ইসরায়েল গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, রাফাহ এলাকায় হামাসের যোদ্ধারা তাদের সৈন্যদের লক্ষ্য করে অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল ও গুলি ছোড়ে—যা “যুদ্ধবিরতি চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন”। এর জবাবে আইডিএফ হামলা শুরু করে।
আইডিএফ এক বিবৃতিতে জানায়, রাফাহ এলাকায় তাদের সেনারা “সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংসের অভিযানে” ছিল, সেই সময় এই হামলা হয়। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “আইডিএফ হুমকি নির্মূল করতে এবং সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত টানেল ও সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করতে অভিযান চালাচ্ছে।” ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে হামাসের লক্ষ্যবস্তুতে “দৃঢ়ভাবে ব্যবস্থা নিতে” নির্দেশ দেন।
অন্যদিকে, হামাস দাবি করেছে তারা রাফাহ এলাকায় কোনো সংঘর্ষ বা গোলাগুলির বিষয়ে অবগত নয়। হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসাম ব্রিগেডস জানায়, “এই এলাকাগুলোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কয়েক মাস ধরে বিচ্ছিন্ন। তাই সেখানে কী ঘটছে, তা আমরা জানি না।”
যুদ্ধবিরতি চুক্তি ও বন্দি বিনিময়
এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় গত ১০ অক্টোবর কার্যকর হয়। এর আওতায় প্রথম ধাপে সব জীবিত ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্ত করা হয়েছে এবং ২৮ জন নিহত বন্দির মধ্যে ১২ জনের মরদেহ ফেরত দেওয়া হয়েছে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল তাদের কারাগার থেকে ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দি, ১,৭১৮ জন গাজাবাসী আটক ব্যক্তি ও ১৫টি মরদেহ ফেরত দিয়েছে।
ইসরায়েল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে সংঘটিত হামলার পর গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে। ওই হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, সেই থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৬৮,০০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘ এই পরিসংখ্যানকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে স্বীকার করেছে।
অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও ইসরায়েলের অভিযোগ
বর্তমানে ইসরায়েলি বাহিনী গাজা উপত্যকার প্রায় ৫০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং একটি তথাকথিত “ইয়েলো লাইন”-এর পেছনে অবস্থান করছে। ১৮ বছর ধরে গাজা শাসনকারী হামাস এখন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। স্থানীয় সূত্রের দাবি, হামাসকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ইয়াসের আবু শাবাবের নেতৃত্বাধীন পপুলার ফোর্সেস, যারা ইসরায়েলের সহায়তায় সক্রিয় হয়েছে বলে অভিযোগ।
রবিবারের ঘটনাটি সম্পর্কে এক স্থানীয় সূত্র বিবিসিকে জানায়, হামাস যোদ্ধারা দক্ষিণ-পূর্ব রাফাহে আবু শাবাবের একটি সশস্ত্র দলকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়। এরপর ইসরায়েলি ট্যাংক থেকে পাল্টা গোলা নিক্ষেপ হয় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে যুদ্ধবিমান বোমা বর্ষণ শুরু করে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ইউরোপীয় হাসপাতালের দক্ষিণে ব্যাপক বিস্ফোরণ ও গোলাবর্ষণ ঘটে, এতে পুরো রাফাহ কেঁপে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
এই হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে যুক্তরাষ্ট্র জানায়, তাদের কাছে “বিশ্বস্ত তথ্য” রয়েছে যে হামাস গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর “আসন্ন হামলার” পরিকল্পনা করছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে জানায়, “এই হামলা যুদ্ধবিরতি চুক্তির গুরুতর লঙ্ঘন হবে।” যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে সতর্ক করে জানায়, তারা যদি হামলা চালায়, তবে “গাজার জনগণকে সুরক্ষা এবং যুদ্ধবিরতি রক্ষা” করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণে মিশর, কাতার ও তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করছে। হামাস অবশ্য এই অভিযোগ “সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন” বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি ও সাম্প্রতিক সহিংসতা
যুদ্ধবিরতির অন্যতম রূপকার ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি হামাসকে সতর্ক করে বলেছেন,
“যদি হামাস গাজায় মানুষ হত্যা চালিয়ে যায়—যা চুক্তির অংশ ছিল না—তাহলে আমাদের অন্য কোনো পথ থাকবে না।”
তবে পরে তিনি স্পষ্ট করেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো সেনা পাঠাবে না। এর মধ্যেই বিবিসি ভেরিফাই নিশ্চিত করেছে, হামাস যোদ্ধাদের হাতে গাজায় একাধিক সর্বজনীন মৃত্যুদণ্ডের ভিডিও সত্যি।
গত সপ্তাহে হামাস নিরাপত্তা বাহিনী ও দুগমুশ পরিবারভুক্ত সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষে অন্তত ২৭ জন নিহত হয়। এটি যুদ্ধবিরতির পর গাজার ভেতরে অন্যতম ভয়াবহ অভ্যন্তরীণ সংঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশ্লেষণ
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকর রাখতে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গাজার অভ্যন্তরে হামাস ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী না থাকলে এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নতুন করে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে—যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
এলএবাংলাটাইমস/ওএম