কলাম

রোহিঙ্গা ও উইঘুর— পার্থক্য শুধু মানচিত্রে

ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং ঝু বুধবার (২১ মার্চ) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে চীন নিরপেক্ষ থাকবে।’ মানে তারা ঘনিষ্ট মিত্রদেশ মিয়ানমারকে এ ব্যাপারে কিচ্ছুটি বলবে না। এর আগেও দেশটির তরফ থেকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে পরিষ্কার কোনো অবস্থান পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু চীন রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আসলেই কি নিরপেক্ষ ও নির্বিকার? তা হলে কেন, ভাবা দরকার।

বঙ্গোপসাগর বিধৌত উর্বর আরাকানে কেবল চীনের বিপুল অঙ্কের বন্দর-বাণিজ্যিক স্বার্থই জড়িত নেই, এর সঙ্গে যুক্ত কোনো ভিন্নমতাবলম্বী কিংবা ভিন্ন ধর্মাদর্শের জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চীনাদের উদ্ভাবিত ভয়াবহ ‘ঠান্ডা মাথার নিপীড়ন কৌশল’। মিয়ানমার তার বড়ভাই চীনের কাছ থেকে সেটি রপ্ত করে আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যবহারিকভাবে প্রয়োগ করেছে। সংগত কারণে চীন নিরপেক্ষ থাকার আবডালে দেখে নিচ্ছে তাদের কৌশল কতটা সফল হচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং বেসামরিক সরকারের বিতর্কিত ডি-ফ্যাক্টো অং সান সু কির হাতে।

আমাদের কেউ কেউ তবু রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনকে পাশে পেতে চান। তাদের একটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার, আরাকান তথা রাখাইনে যেভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা-নিপীড়ন চালিয়ে বাংলাদেশে বিতাড়িত করা হয়েছে এবং যা এখনও চলমান, ঠিক একই কাজটা গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে চীনা কর্তৃপক্ষ করছে দেশটির সংখ্যালঘু জাতিগাষ্ঠী উইঘুরদের ওপর।

উইঘুর অধ্যুষিত জিনজিয়াংয়ে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে চীন। সব রকমের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে উইঘুরদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবন। এমনকি নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে বিয়ে, সন্তানের নামকরণ থেকে শুরু করে নিজ অঞ্চলের বাইরে চলাচলের ওপর। এ ছাড়া প্রায় সময় চীনা পুলিশ ও সেনাদের হাতে মরছে নিরীহ উইঘুররা। নির্যাতিত হচ্ছে অজস্র নারী। সেখানকার ১ লাখ ২০ হাজার উইঘুরকে ‘পুনঃশিক্ষণ’ প্রকল্পের নামে এক ভয়ানক ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। এর বাইরে স্ব-ভূম ছাড়তে বাধ্য করেছে তিন লাখের বেশি উইঘুরকে, যারা বাধ্য হয়েছে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করতে।

মনে রাখা দরকার, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সংঘটিত নির্যাতন-নিপীড়নে এসব উপাদানের প্রাবল্য রয়েছে। উপরন্তু রাখাইনে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের জন্য চৈনিক কৌশলে ক্যাম্পও তৈরি সম্পন্ন করেছে প্রায়। ট্রানজিট ক্যাম্পের নামে তৈরি এসব ক্যাম্পেই রাখা হবে ফেরত নেয়া রোহিঙ্গাদের। (বাস্তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। নিলেও যাচাই-বাছাইয়ের নামে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নেবে তারা)। যদিও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, এসব ক্যাম্পে স্বল্পকাল রাখা হবে রোহিঙ্গাদের, কিন্তু আমার ধারণা এসব ক্যাম্পে চীনের উইঘুর দমন-পীড়নের কৌশলেরই পুনরাবৃত্তি করবে দেশটি।

এ পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে চীনের ‘নিরপেক্ষ’ থাকার ‘ভদ্রবেশ’ আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নয়। উইঘুর ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চীন ও মিয়ানমারের পরিকল্পিত দমন-পীড়নের যদ্দুর পাঠ ইতিহাস থেকে নিয়েছি, তাতে আমি মনে করি, এ দুই জাতিগোষ্ঠী একই রকমের দমন-পীড়ন কৌশলের সহজ শিকার।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, গবেষক