বাংলাদেশ

'কলমের সততা রক্ষা করেছি'

'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি'_ একুশের প্রভাতফেরির অমর এ গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন, 'দীর্ঘ কর্মজীবনে কলমের সততা রক্ষা করেছি, যা বিশ্বাস করেছি তার পক্ষেই সৎ থেকেছি। বিবেক বিক্রি করিনি।' বরেণ্য এই সাংবাদিক ও কলামিস্টের ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলা একাডেমিতে শুক্রবার তাকে প্রদত্ত আনন্দঘন এক সংবর্ধনার জবাবে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজন বলেন, 'আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলা ভাষা ও বাঙালির ইতিহাসে চির গৌরবের এক নাম। সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী মানুষের অধিকার রক্ষার মহৎপ্রাণ কলমযোদ্ধা তিনি। বাঙালির নিরন্তর সংগ্রামশীলতার প্রতীক। তিনি বাঙালি জীবনের প্রোজ্জ্বল এক আলোক মশাল। যদি আর কিছুও না লিখতেন, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো... এই একটি গান রচনার জন্যই তিনি অমর হয়ে থাকতেন।''কলমের সততা রক্ষা করেছি'
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষণ ছিল আবেগময়, দৃপ্ত, জোরালো। তিনি বলেন, 'মৌলবাদী শক্তি এ দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় পত্রিকাটিও তথাকথিত নিরপেক্ষতার নামে মৌলবাদীদের পক্ষ নেয়। মৌলবাদী মোল্লারা কথায় কথায় একে-তাকে মুরতাদ ঘোষণা করে। অথচ সরকার কাউকে বলে না যে, ইসলাম আর মৌলবাদ এক নয়। যতদিন মৌলবাদী শক্তি নির্মূল না হবে, ততদিন আমি শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে যাব।' তিনি আরও বলেন,'আমি একবার আন্তর্জাতিক খ্যতিসম্পন্ন এক আইনজীবীর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমি শেখ হাসিনার অন্ধ সমর্থক। আমি তাকে বলেছিলাম, শেখ হাসিনার বিকল্প কী? জঙ্গিবাদ, আফগান, পাকিস্তান কিংবা ড্রোন হামলা?'আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, 'শেখ হাসিনা একাই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তার একা বা শুধু আওয়ামী লীগের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এ জন্য বাম রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা করতে হবে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, উর্দু সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করে রক্ত দিয়ে আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা ও সম্মান সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। আজ সে ভাষা হিন্দির কবলে পড়েছে।গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, 'স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু একদিন ডেকে নিয়ে আমাকে বললেন, 'দেশ তো এখন স্বাধীন হয়ে গেছে। তুমি স্বাধীনতা নিয়ে একুশের গানের মতো একটি গান লেখ। জবাবে আমি বললাম, আপনি ৭ মার্চের ভাষণের মতো আরেকটি ভাষণ দিন। বঙ্গবন্ধু বললেন, আরে পাগল, তা কি আর হয়! আমি বললাম, এমন গান কি আর লেখা যায়! এ তো একবারই হয়।'শুক্রবার বিকেলে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর জন্মদিনে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, সংস্কৃৃতিসেবী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক আর সাংবাদিকরা। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের বিরাট এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল পুরো বাংলা একাডেমি। নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই ছুটে আসেন সবাই। শেষ অগ্রহায়ণের বিকেলটা সবার শরীরে শীতের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল। এরই মাঝে দর্শক, শুভার্থী ও ভক্তদের ফুলেল শুভেচ্ছা আর করতালিতে মিলনায়তনে এসে প্রবেশ করেন অশীতিপর তরুণ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় সংবর্ধনা কমিটি ও বাংলা একাডেমি এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। পরে তার কালজয়ী অমর গানটি গাওয়া হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস প্রফেসর রফিকুল ইসলাম। এ ছাড়া মঞ্চে ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, মোনায়েম সরকার ও নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ষাটের দশকে জাতিকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যা দিয়েছেন সে ঋণ শোধ করবার নয়। আজকের সংবর্ধনা সেই ঋণ শোধের সামান্য চেষ্টামাত্র। তিনি শতায়ু হোন।সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ভাবতে অবাক লাগে, মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাঙালি জাগরণের শ্রেষ্ঠ গানটি তিনি কীভাবে লিখতে পেরেছিলেন। বাঙালি মানসে তিনি আজীবন শ্রেষ্ঠ সম্মানের আসনে থাকবেন।বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, সত্যি কথা বলার সাহস সবার থাকে না। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর তা রয়েছে। সারাজীবনে আর কিছু না লিখলেও তিনি একুশের গানের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন।রবীন্দ্র গবেষক ও ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক বলেন, সাগরকন্যা বরিশাল এই বাংলাদেশকে অনেক ধন্য ছেলে উপহার দিয়েছে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাদের অন্যতম। সাবেক সচিব মোকাম্মেল হক বলেন, গাফ্ফার ভাই অন্যায় মেনে নেওয়ার মানুষ নন। যতদিন সারাবিশ্বে একজন বাঙালিও বেঁচে থাকবে, ততদিন একুশের প্রভাতফেরিতে খালি পায়ে শহীদ মিনারে এ গান গাওয়া হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বাঙালি জীবনের এমন কোনো দিক নেই, যা নিয়ে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী গবেষণা করেননি। তার স্মৃতি রক্ষায় একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের প্রস্তাব দেন মাহবুবে আলম।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ভাষাসংগ্রামী প্রতিভা মুৎসুদ্দি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন অর রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, সাংবাদিক আবেদ খান, লন্ডন প্রবাসী বিবি রায় চৌধুরী, লন্ডনের কনজারভেটিভ পার্টির এমপি পদপ্রার্থী মিনা রহমান প্রমুখ।সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন শামসুজ্জামান খান। মানপত্র পাঠ করেন কবি আসাদ চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, সাবেক মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, দীপু মনি, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, সাংসদ জাহাঙ্গীর কবির নানক, পংকজ দেবনাথ, সাবেক সাংসদ অপু উকিল ও গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়কারী ইমরান এইচ সরকার।প্রধানমন্ত্রীর ফোন :অনুষ্ঠান চলাকালীন গাফ্ফার চৌধুরীকে টেলিফোনে শুভেচ্ছা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে তারা এ সংবর্ধনা জানান। গাফ্ফার চৌধুরী 'মা কেমন আছো' উচ্চারণ করে কথা শুরু করেন। তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ রেহানার প্রায় পাঁচ মিনিট কথা হয়। এর আগে সকালে প্রধানমন্ত্রী ফুল ও মিষ্টি পাঠান।৮০ ফুলের মালা :গুণী এই সাংবাদিক ও সাহিত্যিকের জন্মবার্ষিকীতে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে ৮০টি গোলাপ ফুল দিয়ে মালা বানানো হয়। তা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর গলায় পরিয়ে দেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। এ ছাড়া অমর একুশে নিয়ে স্মরণীয় গান রচনা করায় ২১ লাখ টাকার চেক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর হাতে তুলে দেন এক্সিম ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নুরুল ফজল বুলবুল। অনুষ্ঠানে ৫ জন কবি তাদের কবিতার বই সংবর্ধিত অতিথিকে উৎসর্গ করেন।
ফুলের শুভেচ্ছায় সিক্ত :সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ফুলেল শুভেচ্ছায় জন্মদিনে সিক্ত হয়েছেন ক্ষণজন্মা এই পুরুষ। জন্মদিনে তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বাংলা একাডেমির পক্ষে মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ও আনোয়ারা সৈয়দ হক, জাতীয় কবিতা পরিষদ, গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক ইমরান এইচ সরকার, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ভিসি আবদুল মান্নান চৌধুরী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ, আওয়ামী সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মঞ্চ, ঢাকা কলেজ পরিবার, মেহেন্দীগঞ্জ সমিতি, তৃণমুল মেহেন্দীগঞ্জসহ আরও অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন।