আন্তর্জাতিক

কারাগার থেকে ক্ষমতার মসনদে এসেছিলেন যারা

মালয়েশিয়ার সুলতানের কাছ থেকে নিঃশর্ত ক্ষমা লাভের পর গতকাল সকালেই মুক্তি পান দেশটির সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। নিঃশর্ত ক্ষমার মাধ্যমে মুক্তিলাভ তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথকে আরো পোক্ত করেছে সন্দেহ নেই। গত শতাব্দীতেও ঠিক একইভাবে কারান্তরীণ থাকা অবস্থাতেই ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে এসেছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিখ্যাত অনেক নেতা।

আনোয়ারকে আজ থেকে ২০ বছর আগে ১৯৯৮ সালে তকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বিভিন্ন অভিযোগে প্রথমবার কারাগারে পাঠান। ছয় বছর পর ২০০৪ সালে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত সব অভিযোগ থেকে তাকে মুক্তি দিলে তিনি মুক্তি পান। এরপর ২০১৫ সালে সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক আবারো আনোয়ার ইব্রাহিমকে কারাগারে পাঠান।
৯২ বছর বয়স্ক মাহাথির অবসর ভেঙে আবারো রাজনীতিতে ফিরেছেন এবং মালয়েশিয়ায় গত সপ্তাহের ঐতিহাসিক ব্যালট বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নির্বাচনে জয়লাভের পর মাহাথির দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে বলেছেন, আগামী এক বা দুই বছর পর আনোয়ারের হাতে প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব দিয়ে তিনি অবসরে যাবেন।

সারা বিশ্বে অতীতে আরো পাঁচজন নেতা কারগারে বন্দী বা নির্বাসনে থাকা অবস্থাতেই ক্ষমতা গ্রহণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছান। কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব দেয়ায় ১৯৬২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। তার আগে ১৯৬১ সালে দেয়া এক ভাষণে ম্যান্ডেলা বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো শক্তিই নিপীড়িত মানুষের স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রামকে দমাতে পারে না।’

কারাদণ্ড দেয়ার পর ম্যান্ডেলাকে কুখ্যাত রবেন দ্বীপের কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তী ২৭ বছর তিনি এই কারাগারেই বন্দী থাকেন। দীর্ঘ ২৭ বছরের বন্দী জীবন ম্যান্ডেলাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য বিরোধী সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত করে। দেশটির সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ সরকারকে উৎখাত ও ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে সারা বিশ্বেই মিছিল সমাবেশের মাধ্যমে জনমত গড়ে ওঠে। পরে ১৯৯০ সালে তিনি মুক্তি পান। এর চার বছর পর সব দল, মত ও বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম নির্বাচনে ৭৫ বছর বয়সে নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা জেনারেল অং সান। তার মেয়ে অং সান সু চি তার বাবার অনুসৃত রাজনীতির পথে না হেঁটে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড শহরে শান্ত পারিবারিক জীবনই বেছে নিয়েছিলেন; কিন্তু ১৯৮৮ সালে তার মৃত্যুপথযাত্রী মাকে দেখতে ইয়াঙ্গুনে ফিরে আসেন। ঠিক একই সময়ে দেশটিতে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন ব্যর্থ হলেও তা সু চি’কে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে এনে দেয়। এরপর তাকে গৃহবন্দী করে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। দেশটিতে ২০১৫ সালের নির্বাচনে সু চির দল বিশাল জয়লাভ করে ও তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসে; কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে যে ইমেজ সারা বিশ্বে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তা তিনি ধরে রাখতে পারেননি। দেশটিতে তার দল ক্ষমতাসীন থাকা ও তিনি নিজে ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করার পরও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালায় এবং তাদের পৈতৃক ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে। জাতিসঙ্ঘ এই গণহত্যাকে জাতিগত নিধন বলে আখ্যায়িত করেছে। সারা বিশ্বে এই ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও সু চি ছিলেন একেবারেই নির্বিকার। ইতোমধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের খ্যাতনামা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সু চি’কে দেয়া তাদের বিভিন্ন উপাধি ও পুরস্কার প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এমনকি সু চির নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ারও দাবি উঠেছে। এটা স্পষ্ট যে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যার কারণে অং সান সু চি সারা বিশ্বেই নিন্দিত হয়েছেন ও তার পূর্বের অর্জিত ইতিবাচক ইমেজ হারিয়ে ফেলেছেন।

১৯২১ সালে প্রিন্স অব ওয়েলস ব্রিটিশ শাসিত ভারত সফরে আসেন। তখন ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে অবস্থান করছে। প্রিন্স অব ওয়েলসের এই সফর বয়কট করতে ব্রিটিশবিরোধী নেতা জওহরলাল নেহেরু সবার প্রতি আহ্বান জানালে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। তাকে কারাবন্দী করার এই আদেশকে ‘সবচেয়ে বড় বিনোদন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন নেহেরু নিজেই। আইন অমান্য করে আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে বিভিন্ন সময় নেহেরু সর্বমোট প্রায় এক দশক কারান্তরীণ থাকেন। পরে ১৯৪৭ সালে তিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তার দল ও তার পরিবারের উত্তরসূরিরা এখনো পর্যন্ত দেশটির রাজনীতিতে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী।

ভ্যাকলাভ হ্যাভেল ছিলেন একজন ভিন্নমতাবিলম্বী নাট্যকার। যুবক বয়সে তিনি অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় ব্যর্থ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে কিছুটা জড়িত ছিলেন হ্যাভেল। তার এই সামান্য সংশ্লিষ্টতাই পরে তাকে জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পুরোদমে সক্রিয় হতে চালিত করে। আন্দোলনে সক্রিয় থাকার অভিযোগে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয় এবং কারাগারে পাঠানো হয়। ১৯৮৯ সালে রেশম বিপ্লবের মাধ্যমে কমিউনিস্ট শাসনের ইতি ঘটিয়ে তিনি দেশটির ক্ষমতায় আসেন।

সাবেক সরকারি কর্মকর্তা বাবার হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন চিলির প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট মিশেল ব্যাচলেট। পরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় ব্যাচলেটকে আটক করা হয় এবং গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগে সাজা হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। অস্ট্রেলিয়া ও পূর্ব জার্মানিতে পাঁচ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে ১৯৭৯ সালে নিজ দেশ চিলিতে গণতন্ত্র ফেরাতে ফিরে আসেন। ২০০৬ সালে তিনি চিলির প্রথম নারী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

২০১৪-২০১৮ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করার পর বর্তমানে তিনি ‘জাতিসঙ্ঘের লিঙ্গ সমতা ও নারী ক্ষমতায়ন’ বিষয়ক সংস্থার নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।

এলএবাংলাটাইমস/আই/এলআরটি