কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় এক হোমিও চিকিত্সককে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তাঁর নাম মীর সানোয়ার রহমান সানা (৬০)। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার বটতৈল ইউনিয়নের শিশির মাঠ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। চিকিত্সকের সঙ্গে থাকা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সাইফুজ্জামানকেও (৪৫) কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছে দুর্বৃত্তরা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
স্বজনরা বলেন, সানোয়ার রহমান লালনভক্ত ছিলেন। শিশির মাঠ এলাকায় নিজের বাগানবাড়িতে মাঝেমধ্যেই লালনভক্তদের নিয়ে বাউল গানের আসরের আয়োজন করতেন তিনি। বন্ধুবান্ধবকেও তাতে আমন্ত্রণ জানাতেন। তবে তিনি নিজে গান গাইতেন না। তাঁর ব্যক্তিগত কোনো শত্রু ছিল না। কেউ তাঁকে কখনো কোনো হুমকিও দেয়নি। প্রতি শুক্রবার ওই বাগানবাড়িতে তিনি গরিব রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিত্সা দিতেন। শিক্ষক সাইফুজ্জামানসহ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক তাঁর এই কর্মকাণ্ডে আর্থিক সহায়তা দিতেন।
দেশে একের পর এক ব্লগার, শিক্ষক ও ভিন্নমতাবলম্বী হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতার মধ্যেই এ ঘটনা ঘটল। গত এক মাসে এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছয়জনকে কুপিয়ে হত্যা করল দুর্বৃত্তরা। আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে সানোয়ারকে হত্যার ধরনেও যথেষ্ট মিল রয়েছে। তবে এ ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, সে বিষয়ে পুলিশ তাত্ক্ষণিক কিছু জানাতে পারেনি। কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে, স্বজনরাও এ বিষয়ে কিছু অনুমান করতে পারছে না।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, হামলায় সানোয়ার রহমান ঘটনাস্থলেই মারা যান। সাইফুজ্জামানকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিত্সকরা জানান, উভয়ের ঘাড়ে ও মাথার পেছনে চাপাতির মতো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছে হামলাকারীরা। চার থেকে পাঁচটি করে কোপের চিহ্ন রয়েছে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় শিক্ষককে হেলিকপ্টারে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সেখানে অ্যাপোলে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রয়েছেন তিনি।
সানোয়ার রহমান কুষ্টিয়া সদরের সাদ্দাম বাজার এলাকার বজলুর রহমানের ছেলে। পরিবার নিয়ে তিনি সদরের মজমপুর এলাকায় থাকতেন। সাইফুজ্জামানের বাড়ি কুষ্টিয়া শহরতলির হাটস হরিপুর গ্রামে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদের অনুসারী। দীর্ঘদিন তিনি শিক্ষা ছুটিতে দেশের বাইরে ছিলেন। সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন।
স্বজন ও স্থানীয় লোকজন জানায়, সানোয়ার রহমান পাঁচ-সাত বছর আগে শিশির মাঠ এলাকায় জমি কিনে ওই বাগানবাড়ি গড়ে তোলেন। গতকাল সকালে রোগী দেখতে মজমপুরের বাসা থেকে সাইফুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে নিজের মোটরসাইকেলে করে বাগানবাড়ির উদ্দেশে রওনা হন তিনি। নিজেই মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন। শিক্ষক তাঁর পেছনে বসা ছিলেন। সাড়ে ৯টার দিকে বাগানবাড়ির কাছাকাছি শিশির মাঠের নির্জন বটতলায় পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে একটি মোটরসাইকেলে আসা তিন যুবক তাঁদের গতি রোধ করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মোটরসাইকেলে করে দ্রুত কুষ্টিয়ার দিকে পালিয়ে যায়। হামলায় সানোয়ার রহমান ঘটনাস্থলেই মারা যান। আহত শিক্ষককে উদ্ধার করে স্থানীয়রা কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়।
স্থানীয়রা জানায়, শিশির মাঠের দূরত্ব কুষ্টিয়া সদর থেকে সাত-আট কিলোমিটার। এলাকাটি অনেক আগে থেকে চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। নির্জন ও ফাঁকা মাঠ পাড়ি দিয়ে সেখানে যেতে হয়। যাওয়ার পথটি পিচঢালা হলেও ভাঙাচোরা। ছোট যানবাহন ও মোটরসাইকেলই এ রাস্তায় একমাত্র বাহন। সানোয়ার রহমানের বাগানবাড়িটিও গাছপালা ও ঝোপঝাড়ে ভর্তি। সেখানে একটি এক তলা ঘর, একটি পুকুর ও একটি গোলাঘর রয়েছে। এ ঘরে বসেই তিনি শুক্রবার রোগী দেখতেন। বর্তমানে সেখানে সংস্কারকাজ চলছিল। যে জায়গায় হামলা হয়েছে তার আশপাশেও কোনো বাড়িঘর নেই। চারদিকে ধু ধু মাঠ আর ঝোপঝাড়।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, খবর পেয়ে সেখানে শত শত মানুষের ভিড় জমে গেছে। তখনো রাস্তার ওপর ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে রয়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে পরিচয় প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছে তারা।
স্থানীয়রা জানায়, তারা শুনেছে কালো একটি মোটরসাইকেলে করে আসা তিন যুবক নির্জন ওই রাস্তার বাঁকে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সানোয়ার ও সাইফুজ্জামান ওই বাঁকে পৌঁছে মোটরসাইকেলের গতি কমিয়ে দিলে তিন যুবক তাঁদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। মনে হয়েছে মূলত সানোয়ার রহমানই তাদের লক্ষ্য ছিলেন। পেছনে বসা শিক্ষক বাধা দিতে গেলে তাঁকেও কুপিয়েছে হামলাকারীরা। দুজনকে ঘাড় ও মাথায় কুপিয়ে দু-তিন মিনেটের মধ্যে মোটরসাইকেল নিয়ে বটতৈলের দিকে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। শিক্ষকের হাতের দুটি আঙুলও কাটা পড়েছে। সোয়া ১০টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে। তারা সানোয়ারের লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে শিক্ষকের কাটা আঙুল ও একটি চাপাতি উদ্ধার করেছে পুলিশ।
স্বজনরা জানায়, সানোয়ার রহমান আগে ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী কুষ্টিয়া মনোয়ার আজমত আলী কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ হালিমা খাতুন ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সে সময় তাঁদের একমাত্র ছেলে পাভেল রহমান বিমানবাহিনীর জিডি পাইলট ছিলেন। ছেলেকে দেখতে যাওয়ার পথেই দুর্ঘটনায় পড়েন মা। ঘটনার পর পাভেল ওই চাকরি ছেড়ে দেন। এখন তিনি শ্রীমঙ্গলে একটি চা বাগানের ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করছেন। বাবা হত্যার খবর পেয়ে তিনি কুষ্টিয়ার পথে রওনা দেন।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর কয়েক বছর আগে সানোয়ার রহমান দ্বিতীয় বিয়ে করেন। গতকাল ঘটনার পর মজমপুরের বাসায় গেলে তাঁর বর্তমান স্ত্রী সেলিনা আখতারকে আহাজারি করতে দেখা যায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘সকালে অনেক ওষুধ নিয়ে শিশিরপাড়া মাঠের বাগানবাড়িতে যাওয়ার সময় উনি (সানোয়ার) আমাকে বললেন, কিছু ফেলে রেখে গেলাম না তো? এটাই যে ওনার শেষ কথা হবে, তা বুঝতে পারলে তাঁকে যেতে দিতাম না। কী কারণে আমার স্বামী খুন হলেন তা বাগানবাড়িতে যারা কাজ করে তাদের ধরলেই জানা যাবে।’
সানোয়ার রহমান স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত সজ্জন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এভাবে তাঁর মৃত্যু মানতে পারছে এলাকাবাসী। তারা বলছে, হোমিও চিকিত্সার পাশাপাশি সানোয়ার রহমান তাঁর বাগানবাড়িতে মাঝেমধ্যে লালনভক্তদের নিয়ে গানের আসর করতেন। এমন মানুষের কোনো শত্রু থাকতে পারে না।
কুষ্টিয়া টেনিস মাঠে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত টেনিস খেলতেন সানোয়ার রহমান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বিনয়ী ও সজ্জন এ মানুষটির যে শত্রু থাকতে পারে সেটা কখনো মনে হয়নি।
ঘনিষ্ঠ বন্ধু নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সানোয়ারকে কেউ এভাবে হত্যা করতে পারে তা কখনো আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। সে নিজেও কোনো দিন এ ধরনের আশঙ্কার কথা বলেনি।’
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বিকেলে সানোয়ার রহমানের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। স্বজনরা জানিয়েছে, মরদেহ স্থানীয় পৌর কবরস্থানে দাফন করা হবে।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিত্সা কর্মকর্তা ডা. তাপস কুমার পাল বলেন, ‘দুজনের ঘাড়ে ও মাথার পেছনে চাপাতি দিয়ে চার-পাঁচটি করে কোপ দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ায় সাইফুজ্জামানের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। আমরা প্রাথমিক চিকিত্সা দিয়েছি। উন্নত চিকিত্সার জন্য তাঁকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।’
তবে গতকাল কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে সাইফুজ্জামান বলেছেন, মোটরসাইকেলটি তিনি চালাচ্ছিলেন। চিকিত্সক তাঁর পেছনে বসা ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি গাড়ি ড্রাইভ করছিলাম। এ সময় ২৫-২৬ বছর বয়সের তিন যুবক এসে আমাদের এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। তবে কাউকে চিনতে পারিনি।’
খবর পেয়ে গতকাল কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে সাইফুজ্জামানকে দেখতে যান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল হাকিম সরকার, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহিনুর রহমান, প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমানসহ অন্য শিক্ষকরা।
হামলার ঘটনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও শাপলা ফোরাম, জিয়া পরিষদ, গ্রীন ফোরাম ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ পৃথক বিবৃতির মাধ্যমে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
সাইফুজ্জামানের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীর কোনো শত্রু ছিল না। তিনি কেন এ ধরনের হামলার শিকার হলেন তা বুঝতে পারছি না।’
কুষ্টিয়া সদর থানার ওসি শাহবুদ্দিন চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ধারণা করা হচ্ছে পূর্বশত্রুতার জের ধরে এ হামলা হয়েছে। তবে এখনো থানায় মামলা হয়নি। কাউকে আটকও করা যায়নি। পুলিশ রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে।’
গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে র্যাব-১২-এর কমান্ডিং অফিসার শাহাবুদ্দিন খান সাংবাদিকদের জানান, দেশে সাম্প্রতিক যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর সঙ্গে এ ঘটনার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম জানিয়েছেন, পূর্বশত্রুতার জের ধরে, বাগানবাড়ির জমি নিয়ে বিরোধ কিংবা নারী ঘটিত কোনো ঘটনার সূত্র ধরে সানোয়ার রহমানকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি চাপাতি ও শিক্ষকের হাতের কাটা দুটি আঙুল উদ্ধার করা হয়েছে।
হামলার সঙ্গে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে তা মনে করছি না। তবে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে।’
নিউরো আইসিইউতে ড. সাইফুজ্জামান : গতকাল বিকেলে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তির পরই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সাইফুজ্জামানকে নিউরো আইসিইউতে নেওয়া হয়। চিকিত্সকদের বরাত দিয়ে তাঁর স্বজনরা জানিয়েছেন, গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত সাইফুজ্জামানকে সংকটাপন্ন বলা হয়েছে।
শিক্ষক সাইফুজ্জামানের স্ত্রী সোনিয়া সুলতানা শিখা জানান, দুপুর ২টার পর অ্যাপোলো হাসপাতালে পৌঁছলে নিউরো সার্জারি বিভাগে তাঁর স্বামীর দ্রুত চিকিত্সা শুরু হয়। কিছু সময় পরই তাঁকে নিউরো আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে। সাইফুজ্জামানের কান ও মাথায় জখম রয়েছে। তাঁর হাতের আঙুলও কেটে গেছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, তাঁর পেটে রক্ত বা এ জাতীয় কিছু জমাট বেঁধে আছে। গতকাল হাসপাতালে নেওয়ার পর একবার বমিও করেছেন সাইফুজ্জামান। চিকিত্সকরা বলছেন, তাঁর অবস্থা ক্রিটিক্যাল। চিকিত্সকদের বরাত দিয়ে শিখা বলেন, ‘আগামীকাল (আজ) সকালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কান ও মাথায় অপারেশন করা হবে।’
স্বজনরা বলেন, সানোয়ার রহমান লালনভক্ত ছিলেন। শিশির মাঠ এলাকায় নিজের বাগানবাড়িতে মাঝেমধ্যেই লালনভক্তদের নিয়ে বাউল গানের আসরের আয়োজন করতেন তিনি। বন্ধুবান্ধবকেও তাতে আমন্ত্রণ জানাতেন। তবে তিনি নিজে গান গাইতেন না। তাঁর ব্যক্তিগত কোনো শত্রু ছিল না। কেউ তাঁকে কখনো কোনো হুমকিও দেয়নি। প্রতি শুক্রবার ওই বাগানবাড়িতে তিনি গরিব রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিত্সা দিতেন। শিক্ষক সাইফুজ্জামানসহ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক তাঁর এই কর্মকাণ্ডে আর্থিক সহায়তা দিতেন।
দেশে একের পর এক ব্লগার, শিক্ষক ও ভিন্নমতাবলম্বী হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতার মধ্যেই এ ঘটনা ঘটল। গত এক মাসে এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছয়জনকে কুপিয়ে হত্যা করল দুর্বৃত্তরা। আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে সানোয়ারকে হত্যার ধরনেও যথেষ্ট মিল রয়েছে। তবে এ ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, সে বিষয়ে পুলিশ তাত্ক্ষণিক কিছু জানাতে পারেনি। কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে, স্বজনরাও এ বিষয়ে কিছু অনুমান করতে পারছে না।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, হামলায় সানোয়ার রহমান ঘটনাস্থলেই মারা যান। সাইফুজ্জামানকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিত্সকরা জানান, উভয়ের ঘাড়ে ও মাথার পেছনে চাপাতির মতো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছে হামলাকারীরা। চার থেকে পাঁচটি করে কোপের চিহ্ন রয়েছে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় শিক্ষককে হেলিকপ্টারে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সেখানে অ্যাপোলে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রয়েছেন তিনি।
সানোয়ার রহমান কুষ্টিয়া সদরের সাদ্দাম বাজার এলাকার বজলুর রহমানের ছেলে। পরিবার নিয়ে তিনি সদরের মজমপুর এলাকায় থাকতেন। সাইফুজ্জামানের বাড়ি কুষ্টিয়া শহরতলির হাটস হরিপুর গ্রামে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদের অনুসারী। দীর্ঘদিন তিনি শিক্ষা ছুটিতে দেশের বাইরে ছিলেন। সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন।
স্বজন ও স্থানীয় লোকজন জানায়, সানোয়ার রহমান পাঁচ-সাত বছর আগে শিশির মাঠ এলাকায় জমি কিনে ওই বাগানবাড়ি গড়ে তোলেন। গতকাল সকালে রোগী দেখতে মজমপুরের বাসা থেকে সাইফুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে নিজের মোটরসাইকেলে করে বাগানবাড়ির উদ্দেশে রওনা হন তিনি। নিজেই মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন। শিক্ষক তাঁর পেছনে বসা ছিলেন। সাড়ে ৯টার দিকে বাগানবাড়ির কাছাকাছি শিশির মাঠের নির্জন বটতলায় পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে একটি মোটরসাইকেলে আসা তিন যুবক তাঁদের গতি রোধ করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মোটরসাইকেলে করে দ্রুত কুষ্টিয়ার দিকে পালিয়ে যায়। হামলায় সানোয়ার রহমান ঘটনাস্থলেই মারা যান। আহত শিক্ষককে উদ্ধার করে স্থানীয়রা কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়।
স্থানীয়রা জানায়, শিশির মাঠের দূরত্ব কুষ্টিয়া সদর থেকে সাত-আট কিলোমিটার। এলাকাটি অনেক আগে থেকে চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। নির্জন ও ফাঁকা মাঠ পাড়ি দিয়ে সেখানে যেতে হয়। যাওয়ার পথটি পিচঢালা হলেও ভাঙাচোরা। ছোট যানবাহন ও মোটরসাইকেলই এ রাস্তায় একমাত্র বাহন। সানোয়ার রহমানের বাগানবাড়িটিও গাছপালা ও ঝোপঝাড়ে ভর্তি। সেখানে একটি এক তলা ঘর, একটি পুকুর ও একটি গোলাঘর রয়েছে। এ ঘরে বসেই তিনি শুক্রবার রোগী দেখতেন। বর্তমানে সেখানে সংস্কারকাজ চলছিল। যে জায়গায় হামলা হয়েছে তার আশপাশেও কোনো বাড়িঘর নেই। চারদিকে ধু ধু মাঠ আর ঝোপঝাড়।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, খবর পেয়ে সেখানে শত শত মানুষের ভিড় জমে গেছে। তখনো রাস্তার ওপর ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে রয়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে পরিচয় প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছে তারা।
স্থানীয়রা জানায়, তারা শুনেছে কালো একটি মোটরসাইকেলে করে আসা তিন যুবক নির্জন ওই রাস্তার বাঁকে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সানোয়ার ও সাইফুজ্জামান ওই বাঁকে পৌঁছে মোটরসাইকেলের গতি কমিয়ে দিলে তিন যুবক তাঁদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে। মনে হয়েছে মূলত সানোয়ার রহমানই তাদের লক্ষ্য ছিলেন। পেছনে বসা শিক্ষক বাধা দিতে গেলে তাঁকেও কুপিয়েছে হামলাকারীরা। দুজনকে ঘাড় ও মাথায় কুপিয়ে দু-তিন মিনেটের মধ্যে মোটরসাইকেল নিয়ে বটতৈলের দিকে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। শিক্ষকের হাতের দুটি আঙুলও কাটা পড়েছে। সোয়া ১০টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে। তারা সানোয়ারের লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে শিক্ষকের কাটা আঙুল ও একটি চাপাতি উদ্ধার করেছে পুলিশ।
স্বজনরা জানায়, সানোয়ার রহমান আগে ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী কুষ্টিয়া মনোয়ার আজমত আলী কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ হালিমা খাতুন ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সে সময় তাঁদের একমাত্র ছেলে পাভেল রহমান বিমানবাহিনীর জিডি পাইলট ছিলেন। ছেলেকে দেখতে যাওয়ার পথেই দুর্ঘটনায় পড়েন মা। ঘটনার পর পাভেল ওই চাকরি ছেড়ে দেন। এখন তিনি শ্রীমঙ্গলে একটি চা বাগানের ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করছেন। বাবা হত্যার খবর পেয়ে তিনি কুষ্টিয়ার পথে রওনা দেন।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর কয়েক বছর আগে সানোয়ার রহমান দ্বিতীয় বিয়ে করেন। গতকাল ঘটনার পর মজমপুরের বাসায় গেলে তাঁর বর্তমান স্ত্রী সেলিনা আখতারকে আহাজারি করতে দেখা যায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘সকালে অনেক ওষুধ নিয়ে শিশিরপাড়া মাঠের বাগানবাড়িতে যাওয়ার সময় উনি (সানোয়ার) আমাকে বললেন, কিছু ফেলে রেখে গেলাম না তো? এটাই যে ওনার শেষ কথা হবে, তা বুঝতে পারলে তাঁকে যেতে দিতাম না। কী কারণে আমার স্বামী খুন হলেন তা বাগানবাড়িতে যারা কাজ করে তাদের ধরলেই জানা যাবে।’
সানোয়ার রহমান স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত সজ্জন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এভাবে তাঁর মৃত্যু মানতে পারছে এলাকাবাসী। তারা বলছে, হোমিও চিকিত্সার পাশাপাশি সানোয়ার রহমান তাঁর বাগানবাড়িতে মাঝেমধ্যে লালনভক্তদের নিয়ে গানের আসর করতেন। এমন মানুষের কোনো শত্রু থাকতে পারে না।
কুষ্টিয়া টেনিস মাঠে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত টেনিস খেলতেন সানোয়ার রহমান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বিনয়ী ও সজ্জন এ মানুষটির যে শত্রু থাকতে পারে সেটা কখনো মনে হয়নি।
ঘনিষ্ঠ বন্ধু নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সানোয়ারকে কেউ এভাবে হত্যা করতে পারে তা কখনো আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। সে নিজেও কোনো দিন এ ধরনের আশঙ্কার কথা বলেনি।’
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বিকেলে সানোয়ার রহমানের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। স্বজনরা জানিয়েছে, মরদেহ স্থানীয় পৌর কবরস্থানে দাফন করা হবে।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিত্সা কর্মকর্তা ডা. তাপস কুমার পাল বলেন, ‘দুজনের ঘাড়ে ও মাথার পেছনে চাপাতি দিয়ে চার-পাঁচটি করে কোপ দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ায় সাইফুজ্জামানের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। আমরা প্রাথমিক চিকিত্সা দিয়েছি। উন্নত চিকিত্সার জন্য তাঁকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।’
তবে গতকাল কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে সাইফুজ্জামান বলেছেন, মোটরসাইকেলটি তিনি চালাচ্ছিলেন। চিকিত্সক তাঁর পেছনে বসা ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি গাড়ি ড্রাইভ করছিলাম। এ সময় ২৫-২৬ বছর বয়সের তিন যুবক এসে আমাদের এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। তবে কাউকে চিনতে পারিনি।’
খবর পেয়ে গতকাল কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে সাইফুজ্জামানকে দেখতে যান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল হাকিম সরকার, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. শাহিনুর রহমান, প্রক্টর অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমানসহ অন্য শিক্ষকরা।
হামলার ঘটনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও শাপলা ফোরাম, জিয়া পরিষদ, গ্রীন ফোরাম ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ পৃথক বিবৃতির মাধ্যমে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
সাইফুজ্জামানের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীর কোনো শত্রু ছিল না। তিনি কেন এ ধরনের হামলার শিকার হলেন তা বুঝতে পারছি না।’
কুষ্টিয়া সদর থানার ওসি শাহবুদ্দিন চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ধারণা করা হচ্ছে পূর্বশত্রুতার জের ধরে এ হামলা হয়েছে। তবে এখনো থানায় মামলা হয়নি। কাউকে আটকও করা যায়নি। পুলিশ রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে।’
গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে র্যাব-১২-এর কমান্ডিং অফিসার শাহাবুদ্দিন খান সাংবাদিকদের জানান, দেশে সাম্প্রতিক যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর সঙ্গে এ ঘটনার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম জানিয়েছেন, পূর্বশত্রুতার জের ধরে, বাগানবাড়ির জমি নিয়ে বিরোধ কিংবা নারী ঘটিত কোনো ঘটনার সূত্র ধরে সানোয়ার রহমানকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে একটি চাপাতি ও শিক্ষকের হাতের কাটা দুটি আঙুল উদ্ধার করা হয়েছে।
হামলার সঙ্গে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে তা মনে করছি না। তবে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে।’
নিউরো আইসিইউতে ড. সাইফুজ্জামান : গতকাল বিকেলে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তির পরই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. সাইফুজ্জামানকে নিউরো আইসিইউতে নেওয়া হয়। চিকিত্সকদের বরাত দিয়ে তাঁর স্বজনরা জানিয়েছেন, গতকাল রাত ১২টা পর্যন্ত সাইফুজ্জামানকে সংকটাপন্ন বলা হয়েছে।
শিক্ষক সাইফুজ্জামানের স্ত্রী সোনিয়া সুলতানা শিখা জানান, দুপুর ২টার পর অ্যাপোলো হাসপাতালে পৌঁছলে নিউরো সার্জারি বিভাগে তাঁর স্বামীর দ্রুত চিকিত্সা শুরু হয়। কিছু সময় পরই তাঁকে নিউরো আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে। সাইফুজ্জামানের কান ও মাথায় জখম রয়েছে। তাঁর হাতের আঙুলও কেটে গেছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, তাঁর পেটে রক্ত বা এ জাতীয় কিছু জমাট বেঁধে আছে। গতকাল হাসপাতালে নেওয়ার পর একবার বমিও করেছেন সাইফুজ্জামান। চিকিত্সকরা বলছেন, তাঁর অবস্থা ক্রিটিক্যাল। চিকিত্সকদের বরাত দিয়ে শিখা বলেন, ‘আগামীকাল (আজ) সকালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কান ও মাথায় অপারেশন করা হবে।’