বাংলাদেশ

মটমালিয়াট তালপাখার গ্রাম

সড়কের ধারে, বাড়ির উঠান, বারান্দা ও বাগানে বসে তালপাতার পাখা তৈরি করছেন বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। কেউ তালপাতা পানি দিয়ে ভেজাচ্ছেন। কেউ রোদে শুকাচ্ছেন। অনেকে তা কেটে রাখছেন, বাঁশ চিরে শলা তৈরি করছেন। কেউবা সুতা ও বাঁশের শলায় রং লাগাচ্ছেন। বিক্রির জন্য বোঝা বাঁধছেন অনেকে। গরমের মৌসুমে কুমারখালীর মটমালিয়াট গ্রামের পরিচিত দৃশ্য এটি। উপজেলা শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে গ্রামটি।
মটমালিয়াটে কথা হয় ফরিদা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর বাবা সুকচাঁদ ৯০ বছর আগে প্রথম পাখা তৈরি করেন। তাঁর কাছ থেকে চাচা, ভাই, ভাতিজা শিখেছেন। এখন গ্রামের সবাই তৈরি করেন। ছেলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, তিনি ৪৫ বছর ধরে পাখা তৈরি করছেন। প্রতিটিতে ৮-১০ টাকার বাঁশ, তার, মোম, সুতা ও পাতা লাগে। পাইকারি ১২-১৪ ও খুচরা ২০-২৫ টাকায় বিক্রি হয়। সপ্তাহে ১২শ পর্যন্ত পাখা তৈরি করেন। মৌসুমে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা বিক্রি হয়।
আধুনিক বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কারে গরমে শীতল হওয়ার অনেক যন্ত্র বাজারে এসেছে। তবে তালপাখার চাহিদা রয়ে গেছে। এ কারণে মৌসুমে মটমালিয়াট গ্রামে এখন তালপাখা তৈরির ধুম। গ্রামের প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার ছয় মাস পাখা তৈরি করে। আশপাশের মটমালিয়াট, বানিয়াকান্দি ও সন্তোষপুরের অর্ধশতাধিক পরিবারও এতে যুক্ত। সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রামগুলোয় ছয় মাসে প্রায় ৩০ লাখ পাখা তৈরি হয়। এর বাজারমূল্য সাড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা। গ্রামের আবুল হোসেন (৭৫) বলেন, তিনি চাচা সুকচাঁদের কাছ থেকে পাখা তৈরির কাজ শেখেন। দশম শ্রেণির ছাত্রী জেসমিন খাতুনের ভাষ্য, সে পড়াশোনার পাশাপাশি পাখায় রং লাগানোর কাজ করে। সংসারের কাজের পাশাপাশি পাখা ধোয়া ও সেলাইয়ের কাজ করেন গৃহবধূ আবেদা খাতুন। এতে দিনে তিনি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পান। অষ্টম শ্রেণির তামিম হোসেন জানায়, সে দিনে প্রায় ১০০ থেকে ১২০টি পাখায় তার বাঁধতে পারে। এতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হয়। কারিগররা বলছেন, হাতপাখা তৈরির কাজ শুরু হয় ফাল্গুন মাসে, চলে ভাদ্র-আশ্বিন পর্যন্ত। অন্য সময় তাঁরা কৃষি, ব্যবসাসহ অন্য কাজ করেন। কারিগর আব্দুল হান্নান বলেন, আগের তুলনায় পাখার দাম বেড়েছে। বেড়ে গেছে কাঁচামাল ও নিত্যপণ্যের দামও। প্রণোদনা ও কম সুদে ঋণ পেলে কাঁচামাল ও পণ্য সংরক্ষণ করে বেশি লাভবান হতেন তাঁরা। জেলা ও বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করেন কারিগররা। প্রতিটি তালের পাতা কেনেন ৫ থেকে ৮ টাকায়। একটিতে ৮ থেকে ১০টি পাখা হয়। বাঁশ কেনেন প্রতিটি ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। এ পাখা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার বাইরেও বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি পরিবার ছয় মাসে অন্তত ১৫ হাজার করে পাখা তৈরি করে। সোমবার বিকেলে মটমালিয়াট গ্রামে দেখা মেলে ব্যাপারী আব্দুল মুন্নাফের সঙ্গে। তিনি জানান, ৩৭ বছর ধরে পাখার ব্যবসা করছেন। ১০ থেকে ১৪ টাকায় কিনে শহরে ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি করেন। ইউএনও বিতান কুমার মণ্ডল বলেন, হাতপাখা তৈরির কাজ করে পরিবারগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। জনপদের ঐতিহ্যও টিকিয়ে রেখেছে। উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রচার ও প্রসারে উপজেলা প্রশাসন উদ্যোক্তা অ্যাপস, ম্যাপস ও মেলার ব্যবস্থা করেছে। প্রয়োজনে সহজ শর্তে তাঁদের ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।     এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস