সংসদে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় শরিক দল এবং এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টি। এই ৯ দল এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছে। বুধবার তারা জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করে। কথা বলেছে বিএনপির সঙ্গেও। গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় শরিক বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র।
ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের আলোচনা শেষ করেছে। কমিশন এখন সরকারের কাছে তাদের সুপারিশ জমা দেবে। আগামী ১৫ অক্টোবর দলগুলোকে নিয়ে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। তবে এখনও গণভোটের সময়, কয়েকটি সংস্কার বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমত এবং সাংবিধানিক আদেশ জারির বিষয় অমীমাংসিত। জুলাই সনদ নিয়ে সমঝোতার পথে পিআর পদ্ধতি বড় বাধা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দিদারুল ভূঁইয়া ৯ দলের এসব বৈঠকের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, চেষ্টা করা হচ্ছে জুলাই সনদ যেন নোট অব ডিসেন্টমুক্ত হয়। সংস্কার যেন টেকসই হয়। তাই বড় দলগুলোকে এক জায়গায় আনতে চেষ্টা করছে ৯ দল। অনানুষ্ঠানিক এ আলোচনায় এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। সনদ সইয়ের আগে সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকার এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সূত্রগুলো সমকালকে বলেছে, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন এবং এনসিপি পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের নিশ্চয়তা চায়। এ চাওয়া পূরণ হলে তারা নির্বাচনের আগে সাংবিধানিক আদেশে জুলাই সনদ কার্যকর করা এবং গণভোট আয়োজনের দাবিতে ছাড় দেবে। জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলন ইঙ্গিত দিয়েছে, উচ্চকক্ষে পিআর হলে সংসদের নিম্নকক্ষে পিআরের দাবি থেকে তারা সরে আসবে। বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর মানতে রাজি হয়নি। দলটি বলছে, পিআর হলে উচ্চকক্ষেরই প্রয়োজন নেই।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে আগামী ১৫ অক্টোবর জুলাই সনদ সই হবে। এর আগেই সরকারকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি সুপারিশ করবে ঐকমত্য কমিশন। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল বলছে, বাস্তবায়ন পদ্ধতি দেখে তারা সনদে সইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
নির্বাচনের আগে সনদের বাস্তবায়ন ও গণভোটের দাবিতে আন্দোলন করছে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ সাতটি দল। তারা সনদ সইয়ের আগে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চাচ্ছে। উদ্দেশ্য পিআরের বিষয়টি ফয়সালা করা। গত বুধবার সন্ধ্যায় যমুনায় তাদের সময় দেওয়া হয়েছিল। তবে প্রধান উপদেষ্টার অন্য কর্মসূচির কারণ দেখিয়ে সাক্ষাৎ স্থগিত করে সরকার। সূত্র জানিয়েছে, রাজনৈতিক বিতর্ক এড়াতে ১৫ অক্টোবরের আগে কোনো দলের সঙ্গেই সাক্ষাৎ করবেন না প্রধান উপদেষ্টা।
গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রায় সব দল একমত। বিএনপি নির্বাচনের দিনে গণভোট চায়। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি আগে গণভোট চায়। এই দলগুলোর দাবি– সংবিধানের সমতুল্য আদেশ জারির মাধ্যমে নির্বাচনের আগে জুলাই সনদ কার্যকর করতে হবে।
ঐকমত্য কমিশনে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সমকালকে বলেন, কমিশন সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।
গণভোটের সময়, আদেশ না বিদ্যমান আইনে গণভোট আয়োজন এবং নোট অব ডিসেন্ট বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছিল কমিশন। তাদের ভাষ্য, কমিশন শুধু সরকারকে সুপারিশ করবে। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সমকালকে বলেন, আজ শনিবার কমিশনের সভা হবে। সেখানে সিদ্ধান্ত হতে পারে, সরকারকে কী কী সুপারিশ করা হবে।
কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল আগেই পরামর্শ দিয়েছিল, আদেশের মাধ্যমে সনদ কার্যকরে গণভোট হবে। গণভোটের ব্যালটে ঐকমত্য হওয়া সংস্কার এবং নোট অব ডিসেন্ট থাকা সংস্কার নিয়ে পৃথক প্রশ্ন থাকবে। গণভোটে রায় অনুযায়ী আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনে সংস্কার হবে। সেই অধিবেশন সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে।
শুক্রবার কমিশন সূত্র জানিয়েছে, রাজনৈতিক সমঝোতা হলে এতে পরিবর্তন আসতে পারে। বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআরে রাজি হচ্ছে না। দলটি মনে করে, উচ্চকক্ষে পিআরের দাবি মানলে নিম্নকক্ষের জন্যও একই দাবি তোলা হবে।
সনদ অনুযায়ী ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলো সংসদ নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, উচ্চকক্ষে তার ভিত্তিতে আসন পাবে। বাজেট এবং অর্থ বিল উচ্চকক্ষে যাবে না। নিম্নকক্ষে পাস হওয়া বিল একবার উচ্চকক্ষে যাবে। অনুমোদন পেলে তা আইনে পরিণত হবে। অনুমোদন না পেলে নিম্নকক্ষে ফেরত যাবে। সেখানে আবার পাস হলে তা আইনে পরিণত হবে।
কমিশনের প্রস্তাব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের মতামত অনুযায়ী, উচ্চকক্ষ শুধু সংবিধানের সুরক্ষা দেবে। সংবিধান সংশোধন বিল নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তা অনুমোদনের জন্য উচ্চকক্ষে যাবে। উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তথা ৫১ ভোট পেলে সংবিধান সংশোধন হবে। কোনো দলকে উচ্চকক্ষে ৫১টি আসন পেতে নির্বাচনে ৫০ শতাংশ ভোট পেতে হবে।
বিএনপির ভাষ্য, সংবিধানের প্রস্তাবনা ৮, ৪৮, ৫৬, তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত ৫৮(ক) এবং গণভোট সংক্রান্ত ১৪২ অনুচ্ছেদ ভবিষ্যতে সংশোধনে গণভোটের প্রয়োজন হবে। ফলে উচ্চকক্ষের হাতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
অন্যান্য দলের অবস্থান হলো, পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ হলে ১ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়া দলগুলোর সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। সংবিধান পরিবর্তন করতে সরকারি দলকে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, এই প্যান্ডোরার বাক্স আর খোলা যাবে না। সনদ চূড়ান্ত হয়েছে। যার যে বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, নির্বাচনে জয়ী হলে সেভাবে সংস্কার করবে। জামায়াত বা অন্য কেউ যদি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাহলে তারা পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন করলে বিএনপির আপত্তি নেই।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, উচ্চকক্ষে পিআর না হলে সংস্কার টেকসই হবে কিনা, সন্দেহ রয়েছে। ফলে পিআর হতেই হবে। এটুকু ছাড় দিলে অন্য বিষয়ে আর খুব বেশি আপত্তি কেউ করবে বলে মনে হয় না।
জামায়াত নেতারাও একই ধারণা দিয়েছেন। ৯ দলের সঙ্গে বৈঠকের তথ্য নিশ্চিত করে দলটির সূত্র বলছে, বিএনপি প্রকাশ্যে উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নিলে জামায়াতও নিম্নকক্ষে পিআরসহ অন্যান্য দাবি থেকে সরে আসবে। যদিও দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেন, জুলাই সনদে সংস্কারের যে ৮৪ প্রস্তাব রয়েছে, সব নিয়েই গণভোট হতে হবে। জনগণই পিআর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস