ভারত সফর শেষে দেশে ফেরার আগে গতকাল সোমবার নয়াদিল্লির একটি হোটেলে দেওয়া এক সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পানি না পেলেও বিদ্যুৎ তো পেলাম। কিছু তো পেলাম।’ এই ‘কিছু’ নিয়েই গতকাল সন্ধ্যায় চার দিনের বহুল আলোচিত সফর শেষে দেশে ফিরতে হলো তাকে। তবে ‘এই কিছু’তে যেমন অসন্তুষ্ট দেশের মানুষ, তেমনি আবার সফরের অনেক দিক নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিতও বিভিন্ন মহল। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফর নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আলোচনা ও সমালোচনায় মুখর গোটা দেশ। সফরের আগের প্রত্যাশার সঙ্গে চলছে সফর পরবর্তী প্রাপ্তির যোগ-বিয়োগ। পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব-নিকাশ।
সফরকালীন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সই হওয়া ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ সফরে দেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং আশা-হতাশা-দুটোই রয়েছে। মানুষের জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক কিছুই যেমন পূরণ হয়নি; তেমনি দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নে যে কূটনৈতিক অর্জন-সেটিও কম নয়। এই সফর দুদেশের সম্পর্ককে আরো একধাপ উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা, বেসামরিক পরমাণু চুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরিত হওয়ায় দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের আরো অগ্রগতি হয়েছে। আরো নিবিড় করে তুলল বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ককে। তবে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার বিচারে বর্তমান সরকারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফর খুব বেশি ইতিবাচক হয়নি। তিস্তার পানি বণ্টন এবং গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে এবারও কোনো চুক্তি না হওয়ায় হতাশ হয়েছে দেশের মানুষ। দেশে ভারতবিরোধীরা নতুন করে সমালোচনার সুযোগ পেল। এ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতায় মানুষের উৎসাহ নষ্ট হবে। এমনকি সরকারবিরোধীরা বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে চেষ্টা করবে সুবিধা নেওয়ার।
অবশ্য বিশ্লেষকরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফর নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, অর্জন যেমন আছে, তেমনি কাক্সিক্ষত অনেক কিছুই মেলেনি। কেউ কেউ এ সফরকে ‘গতানুগতিক’ বলেছেন। তবে অধিকাংশ বিশ্লেষকই মনে করেন, এ সফর ‘শিষ্টাচার, সৌজন্যতা ও আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ; জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মৌলিক অগ্রগতি কম’। এমনকি এ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আরো বেশি ভারতমুখী হলো বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত শনিবার দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি এবং ১৪টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাবিষয়ক পাঁচটি, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে বেসামরিক পরমাণু সহযোগিতা-সম্পর্কিত চারটি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় স্যাটেলাইট ব্যবহার-বিষয়ক তিনটি চুক্তি রয়েছে। এর বাইরে বাণিজ্য, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পর্যটন, তথ্যপ্রযুক্তি, সীমান্ত নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কারণে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি এবারও আলোর মুখ দেখেনি। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলছেন, বর্তমান সরকারের সময়েই তিস্তা চুক্তি হবে। তবে এ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ ঘোষণা না হওয়ায় আবারও দীর্ঘসূত্রতায় পড়ল বিষয়টি। এ নিয়ে হতাশ দেশের মানুষ। এমনকি তিস্তার পরিবর্তে মমতার অন্য নদী থেকে পানি নেওয়ার বিকল্প প্রস্তাব ভবিষ্যত তিস্তার চুক্তির ক্ষেত্রে নতুন সংশয়ের জন্ম দিল।
একইভাবে ব্যবসায়ীদের অভিমত, দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় ভারত বাংলাদেশের তামাক ও মদজাতীয় ২৫টি পণ্য বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। তারপর থেকে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি বেশ সন্তোষজনক ছিল। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নানা শুল্ক ও অশুল্ক বাধার কারণে সেই প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে সেই শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর করার ব্যাপারে কিছুর উল্লেখ না থাকায় ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়েছেন। তবে খুলনা-কলকাতা রুটে ট্রেন সার্ভিস চালু হওয়ার ফলে আঞ্চলিক সংযোগ বাড়বে এবং তাতে ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য বাধাও দূর হবে বলে আশা করেন তারা।
যদিও বাংলাদেশকে দেওয়া ৫০০ কোটি ডলার ঋণ উন্নয়ন ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি আনবে; তবে সে অর্থ ব্যয়ে বেধে দেওয়া শর্ত একটি বড় বাধা বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ঋণের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অংশ হিসেবে সামরিক কেনাকাটার জন্য রয়েছে ৫০ কোটি ডলার। ৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের বিষয়েও চুক্তি হয়েছে। সমঝোতা হয়েছে সীমান্তহাট চালু করার বিষয়ে এবং বাংলাদেশের বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে সহযোগিতার জন্যও। কলকাতা-খুলনা-ঢাকা বাস চলাচল এবং খুলনা-কলকাতা ট্রেন চলাচল, রাধিকারপুর-বিরল রেললাইন উদ্বোধন হয়েছে। এ ছাড়া আরো ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে দেবে ভারত। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ভারতের সমর্থন পাওয়ার কথা জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
সফরে কি পেল বাংলাদেশ—এ নিয়ে গতকাল প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে কথা হয় দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের সঙ্গে।
এদের মধ্যে প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, জনগণের কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেগুলো পূরণ হয়নি। যেমন মানুষ আশা করেছিল সীমান্ত এলাকায় হত্যা বন্ধ হবে, এ দেশের পাট যাতে ভারতের বাজারে যেতে না পারে, সে জন্য পাটের এন্ট্রি ডাম্পিং নীতি নিয়েছে, পানির ব্যাপারটাও কিছুই হয়নি। সবমিলিয়ে এ সফর হতাশ করেছে। তবে সরকার রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে।
এমনকি ভারত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য যে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন, সে নিয়েও সন্তোষ্ট নন দেশের অর্থনীতিবিদরা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রথমত এ ধরনের ঋণ পরিহার করা ভালো। কারণ এসব কঠিন শর্তের ঋণ। দীঘসূত্রতার এসব ঋণের টাকায় নেওয়া প্রকল্পগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত করা যায় না। তা ছাড়া ভারতের ঋণ আসে সরকার থেকে। অনেক ধরনের শর্ত থাকে। এখনো ভারতের দ্বিতীয় দফার ঋণের টাকাই এসে পৌঁছায়নি। অনেক কাজ অসম্পন্ন রয়েছে। সবচেয়ে ভালো ছিল এ ধরনের ঋণ না নিতে পারলে। তারপরও যেহেতু নেওয়া হয়েছে, তাই এখন ঋণের টাকার সুষ্ঠু ব্যয়ের দিকে নজর রাখতে হবে। কাজের গুণগতমান নিশ্চিত করতে হবে। টাকা দ্রুত ছাড় করতে হবে। প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। দেরি হলে ব্যয় বেড়ে যাবে।
সাবেক কূটনীতিকদের মতে, এ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেলেও মৌলিক অর্জন কম। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, এ সফর শিষ্টাচার ও সৌজন্য আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ। কিন্তু জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মৌলিক অগ্রগতি কম। যেমন অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা, তিস্তার পানি বণ্টন, গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট ফল আসেনি। সীমান্তে হত্যা বন্ধ নিয়েও কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসেনি। বাণিজ্য ক্ষেত্রে ভারতের ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ শুল্ক বাধা দূর করার বিষয়েও কোনো ফল দেখা যায়নি। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিত রাজনীতিতে আমরা আরো বেশি ভারতমুখী হলাম। দুই দেশের মধ্যে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে, সেগুলো থেকে কিভাবে বাস্তবে সুবিধা পাওয়া যেতে পারে, এখন তার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে।
বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানের মতে, সফর ছিল ‘গতানুগতিক’। তিনি বলেন, যেসব চুক্তি এবং সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে তাতে ভারতের স্বার্থই বেশি সংরক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রাপ্তি খুবই কম। তিস্তা চুক্তি হলো না। কবে হবে তা-ও জানা গেল না। তিস্তার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বারবার বাংলাদেশকে বিভ্রান্ত করছেন। তাই এর জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরই ভরসা করতে হবে। ভারতের সংবিধানের ২৫৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকারই যেকোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষমতা রাখে। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরই এ ইস্যুতে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
অবশ্য প্রতিরক্ষা চুক্তির বদলে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক সই করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসিকতা দেখিয়েছেন বলে মত দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এ ব্যাপারে মেজর জেনারেল (অব.) আবদুুর রশিদ বলেন, এতে সামরিক কৌশলগত স্পর্শকাতর বিষয় নেই। ফলে এই স্মারক দেশের সার্বভৌম ও সামরিক সিদ্ধান্ত নিতে কোনো বাধার সৃষ্টি করবে না। দুই দেশের মধ্যকার প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করবে। দুই দেশের সামরিক সহযোগিতাকে কাছাকাছি আনবে। তবে ভারত সামরিক সরঞ্জামাদি কেনাকাটায় যে ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে, সেখানে কী অস্ত্র কেনা হবে, কী ধরনের অস্ত্র আমাদের প্রয়োজন, তা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত।
এলএবাংলাটাইমস/এন/এলআরটি
সফরকালীন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সই হওয়া ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ সফরে দেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং আশা-হতাশা-দুটোই রয়েছে। মানুষের জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক কিছুই যেমন পূরণ হয়নি; তেমনি দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নে যে কূটনৈতিক অর্জন-সেটিও কম নয়। এই সফর দুদেশের সম্পর্ককে আরো একধাপ উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা, বেসামরিক পরমাণু চুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরিত হওয়ায় দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের আরো অগ্রগতি হয়েছে। আরো নিবিড় করে তুলল বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ককে। তবে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার বিচারে বর্তমান সরকারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফর খুব বেশি ইতিবাচক হয়নি। তিস্তার পানি বণ্টন এবং গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে এবারও কোনো চুক্তি না হওয়ায় হতাশ হয়েছে দেশের মানুষ। দেশে ভারতবিরোধীরা নতুন করে সমালোচনার সুযোগ পেল। এ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতায় মানুষের উৎসাহ নষ্ট হবে। এমনকি সরকারবিরোধীরা বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে চেষ্টা করবে সুবিধা নেওয়ার।
অবশ্য বিশ্লেষকরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফর নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, অর্জন যেমন আছে, তেমনি কাক্সিক্ষত অনেক কিছুই মেলেনি। কেউ কেউ এ সফরকে ‘গতানুগতিক’ বলেছেন। তবে অধিকাংশ বিশ্লেষকই মনে করেন, এ সফর ‘শিষ্টাচার, সৌজন্যতা ও আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ; জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মৌলিক অগ্রগতি কম’। এমনকি এ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আরো বেশি ভারতমুখী হলো বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
গত শনিবার দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি এবং ১৪টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাবিষয়ক পাঁচটি, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে বেসামরিক পরমাণু সহযোগিতা-সম্পর্কিত চারটি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় স্যাটেলাইট ব্যবহার-বিষয়ক তিনটি চুক্তি রয়েছে। এর বাইরে বাণিজ্য, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পর্যটন, তথ্যপ্রযুক্তি, সীমান্ত নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কারণে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি এবারও আলোর মুখ দেখেনি। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলছেন, বর্তমান সরকারের সময়েই তিস্তা চুক্তি হবে। তবে এ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ ঘোষণা না হওয়ায় আবারও দীর্ঘসূত্রতায় পড়ল বিষয়টি। এ নিয়ে হতাশ দেশের মানুষ। এমনকি তিস্তার পরিবর্তে মমতার অন্য নদী থেকে পানি নেওয়ার বিকল্প প্রস্তাব ভবিষ্যত তিস্তার চুক্তির ক্ষেত্রে নতুন সংশয়ের জন্ম দিল।
একইভাবে ব্যবসায়ীদের অভিমত, দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় ভারত বাংলাদেশের তামাক ও মদজাতীয় ২৫টি পণ্য বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। তারপর থেকে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি বেশ সন্তোষজনক ছিল। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের নানা শুল্ক ও অশুল্ক বাধার কারণে সেই প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে সেই শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর করার ব্যাপারে কিছুর উল্লেখ না থাকায় ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়েছেন। তবে খুলনা-কলকাতা রুটে ট্রেন সার্ভিস চালু হওয়ার ফলে আঞ্চলিক সংযোগ বাড়বে এবং তাতে ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য বাধাও দূর হবে বলে আশা করেন তারা।
যদিও বাংলাদেশকে দেওয়া ৫০০ কোটি ডলার ঋণ উন্নয়ন ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি আনবে; তবে সে অর্থ ব্যয়ে বেধে দেওয়া শর্ত একটি বড় বাধা বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ঋণের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অংশ হিসেবে সামরিক কেনাকাটার জন্য রয়েছে ৫০ কোটি ডলার। ৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের বিষয়েও চুক্তি হয়েছে। সমঝোতা হয়েছে সীমান্তহাট চালু করার বিষয়ে এবং বাংলাদেশের বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে সহযোগিতার জন্যও। কলকাতা-খুলনা-ঢাকা বাস চলাচল এবং খুলনা-কলকাতা ট্রেন চলাচল, রাধিকারপুর-বিরল রেললাইন উদ্বোধন হয়েছে। এ ছাড়া আরো ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে দেবে ভারত। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ভারতের সমর্থন পাওয়ার কথা জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
সফরে কি পেল বাংলাদেশ—এ নিয়ে গতকাল প্রতিদিনের সংবাদের সঙ্গে কথা হয় দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের সঙ্গে।
এদের মধ্যে প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, জনগণের কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেগুলো পূরণ হয়নি। যেমন মানুষ আশা করেছিল সীমান্ত এলাকায় হত্যা বন্ধ হবে, এ দেশের পাট যাতে ভারতের বাজারে যেতে না পারে, সে জন্য পাটের এন্ট্রি ডাম্পিং নীতি নিয়েছে, পানির ব্যাপারটাও কিছুই হয়নি। সবমিলিয়ে এ সফর হতাশ করেছে। তবে সরকার রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে।
এমনকি ভারত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য যে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন, সে নিয়েও সন্তোষ্ট নন দেশের অর্থনীতিবিদরা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রথমত এ ধরনের ঋণ পরিহার করা ভালো। কারণ এসব কঠিন শর্তের ঋণ। দীঘসূত্রতার এসব ঋণের টাকায় নেওয়া প্রকল্পগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত করা যায় না। তা ছাড়া ভারতের ঋণ আসে সরকার থেকে। অনেক ধরনের শর্ত থাকে। এখনো ভারতের দ্বিতীয় দফার ঋণের টাকাই এসে পৌঁছায়নি। অনেক কাজ অসম্পন্ন রয়েছে। সবচেয়ে ভালো ছিল এ ধরনের ঋণ না নিতে পারলে। তারপরও যেহেতু নেওয়া হয়েছে, তাই এখন ঋণের টাকার সুষ্ঠু ব্যয়ের দিকে নজর রাখতে হবে। কাজের গুণগতমান নিশ্চিত করতে হবে। টাকা দ্রুত ছাড় করতে হবে। প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। দেরি হলে ব্যয় বেড়ে যাবে।
সাবেক কূটনীতিকদের মতে, এ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেলেও মৌলিক অর্জন কম। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, এ সফর শিষ্টাচার ও সৌজন্য আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ। কিন্তু জনজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত মৌলিক অগ্রগতি কম। যেমন অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা, তিস্তার পানি বণ্টন, গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট ফল আসেনি। সীমান্তে হত্যা বন্ধ নিয়েও কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসেনি। বাণিজ্য ক্ষেত্রে ভারতের ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ শুল্ক বাধা দূর করার বিষয়েও কোনো ফল দেখা যায়নি। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিত রাজনীতিতে আমরা আরো বেশি ভারতমুখী হলাম। দুই দেশের মধ্যে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে, সেগুলো থেকে কিভাবে বাস্তবে সুবিধা পাওয়া যেতে পারে, এখন তার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে।
বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমানের মতে, সফর ছিল ‘গতানুগতিক’। তিনি বলেন, যেসব চুক্তি এবং সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে তাতে ভারতের স্বার্থই বেশি সংরক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রাপ্তি খুবই কম। তিস্তা চুক্তি হলো না। কবে হবে তা-ও জানা গেল না। তিস্তার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বারবার বাংলাদেশকে বিভ্রান্ত করছেন। তাই এর জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরই ভরসা করতে হবে। ভারতের সংবিধানের ২৫৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় সরকারই যেকোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষমতা রাখে। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরই এ ইস্যুতে চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
অবশ্য প্রতিরক্ষা চুক্তির বদলে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক সই করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসিকতা দেখিয়েছেন বলে মত দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এ ব্যাপারে মেজর জেনারেল (অব.) আবদুুর রশিদ বলেন, এতে সামরিক কৌশলগত স্পর্শকাতর বিষয় নেই। ফলে এই স্মারক দেশের সার্বভৌম ও সামরিক সিদ্ধান্ত নিতে কোনো বাধার সৃষ্টি করবে না। দুই দেশের মধ্যকার প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করবে। দুই দেশের সামরিক সহযোগিতাকে কাছাকাছি আনবে। তবে ভারত সামরিক সরঞ্জামাদি কেনাকাটায় যে ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে, সেখানে কী অস্ত্র কেনা হবে, কী ধরনের অস্ত্র আমাদের প্রয়োজন, তা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত।
এলএবাংলাটাইমস/এন/এলআরটি