer.
মূল কবিতাটি একটি সমিল কবিতা, অথচ আব্দুল হাকিমের অনুবাদে মিলের কোনো নমুনা নেই।
অর্থের ব্যত্যয় তো আছেই, যেমন; “আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে’ ইংরেজিতে
হয়েছে;
‘My flag of victory now lies at the feet’ GB at the feet, যদি at thy feet’ হতো, মেনে
নিতাম। কিন্তু, at the feet কার চরণ, তা “নির্ণয় ন জানি”। ইংরেজি অনুবাদের শেষ দুলাইনে
আব্দুল হাকিম কর্তৃকারক- কর্মকারক উলটপালট করে ফেলেছেন। তিনি নয়ন জলের মৃদু টলমল
অবস্থাকে বন্যার ঝোড়ো তা-বে রূপান্তর করেছেন।
“All my quiver doth now carry the garland, I am victorious today in bursting into a
flood of tears.” অথচ, সহজ কথাগুলোর সরল ইংরেজি অনুবাদে রাদিচে কত সুস্বাদু ও অনবদ্য;
“All my arrows are yours, your garland their quiver
Only by floating in your tear,
Can I now be a conqueror,
কোনো অনুবাদের মূল বিষয় হচ্ছে, অনুবাদযোগ্য টেক্সটির অনুধাবন- তার অর্থ ও প্রতীকের, শব্দ ও
ইংগিতের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং সবকিছু মিলে একটি Cohesiveness । রাজু আলাউদ্দিনের সাথে
সাক্ষাৎকারে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন,arts bdnews24.com এর সুবাদে
আমরা সেটি পড়েছি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় প্রকাশিত নজরুলীয় কবিসত্তার ‘অচেতন-চিতে চেতন’
সুলভ প্রমত্ততা, উন্মত্ততা, সিজোফ্রেনিয়া লক্ষণাক্রান্ত অগ্লিলাভা উদ্গীরণ– এসব কিছুরই একটি
Method আছে; “There is method in his madness” । এই madnessকে গণ্য করা হয়
উত্তর-আধুনিক সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হিসেবে। মুহম্মদ নূরুল হুদা অন্যত্র এই
সিজোফ্রেনিয়াতুল্য মত্তমাতঙ্গোচ্ছ্বাসের চারিত্র্য ব্যাখ্যা করেছেন। বিশ্বসাহিত্যে আধুিনকবাদের
উন্মেষকাল ধরা হয় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে; কিন্তু নজরুল ১৯২১ খ্রিস্টাব্দেই আধুনিক কবিতা তো
বটেই, এমন কি উত্তর-আধুনিক, উত্তর উপনিবেশবাদী কবিতা উপহার দিয়েছেন। শুধু বাংলা
ভূখণ্ডের বিবেচনাতেই নয়, বিশ্বসাহিত্য পরিমণ্ডল বিবেচনায় ও নজরুলসাহিত্য অগ্রণী। অথচ,
‘বিদ্রোহী’ অনুবাদ করতে গিয়ে নজরুলের তালিক-বৈতালিক উত্তর-আধুনিক তাৎপর্য অনুধাবনে
অক্ষম সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন নজরুলীয় উপমা-উৎপ্রেক্ষা সমাহারকে Inconsistencies (অসংলগ্নতা)
আখ্যা দিয়েছেন। ‘বিদ্রোহী’তে ভাবের ও ছন্দের উল্লম্ফন আছে, উচ্ছ্বাস ও উদ্ভাস আছে, কিন্তু তাকে
অসংলগ্নতার অভিযোগে অপাংক্তেয় করে দিয়ে ইংরেজি অনুবাদ কাংক্ষিত সৌন্দর্য ও ব্যঞ্জনা লাভ
করবে কোন ভিত্তি থেকে ? তবে, মঙ্গলের কথা এই যে, বিজ্ঞ ও স্বনামধন্য এই অধ্যাপক- শিক্ষক
সবিনয়ে স্বীকার করেছেন তাঁর স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গীর সীমাবদ্ধতা। তিনি পাদটীকায় লিখেছেন,
But I found that a literal rendering would result in rhymes. But I found that a literal
rending would result in a version which would not only fail to convey the superb
beauty of the poem but even expose it to the ridicule of foreign readers not familiar
either with the idiom of the Bengali language or with non-western mythology. I have
therefore pruned away lines which I thought would not translate well and also tried to
avoid the repetitions which would tire the reader’s ear in English. The translation is
consequently slightly shorter than the original. শুধু মহাভারতীয় পুরাণ, গ্রিক পুরাণ, মিশরীয়
পুরাণের অসবর্ণ উচ্চারণে বিব্রত ও বিপন্ন ছিলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, তা-ই নয়, অনুবাদের
প্রাক্কালে তাঁর অবহেলাও কম ছিল না। যেমন, মূল কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ লাইন,
‘আমি তূরীয়ানন্দে ছুটি চলি, একি উন্মাদ! আমি উন্মাদ’ তিনি বাদ দিয়ে গেছেন। কবীর চৌধুরী স্যার
লাইনটির অনুবাদ করেছেন,
Maddened with an intense joy I rush forward,
I am insane ! I am insane!,
‘তূরীয়ানন্দ’ হচ্ছে তূর্যবাদনসহযোগে উদ্যাপিত আনন্দ, সেক্ষেত্রে লাইনটির ইংরেজি অনুবাদ দাঁড়াবেÑ
In rapture with the sound of band I rush forward,
How ecstatic I am! how overwhelmed I am!
‘উন্মাদ’ শব্দটির জন্য কবীর চৌধুরী স্যার অনূদিত Insane শব্দটি এখানে প্রযোজ্য বলে মনে হয় না।
‘বিদ্রোহীর’ পঞ্চম অনুচ্ছেদে আছেÑ
‘আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!’
কবীর চৌধুরী এর ইংরেজি করেছেন,
I am the new youth of dawn’
নজরুলের অরুণ বা ঊষার সূর্য হচ্ছে খুনরাঙা সূর্য, রক্তলাল সূর্য। অধ্যাপক আবুল ফজল-রবীন্দ্রনাথ
পত্রালাপে ‘খুন’ শব্দটির কথা মনে পড়ে এবং রবীন্দ্রনাথ এর অর্থ-মাহাত্ম্য গ্রহণ করেছিলেন, তাও
মনে পড়ে। শব্দটি প্রসঙ্গে নজুরুলের নিজস্ব ব্যাখ্যাও আছে তাঁর প্রবন্ধে। সেক্ষেত্রে ‘আমি অরুণ খুনের
তরুণ’ ও I am the crimson-red youthful sun’ ধরণের একটি তেজীভাবাপন্ন অনুবাদ দাবি করে।
‘বিদ্রোহী’র তৃতীয় অনুচ্ছেদের ‘আমি ভরা তরী করি ভরাডুবি, আমি ভীম ভাসমান মাইন’ এর
অনুবাদ কবীর চৌধুরী বাদ দিয়ে গেছেন। তাঁর অনুবাদে আরো অনেক লাইন, অনেক দৃশ্যকল্প বাদ
পড়ে গেছে। অপর অনুবাদক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনও ‘বিদ্রোহী’র অনেকগুলো লাইন এবং অনুচ্ছেদ
বাদ দিয়েছেন এই যুক্তি দেখিয়ে যে ইংরেজরা ভারতীয় পুরাণ বুঝতে কষ্টবোধ করবে। সাদামাটা
ইংরেজি শব্দ সমাহারে বিদ্রোহীর ভাষান্তর করেছেন সাজেদ কামাল। মূল কবিতার শব্দচয়নে
Assonance, Consonance, alliteration, oxymoron, তাবৎ শব্দশৈলীর যে রূপবদলপ্রবণ Tempo
ও gusto সেসব তঁর অনুবাদে অনুপস্থিত। নজরুল কবিতায় যে শোণিতে সমুদ্রপাত ঘটে, তরঙ্গে
তরঙ্গে ওংকার ওঠে, তা এখানে নেই। এই উপাদানগুলো বরং কিছুটা খোঁজ করে পাওয়া যায়
প্রাচীনদের মধ্যে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের অনুবাদে, অপেক্ষাকৃত পরবর্তীদের মধ্যে মুহম্মদ নুরুল
হুদার অনুবাদে। আব্দুল হাকিম নজরুলের ‘অরুণ খুনের তরুণ’কে বানিয়েছেন ‘Purple dawn’!
আসলে ‘Purple red’ হচ্ছে অস্তায়মান সূর্যের ম্লান-লাল আভা, Oxford Dictionary তাই বলছে।
‘অরুণ খুনের তরুণ’ রক্ত হতে পারে crimson red । সাজেদ কামাল করেছেন I am the youth of
new blood’, সে অনুবাদ আরো ম্যাজম্যাজে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার কবি যখন বলেন, ‘বলবীর– চির
উন্নত মম শির’- তখন তিনি নিজের বুকের দিকেই নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলির মাথা ঠেকিয়ে উদ্দেশ করেন
আপন সত্তাকে, আপনাকে। কবিতাটির উদ্বোধনী অনুচ্ছেদের বক্তব্যটি মূলত একটি প্রোলগ্। এর
উপস্থাপনা আধুনিকবাদী কবিতার Super-ego পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে টি.এস.এলিয়ট ১৯১৪
খ্রীস্টাব্দে উপহার দেন তাঁর যুগান্তকারী কবিতা, The love song of J. Alfred Prufrok. সেই
কবিতার প্রারম্ভিক You, আর নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বল শব্দের উহ্য ‘তুমি’–একই
সাহিত্যকৌশলবর্তী। এ ধরণের আঙ্গিকে আমি ও তুমি একই সত্তার এপিঠ ওপিঠ। প্রথম অনুচ্ছেদটি
প্রোলগ্ হিসেবে উপস্থাপনের পর কবি চলে যান আপন সত্তার বহুমুখী উদ্ভাসনে, Dramatic
Monologue পদ্ধতিতে, যে পদ্ধতিতে ভিক্টোরিয়ান কবি রবার্ট ব্রাউনিং তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের পরাকাঠা
প্রদর্শন করেছেন। ‘বিদ্রোহী’র আমি স্বয়ম্ভু সত্তার বাঙময়তা নিয়ে উপস্থিত, যে কণ্ঠস্বরে বহুস্বর আছড়ে
পড়ে। মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁর এক উজ্জ্বল আবিষ্কার প্রবন্ধে ‘বিদ্রোহী’র কন্ঠস্বরকে আখ্যায়িত
করেছেন Polyphonic Voice.তিনি বলেছেন,
“আসলে এই সৃষ্টিবিশ্ব অসংখ্য আমি’র যোগফল হয়ে একটি সামষ্টিক আমি। তাই, আমির মৌলার্থ
যেকোনো সচেতন সত্তা। যা দৃশ্যমান তা হল এই ‘আমি’র বহুরূপতা, যা নানা রূপকে বিভাজিত,
উদ্ভাসিত।”
(আমার মাটির কায়া, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আজমাইন পাবলিকেশন্স্, ঢাকা; ফেব্রুয়ারী ২০১৫)
অথচ, অনুবাদক আব্দুল হাকিম ‘বিদ্রোহী’র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনুবাদ করেছেন They ও Thou–
তুমি সর্বনাম পদ ব্যবহার করে:
Thou art ever indomitable, imperious and cruel,
Thou art the chief actor of Annihilation,
Thou art cyclone, thou art destruction
Thou art the Dread, the curse of the world
নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘কামালপাশা’ ও ‘আনোয়ার’-এর ইংরেজি করেছেন মুহম্মদ নূরুল হুদা।
অনুবাদের ভাষায় মূলের অর্থ, ভাব, ব্যঞ্জনা ও গতি একই সাথে ধারণ করার পাশাপাশি Lyrical
Qualityও সার্থকভাবে ধারণ ও উপস্থাপন করেছেন তিনি। মুহম্মদ নূরুল হুদা বাংলা ও ইংরেজি উভয়
ভাষায় কাব্যচর্চা করছেন। তিনি কবিতার শিক্ষকও। অনুবাদের শিক্ষাও তাঁর কাছে পেয়েছি আমরা।
‘কামালপাশা’ কবিতায় তুর্কী নায়ক মোস্তফা কামালকে অভিনন্দন জানানোর যে আবেগসঞ্জাত
উচ্চারণ নজরুলের ভাষায় আছে, মুহম্মদ নূরুল হুদার ইংরেজি অনুবাদে তা-ই পাওয়া যায়;
কামাল, তুনে কামাল কিয়া ভাই!
হো হো কামাল, তুনে কামাল কিয়া ভাই!
এর ইংরেজি তিনি করেছেন–
Kamal, what a wonder you’ve worked!
Ho Ho Kamal, what a wonder you’ve worked!
কবিতাটি মধ্যপর্যায়ে,
ইস্! দেখেছিস্! ঐ কারা ভাই সাম্লে চলেন পা,
ফস্কে মরা আধ-মরাদের মাড়িয়ে ফেলেন বা!
ও তাই শিউড়ে উঠে গা!
হাঃ হাঃ হাঃ !
মরলো যে সে মরেই গেছে,
বাঁচলো যারা রইল বেঁচে।
এই তো জানি সোজা হিসাব! দুঃখ কি আর আঁঃ?
মরায় দেখে ডরায় এরা! ভয় কি মরায়? বাঃ।
হাঃ হাঃ হাঃ
মুহম্মদ নূরুল হুদা’র ইংরেজি অনুবাদ,
Look around! make steps with caution
lest you trample the dead in your motion!
We shiver seeing the dead
Ha Ha Ha!
Those who have died are, indeed, dead.
The survivors live well and fed
That’s the simple equation we know, why sorry?
They fear seeing the dead. Don’t get lost, don’t worry.
Ha Ha Ha
এই অনুবাদটিতে মূল কবিতার অর্থ, ছন্দ, ব্যঞ্জনা ও গতিবেগ– সবই এসেছে বলে আমার প্রতীতি।
মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁর ‘বুদ্ধদেব বসুর কাব্যানুবাদ প্রসঙ্গে’ নামক প্রবন্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের
পাশাপাশি আর একটি কথা বলেছেন তা হলো: “মূল রচয়িতা বাণীর পাশাপাশি কী অভিপ্রায় ব্যক্ত
করতে চেয়েছিলেন,” সে সম্পর্কে সম্যক ধারণায় পৌঁছতে হবে অনুবাদককে। “কোনো শব্দ বা
বাক্যের অর্থ অস্পষ্ট রেখে এই পর্যায়টি অতিক্রম করা যাবে না, তাহলে গোড়ায় গলদ থেকে যাবে।
…. আক্ষরিক অনুবাদের পাশাপাশি প্রতিি বাক্য ও অনুচ্ছেদের মধ্যে যে অর্থসঙ্গতি আছে তারও
সতর্ক অন্তর্বয়ন অতি জরুরি। তা না হলে পুরো টেক্সটি খাপছাড়া হয়ে যেতে পারে।” (নজরুলের
শিল্পসিদ্ধি ও বিদ্রোহী; মুহম্মদ নূরুল হুদা; আজমাইন পাবলিকেশনস্, ঢাকা ২০১৫)
‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতার ইংরেজি অনুবাদে কবীর চৌধুরী স্যার সমিল শব্দের ব্যবহার করেছেন।
মিলাত্মক শব্দ উপহার দেওয়ার কারণে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ পড়তে গিয়ে একটি সাংগীতিক
অনুরণন উপলদ্ধি করা যায়। যেমন,
দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুশিয়ার।
এর অনুবাদ হয়েছে,
You have to cross in the darkness of the night
A desert vast and a hill of great height,
And an ocean, fathomless and dark
Travelers beware and look sharp.
খুব গীতল ও প্রাণোচ্ছ্বল ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেরও, যেখানে মূল বাংলায় আছেÑ
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া ওঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।
ইরেজিতে-
Age-old grievances have declared a fight,
The deprived heart is demanding its right,
Your must take them along, the poor and the weak,
You must make them strong, no longer mild and meek,
এখানে মধ্যমিল, অন্ত্যমিল দুটোই আছে। কিন্তু, শুরুর দিকে, দুস্তর পারাবারের বাংলা অর্থ যেখানে
সুপ্রশস্ত সমুদ্র, দৈর্ঘ-প্রস্থের দিক থেকে অনতিক্রম্য সেখানে কবীর স্যার ইংরেজি অনুবাদে an
ocean, fathomless and dark করলেন, সমুদ্রের গভীরতা বিবেচনায় নিলেন কেন, তা বুঝতে
পারলাম না।
আমি ‘বিদ্রোহী’ অনুবাদকগণের প্রতি পরম শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। সেই সাথে আশাবাদ ব্যক্ত করছি
যে, এই বিখ্যাত কবিতাটি সহ নজরুলের জনপ্রিয় অন্য কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদে
সাহিত্যসক্ষম সুধীজন প্রত্যেকেই এগিয়ে আসবেন। আমার মনে আছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা, ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বইমেলার উদ্বোধনী ভাষণে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কর্মসমূহে ইংরেজি
অনুবাদ বিষয়ে তাগিদ উচ্চারণ করেছিলেন। নজরুল সাহিত্যের যে অনুবাদ গ্রন্থটি নজরুল
ইনস্টিটিউট পূর্বাহ্নেই করেছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। গ্রন্থটি কালে কালে বৃহত্তর ও
ঋদ্ধতর হতে থাকবে– এটাই প্রত্যাশা। আগামীতে বাংলা একাডেমীসহ আরো অন্যান্য সাংগঠন-
প্রতিষ্ঠান অনুবাদের মহতীকর্মে ব্রতী হবেন এবং বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব ও আধুনিকতার সংবাদ সারা
বিশ্বে প্রচারের দায়িত্ব পালন করবেন, কাম্য সেটাই। সেক্ষেত্রে বিশ্ববাসী জানবে যে একুশে ও
একাত্তরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি উচ্চারণে সক্ষম।