বাংলাদেশ

কি আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, আর কি পেলাম!

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বাদীর জেরা গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এ অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেরার এক পর্যায়ে আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার বলেন, কি আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, আর কি পেলাম তার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। মামলার বাদী দুদকের উপ-পরিচালক হারুন-অর-রশিদকে জেরার এক পর্যায়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনকে তিনি একথা বলেন। এর আগে খন্দকার মাহবুব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের আগে দায়ের করা দুর্নীতির মামলাগুলোর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। দুদকের আইনজীবী এ বিষয়ে আপত্তি তুললে খন্দকার মাহবুব ওয়ান ইলেভেনের আগে রাজপথে মানুষ পিটিয়ে হত্যা মামলার চার্জশীটের বিষয়টি অবতারণা করেন। তখন বিচারক বলেন, চ্যারিটেবল মামলার সঙ্গে এর কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। এরপর খন্দকার মাহবুব আদালতকে বলেন, তাহলে কি আরো দুর্নীতি মামলার তথ্য দরকার? এ পর্যায়ে বিচারক বলেন, ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত যত দুর্নীতির মামলা রয়েছে সেগুলোর তথ্য দিন, শ্বেতপত্র প্রকাশ করি।
 
 এর আগে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বাদীর কাছে জানতে চান যে, এই মামলায় খালেদা জিয়া সরকারি কোন অর্থ আত্মসাত্ বা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন কিনা? জবাবে হারুন-অর-রশিদ আদালতে বলেন, ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন অবৈধ উপায়ে এই ট্রাস্টের অর্থ সংগ্রহ করেছেন। এখানে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কোন মামলা করা হয়নি। প্রায় দেড় ঘণ্টা জেরার পর তা মুলতুবির আবেদন জানান খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। পরে আদালত ৩ আগস্ট অসমাপ্ত জেরা সম্পন্ন করার জন্য দিন ধার্য করে দেন। এর আগে সকাল পৌনে ১০টায় পুরান ঢাকার বকশিবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ প্রাঙ্গণে হাজির হন খালেদা জিয়া। প্রায় ১৫ মিনিট পর তিনি আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন। এরপরই বিচারক আবু আহমেদ জমাদার এজলাসে আসেন। এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী এম মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বাদীর সাক্ষ্য বাতিলের আবেদন খারিজ সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশের সার্টিফায়েড কপি পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেলে লিভ টু আপিল দায়ের করা হবে। এজন্য এ মামলার কার্যক্রম মুলতবির আবেদন জানাচ্ছি। আদালত বলেন, আবেদনটি নথিভুক্ত থাক। এরপর আদালত জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বাদিকে জেরার জন্য খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের নির্দেশ দেন।
 
বাদীকে আসামি পক্ষের জেরা
 খন্দকার মাহবুব: আপনি (বাদী) এজাহারে লিখলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে খালেদা জিয়া ট্রাস্টের অর্থ সংগ্রহ করেছেন, এটা কি অনুমানের ভিত্তিতে বলেছেন? বাদী (হারুন-অর-রশিদ): দালিলিক প্রমাণ আছে। খন্দকার মাহবুব: কি ধরনের দালিলিক প্রমাণ আছে? বাদী: এ সংক্রান্ত আলামত আদালতে দাখিল করেছি। খন্দকার মাহবুব: খালেদা জিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে টাকা নিয়েছেন আপনার এ বক্তব্যের ভিত্তি কি? বাদী: ভিত্তি আছে। খন্দকার মাহবুব: অভিযোগকারীর নাম বলুন; তাকে কি সাক্ষী করেছেন? বাদী: ডা. ফারজানা আহমেদ নামে একজন অভিযোগকারী অভিযোগ করেছেন। তাকে সাক্ষী করিনি। খন্দকার মাহবুব বাদির উদ্দেশে বলেন, ফারজানা হক নামে কেউ নেই। এটা আপনার কল্পনাপ্রসূত। মামলার স্বার্থে কাঠগড়ায় উঠে অসত্য কথা বলছেন। এ পর্যায়ে আদালত খন্দকার মাহবুবের উদ্দেশে বলেন, আইনে অভিযোগকারীর নাম গোপন রাখার বিধান রয়েছে। বাদী: এটা সত্য নয়। খন্দকার মাহবুব: ট্রাস্টে বাইরে থেকে কেউ অনুদান দিতে পারবে না- আইনে এরকম কিছু আছে কি? বাদী: নেই। তবে সীমাবদ্ধতা আছে। ৫ লাখ টাকা দিয়ে সদস্য হতে পারে; কিন্তু এরকম কাউকে পাইনি। খন্দকার মাহবুব: শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতিকে ধরে রাখার উদ্দেশে এই ট্রাস্ট করা হয়েছিলো। বাদী: সত্য নয়।
 
‘শ্বেতপত্র প্রকাশ করি
 খন্দকার মাহবুব: ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি দুর্নীতির মামলা হয়েছিলো? বাদী: মামলা হয়েছিলো, তবে কতটি হয়েছিলো জানি না। খন্দকার মাহবুব: মিগ-২৯, বেপজা, নভো থিয়েটার, নাইকো মামলায় তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছিলো? বাদী: জানা নেই। এ পর্যায়ে দুদক কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এই মামলার সঙ্গে এসব জেরার প্রাসঙ্গিকতা কি? বাদী তো এ বিষয়ে কিছু জানেও না। খন্দকার মাহবুব: যখন যে ক্ষমতায় থাকে তখন দুদক ইচ্ছে অনুযায়ী মামলা থেকে বাদ দেয়, আবার ক্ষমতায় না থাকলে কিভাবে আরেকজনকে ভিকটিমাইজ করে সেটাই তুলে ধরছি। বিচারক বলেন, ৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত যত দুর্নীতির মামলা রয়েছে সেগুলোর তথ্য দিন, শ্বেতপত্র প্রকাশ করি।
 
‘ওই ব্যাটা চুপ কর’
 দেড় ঘণ্টা জেরার পর সময় চেয়ে আবেদন জানান খালেদা জিয়ার আইনজীবী এম মাহবুবউদ্দিন খোকন। আদালত সময় মঞ্জুর করে ৩ আগস্ট দিন ধার্য করে দেন; কিন্তু এ সময় দুদকের এক কৌঁসুলি আদালতে বক্তব্য পেশ করছিলেন। তখন আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠেন, ‘ওই ব্যাটা চুপ কর’। তখন বিচারক আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘ওই ব্যাটা চুপ কর’ এটি একটি সন্ত্রাসমূলক শব্দ। কে বলেছেন এই কথা? সাহস থাকলে সামনে এসে বলুন। আইনজীবী মিজানুর রহমানের পাশ থেকে শব্দটি এসেছে। এ পর্যায়ে মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, খালেদা জিয়ার কোন আইনজীবী এ ধরনের শব্দ উচ্চারণ করেনি। যেই এটি করুক সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। আইনজীবী হিসেবে আমাদের কর্তব্য আদালতকে সম্মান জানানো। বিচারক বলেন, অন্য আসামির আইনজীবী করেছে। ‘হোয়াট ননসেন্স’। কোন বিচারক বা আইনজীবীর মুখে যদি এ ধরনের বক্তব্য আসে তাহলে সে সন্ত্রাসী। এ ধরনের সন্ত্রাসমূলক শব্দ যিনি ব্যবহার করবেন তিনি আদালতে আসবেন না।
 
স্থায়ী জামিন দুই আসামির
ট্রাস্ট মামলার আসামি বিআইডব্লিউটিএ-এর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খানকে স্থায়ী জামিন দিয়েছে আদালত। তাদের আইনজীবীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বিচারক এই আদেশ দেন। আইনজীবীরা বলেন, আসামিরা জামিন পেয়ে এর কোন অপব্যবহার করেনি। আদালতের নির্দেশ মেনে একাধিকবার হাজির হয়েছে। জামিন স্থায়ী করা হোক। আদালত জামিন স্থায়ীর আদেশ দিয়ে বলেছেন, পরবর্তী ধার্য তারিখে আদালতে অনুপস্থিত থাকলে জামিন বাতিল করা হবে। এদিকে জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষে হাজিরা দেন তার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া। খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী, জয়নুল আবেদীন, মাসুদ আহমেদ তালুকদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।