বাংলাদেশ

জলমগ্ন অবস্থায় বেচাবিক্রির অব্যাহত চিত্র

ভোরের আলো ফুটতেই নদী-খালের তীরে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়। বিক্রেতারা নৌকায় পণ্যের পসরা সাজান। ক্রেতারা এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায় ঘুরে ঘুরে দর কষেন, কেনাকাটা করেন। দিনের আলো প্রখর হওয়ার আগেই কেনাবেচা সাঙ্গ করে যার যার গন্তব্যে ফিরে যান। নৌকার ওপর বেচাকেনার এমন আয়োজনের পোশাকি নাম ‘ভাসমান হাট’। জানা যায়, স্বাধীনতার আগে সড়ক যোগাযোগ তেমন ছিল না বলে তখন দক্ষিণাঞ্চলের নদী-খাল-বিল এলাকায় নৌকায় ভাসমান হাটের প্রচলন শুরু হয়। এখন এসব হাটের সঙ্গে জেলা শহরের সরাসরি যোগাযোগ। ভাসমান হাট বর্ষা মৌসুমে বেশি জমজমাট। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর-কুড়িয়ানা ও ঝালকাঠি সদরের ভীমরুলি হাট পেয়েছে পর্যটন খ্যাতি। ভাসমান হাট দেখতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পর্যটক, সরকারের ঊর্ধ্বতন আমলা, এমনকি বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের আগমন হয়।
স্থানীদের মতে, আটঘর-কুড়িয়ানার ভাসমান হাট কমপক্ষে ২০০ বছর আগে শুরু হয়। পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার চিরা নদীতে ধানের চারার হাট এবং নাজিরপুর উপজেলার বেলুয়া নদীতে সবজিসহ কৃষিপণের হাটের বয়সও শতবর্ষের পথে। এ ছাড়া পিরোজপুর-ঝালকাঠির আরও কয়েক স্থানে ছোট পরিসরে ভাসমান হাট রয়েছে। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানা, ঝালকাঠি সদরের কীর্তিপাশা ও বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সদর ইউনিয়ন– পাশাপাশি জনপদ। এই এলাকটি পেয়ারা বাগান নামে সর্বাধিক পরিচিত। দেশি জাতের পেয়ারার সর্ববৃহৎ বাগান এই তিন ইউনিয়নে। গত ১০ বছরে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমড়া বাগান।   এসব জনপদের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে অসংখ্য খাল। সবগুলোর উৎসমুখ সন্ধ্যা নদী হওয়ায় প্রতিটি খাল খরস্রোতা। স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানার একাধিক স্থানে এবং ঝালকাঠির ভীমরুলি বাজারে ভাসমান হাটে পেয়ারা ও আমড়া বেচাকেনা হয়। দুটি ফলের মৌসুম একই সময়ে অর্থাৎ আষাঢ় থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি সময়। প্রতি শুক্র ও মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ভাসমান হাটে লাখ লাখ টাকার আমড়া-পেয়ারা পাইকারি বিক্রি হয়। ভরা মৌসুমে প্রতিদিনই হয় বেচাকেনা। পাইকাররা সারাদেশে সরবরাহ করেন। আটঘর হাটের আরেক আকর্ষণ তৈরি ডিঙি নৌকা বিক্রি। কৃষকরা এ নৌকা কেনেন। প্রায় ২০০ বছর আগে এ এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা বাগান গড়ে ওঠে বলে জানা যায়। গত দুই দশকে পেয়ারা বাগান ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে পর্যটন বাণিজ্য। বিশেষ করে সাপ্তাহিক দুটি ছুটির দিনে হাজার হাজার পর্যটক যান সেখানে। পর্যটকদের অন্যতম আর্কষণ নৌকায় পেয়ারা-আমড়া বিক্রির ভাসমান বাজার। বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা দক্ষিণাঞ্চলে গেলে পেয়ারা বাগান থাকে তাদের ভ্রমণ তালিকায়। এখানে অজ পাড়াগাঁয়ের ছাপ সর্বত্র। শুধু এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের টানছে। ছোট খালের ভেতর দিয়ে সরু অলিগলির পাড়ে পাড়ে পেয়ারা ও আমড়ার বাগান। শত শত হেক্টর (১ হেক্টরে ২ দশমিক ৪৭ একর) জমিতে একই দৃশ্য। বাগনের গভীরে গেলে নীরব নিস্তব্ধতা। বাগান থেকে ভেসে আসে পাখির ডাক। এমন পরিবেশে পর্যটকরা নৌকায় ঘুরে বেড়ান।   ভীমরুলি বাজার পড়েছে ঝালকাঠির কির্ত্তীপাশা ইউনিয়নের মধ্যে। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম জানান, ভীমরুলি বাজারটিও শতবর্ষী হতে পারে। প্রায় ২০ বছর ধরে দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন শুরু হয়। আলজেরিয়ার রাষ্ট্রদূত আবদেলোহাব সায়দানি সপরিবারে গত ২০ জুলাই গিয়েছিলেন। এর আগে বিভিন্ন সময় সাবেক ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবধন শ্রিংলা, রিভা গাঙ্গুলিসহ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নেপালের রাষ্টদূতরা এসেছেন। এ ছাড়া বৈঠাকাটা বাজারের পাশে বেলুয়া নদীর সবজির ভাসমান হাট, কাউখালীর চিরাপাড়া নদীতে ধানের চারার হাট– এসবও অতিপ্রাচীন, লোকঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এবং বর্ণিল। পর্যটকরা এখনও দিনে এসে দিনে ফিরে যাওয়াই শ্রেয় মনে করছেন। তবে ধীরে ধীরে স্থানীয় উদ্যোগে পর্যটনকেন্দ্রিক আবাসনও গড়ে উঠছে।     এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস