পরিবেশ

সময়ের সাক্ষী কুমিল্লার দীঘি ‘ধর্মসাগর’: ইতিহাস আর সংস্কৃতির অনন্য ধন

'ধর্মসাগর'। তবে এটি 'সাগর' নয় 'দিঘি'। ট্যাঙ্ক ও ব্যাংকের শহরখ্যাত প্রাচীন জেলা কুমিল্লার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এ দিঘিকে নগরীর ফুসফুসও বলা হয়। প্রায় পৌনে ৬০০ বছর আগে ত্রিপুরা রাজ্যের অধিপতি মহারাজা প্রথম ধর্মমাণিক্য এই দিঘিটি খনন করেন। দিঘিটি খননে দেড় হাজার শ্রমিকের দুই বছরের অধিক সময় লেগেছে। ধর্মসাগর নিয়ে রয়েছে অনেক উপাখ্যান ও উপকথা। এটি চারদিকে বৃক্ষশোভিত একটি মনোরম স্থান। ধর্মীয় উৎসব-বর্ষবরণ ছাড়াও বছরের সবসময় এখানে দেখা যায় প্রকৃতি ও বিনোদনপ্রেমীসহ দূরদূরান্তের দর্শনার্থীদের ঢল। ইতিহাসগ্রন্থ ঘেঁটে জানা গেছে, মহারাজা ধর্মমাণিক্য সুদীর্ঘ ৩২ বছর (১৪৩১-১৪৬২ খ্রি.) ত্রিপুরা রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। কুমিল্লা ও আশপাশের অনেক অঞ্চল তার রাজত্বের অধীনে ছিল। এ অঞ্চলে তার অনেক স্মৃতি রয়েছে। তিনি প্রজাদের পানীয় জলের সুবিধার জন্য আজ থেকে ৫৬৭ বছর আগে ১৪৫৮ খ্রিস্টাব্দে অপার সৌন্দর্যের ধর্মসাগর দিঘিটি খনন করেন। ২৩ দশমিক ১৮ একর আয়তনের এ দিঘিটি ১ হাজার ৫০০ শ্রমিকের ৭৩০ দিনের শ্রমে খনন করা হয়। মহারাজা ধর্মমাণিক্যের নামানুসারে এ দিঘির নামকরণ করা হয় 'ধর্মসাগর'। ১৯৬৪ সালে দিঘিটির পশ্চিম ও উত্তরপাড় পাকা করা হয়।
এরপর দিঘিটি বেশ কয়েক বার সংস্কার করা হয়। দিঘিটি আজও রাজা ধর্মমাণিক্যের রাজ্য এবং রাজাদের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এ দিঘির উত্তরপাড়ে রয়েছে পাঁচ একরের নগর উদ্যান ছাড়াও রাণীর কুঠি, একটি শিশু উদ্যান, কুমিল্লা আর্ট কলেজ ও কুমিল্লা নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র। দিঘির পূর্ব পাড়ে শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম ও কুমিল্লা জিলা স্কুল, পূর্ব-উত্তর কোণে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ, দক্ষিণ পাড়ে খ্রিস্টানদের চার্চ ও দক্ষিণ-পূর্ব কোণে কুমিল্লা বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন, টাউন হল মাঠ, কুমিল্লা ক্লাব। দিঘির পশ্চিম পাড়ে সীমানাপ্রাচীরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতের ফুল ও বাহারিগাছ লাগিয়ে পর্যটকদের জন্য আরো আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। এ দিঘির চারপাশ বিপুল সবুজ বৃক্ষের সমাহারে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পাখ-পাখালির কলকাকলিতে মুখর থাকে। ফলে সারা বছর ধরেই দূরদূরান্ত থেকে এ দিঘি দেখার জন্য আসেন পর্যটক, প্রকৃতি ও বিনোদনপ্রেমীরা। নানা প্রজাতির মৌসুমি ফুল ও অসংখ্য সবুজ বৃক্ষ ধর্মসাগরকে দিয়েছে এক নৈসর্গিক শোভা। শীত মৌসুমে ধর্মসাগরে প্রচুর পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। তাদের কিচিরমিচির শব্দে ধর্মসাগরের থই থই জলতরঙ্গে ছন্দায়িত হয় নতুন প্রাণের উচ্ছাস। ধর্মীয় উৎসব (ঈদ-পূজাপার্বন), বর্ষবরণ, বসন্তবরণ, আঞ্চলিক পর্যায়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও অবসর সময়ে হাজারো পর্যটকের ঢল নামে এ ধর্মসাগরপাড়ে। বিশুদ্ধ পরিবেশে প্রতিদিন প্রেমিক-প্রেমিকা, দম্পতি ও রসিকজনেরা প্রাণখুলে এই সাগরপাড়ে সময় কাটান। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণীসহ শিশুরা রাজহংস ও নৌকায় চড়ে নাচ-গানে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে।
এছাড়া নগরীর বিভিন্ন এলাকার প্রাতভ্রমণ ও সান্ধ্যভ্রমণকারী বয়োঃবৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষকে নির্মল পরিবেশে শারীরিক কসরৎ করতে দেখা যায়। এখানে স্বস্তির পরশে দর্শনার্থীদের মন যেন হারিয়ে যায় আপন মহিমায়। এদিকে ধর্মসাগর দিঘি পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তরের দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা ধর্মসাগর দিঘির চারপাশে রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণ, রেস্টহাউজ নির্মাণ, লাইটিং, দিঘিতে ভ্রমণের জন্য কয়েকটি স্পিডবোট, ময়ূরপঙ্খী ও বিভিন্ন রাইডস্ সংযোজন করাসহ দর্শনার্থীদের বসার সুব্যবস্থা করে সৌন্দর্যবর্ধনের দাবি জানিয়েছেন। কুমিল্লা নাগরিক ফোরামের সভাপতি কামরুল আহসান বাবুল বলেন, 'দেশে-বিদেশে এই দিঘির অনেক সুখ্যাতি রয়েছে। এটি নগরীর ফুসফুস। নগরের মানুষ বিনোদন কেন্দ্রের অভাবে এখন শ্বাস ফেলারও জায়গা পাচ্ছে না। আধুনিকায়ন করা হলে ধর্মসাগর একটি সম্ভাবনাময় দর্শনীয় বিনোদনের জায়গা হতে পারে।' কুসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু সায়েম ভূঁইয়া বলেন, 'ধর্মসাগর সংরক্ষণে জাইকার অর্থায়নে ৪৮ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় দিঘির চারপাশের পাড় বাঁধাই, আধুনিক ওয়াকওয়ে, বৃক্ষরোপণ এবং উত্তর-পূর্ব কর্নারে একটি ছোট ঝুলন্ত সেতু সেতু নির্মাণসহ অন্যান্য সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হবে।' এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস