বাংলাদেশ

কিশোর গ্যাং নেতার ‘টর্চার সেল’, কথার হেরফের হলেই নির্যাতন

সরকারি নির্মাণাধীন একটি ভবনের নিচতলা। চারপাশ টিন দিয়ে ঘেরা। দেয়ালে সাঁটানো ‘নেতার’ নামে পোস্টার। এটি এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত ‘টর্চার সেল’ হিসেবে। এই টর্চার সেলের অবস্থান চট্টগ্রাম নগরের আকবর শাহ থানার পশ্চিম ফিরোজ শাহ এলাকায়। এটি গড়ে তুলেছেন কিশোর গ্যাং নেতা গোলাম রসুল ওরফে নিশান। তিনি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। চলতি মাসের শুরুতে ওই টর্চার সেলের পাশে হামলায় এক দন্ত চিকিৎসকের মৃত্যুর ঘটনার পর সরেজমিনে সেখানে গেলে এসব কথা জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এলাকায় কেউ গোলাম রসুলের কথার অবাধ্য হলে তাঁকে সেখানে নিয়ে চালানো হতো নির্যাতন। বাদ যায়নি স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও। গোলাম রসুল ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি। নগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু কমিটিতে বর্তমানে তাঁর কোনো পদ নেই। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে। নগরের আকবর শাহ থানার পশ্চিম ফিরোজ শাহ এলাকায় তাঁর বাড়ি। নগরের বিভিন্ন থানায় গোলাম রসুলের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, মারামারির সাতটি মামলা রয়েছে। সর্বশেষ দন্ত চিকিৎসক হত্যা মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়।
৫ এপ্রিল নগরের আকবর শাহ থানার পশ্চিম ফিরোজ শাহ আবাসিক এলাকায় দন্ত চিকিৎসক কুরবান আলীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে আলী রেজাকে বাঁচাতে এসে তিনি হামলার শিকার হন। আলী রেজা ওই দিন সন্ধ্যায় ইফতারি কিনতে এসেছিলেন। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নির্মাণাধীন ভবন থেকে ১৫ থেকে ২০ জন লাঠিসোঁটা নিয়ে এসে তাঁর ওপর হামলা চালান। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান চিকিৎসক বাবা। তখন মাথায় গুরুতর আঘাত পান। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ১০ এপ্রিল চিকিৎসক কুরবান আলী মারা যান। তাঁর ছেলের অপরাধ, কেন কিশোর গ্যাং সদস্যদের দুই স্কুলছাত্রকে মারধরের বিষয়টি জানিয়ে পুলিশের জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দিয়েছেন। আলী রেজার ভাষ্য, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সবাই স্থানীয় যুবলীগ নেতা গোলাম রসুলের অনুসারী। তাঁদের সঙ্গে তাঁর কোনো পূর্বশত্রুতা নেই। এই ঘটনায় আলী রেজা বাদী হয়ে গোলাম রসুলসহ ১২ জনের নাম উল্লেখ করে আকবর শাহ থানায় হত্যা মামলা করেন। চট্টগ্রাম নগরে অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। একেক দলে রয়েছে ৫ থেকে ১৫ জন। পুলিশের হিসাবে, নগরজুড়ে এসব গ্যাংয়ের সদস্যসংখ্যা অন্তত ১ হাজার ৪০০। পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫ ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ জন ‘বড় ভাই’। গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত বলে জানায় পুলিশ। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি।
এলাকার জিইসি মোড় থেকে জাকির হোসেন সড়কের ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন পার হয়ে এ কে খান এলাকার আগে পশ্চিম ফিরোজ শাহ এলাকায় রাস্তার পাশে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অধীনে ১০ তলা ফ্ল্যাট প্রকল্প নির্মাণাধীন। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানকার নিচতলাটি স্থানীয় লোকজন চেনেন ‘নিশান গ্রুপের (গোলাম রসুল) টর্চার সেল’ নামে। গোলাম রসুলের কিশোর গ্যাংয়ের নাম ‘নিশান গ্রুপ’। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, পড়ে রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির সিগারেটের খালি প্যাকেট। মাদক গ্রহণের বিভিন্ন আলামতও দেখা গেছে। দেয়ালে দলীয় নেতাদের ছবিসহ রয়েছে গোলাম রসুলের পোস্টার। বসার জন্য রয়েছে গাছের বড় গুঁড়ি। ভবনটিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে  নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে আছেন মনজুর আলম। তিনি বলেন, ‘আগে অনেক চেয়ার ছিল। ঘটনার (চিকিৎসকের মৃত্যুর পর) পর পুলিশ সবকিছু নিয়ে গেছে। তারা যখন মন চাইত, তখনই আসত। আমরা শুধু দেখতাম।’ এর বেশি কিছু জানাতে চাননি এই নিরাপত্তাকর্মী।
কথা হয় দীর্ঘদিন কর্মরত থাকা আরেক নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখানে বিভিন্ন সময় অনেককে নিয়ে আসা হতো। শুধু কান্নার শব্দ শোনা যেত। পরে আবার ছেড়ে দিত। নির্মাণাধীন ভবনের আশপাশের কয়েকজন দোকানদারও জানিয়েছেন একই তথ্য। তবে কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। ভবনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবু জারকেও মারধর করা হয়, জানান স্থানীয় লোকজন। তবে এই বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে কিছু বলতে রাজি হননি। চাঁদার টাকা না পেয়ে মাসখানেক আগে ভাসমান এক দোকানদারকে টর্চার সেলে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে গতকাল সেখানে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, নিশান গ্রুপের সদস্যরা এলাকায় নির্মাণাধীন বিভিন্ন ভবনে ইট, বালুসহ বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহ করেন। স্থানীয় মানুষদের অভিযোগ, বেশি দাম দিয়ে নিম্নমানের সামগ্রী তাঁদের কাছ থেকে নিতে হয়। এ ছাড়া এলাকার বিভিন্ন দোকান থেকে মাসিক চাঁদা, এ কে খান ও অলংকার মোড়ে থাকা বিভিন্ন বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও টেম্পো থেকে চাঁদা আদায় করে থাকেন। গতকাল টর্চার সেলের আশপাশের এলাকায় পাঁচজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা কেউ নিজের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করতে রাজি হননি নিরাপত্তার কারণে। তাঁদের একজন প্রথম আলোকে বলে, ২০১৯ সালে তখন তিনি নবম শ্রেণিতে পড়তেন। তাঁকে গোলাম রসুলের কিশোর গ্যাংয়ের দলে যোগ দিতে বলা হয়। কিন্তু রাজি না হওয়ায় তাঁকে টর্চার সেলে নিয়ে মারধর করা হয়। পরে স্থানীয় এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দা মো. সামির, মো. রিয়াদ, সোহেল ওরফে বগা সোহেল, মো. আকিব, মো. অপূর্ব,  মো. রাজু, মো. সাগর, মো. বাবু, মো. রাজু, মো. সংগ্রাম, মো. সাফায়েত ও মো. আকবর এই টর্চার সেলে গোলাম রসুলের নির্দেশে নির্যাতন করতেন। তাঁদের সবাইকে দন্ত চিকিৎসক কুরবান আলী হত্যা মামলায়ও আসামি করা হয়। কিশোর গ্যাং বলা হলেও তাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৩২ বছর। ২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর আকবর শাহ থানার কৈবল্যধাম এলাকায় সাউন্ড বক্সে গান বাজানো নিয়ে জয় দাশ নামের জুট মিলের এক কর্মচারীকে খুনের ঘটনায় করা মামলার ১০ আসামির সবাই কিশোর গ্যাং নেতা গোলাম রসুলের অনুসারী। ওই সময় কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী। জয় দাশের বাবা শুভ চন্দ্র দাশ  বলেন, ‘ছয় বছর আগে আমার ছেলে খুনের বিচার হলে নতুন করে এলাকায় খুনের ঘটনা ঘটত না। আসামিরা সবাই জামিনে। ছেলে হত্যার বিচার কবে পাব, জানি না।’ স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিশান গ্রুপের উত্থান ২০১৫ সালের শুরুর দিকে। তখন স্থানীয় একটি ক্লাব থেকে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা হতো। পরে গণপূর্তের ভবনের নিচতলায় আস্তানা গড়ে তোলা হয়। এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস