খেলাধুলা

বিশ্বকাপে খেলতে মুখিয়ে আফঈদা, আস্থার বার্তা ঋতুপর্ণার

রাত তখন প্রায় ৩টা, পুরো শহর ঘুমিয়ে। কিন্তু ঐ সময়টাতেই উৎসবের বাতাস বইছিল রাজধানীর হাতিরঝিলের এম্পিথিয়েটারের মঞ্চে। নিস্তব্ধ ঢাকার ঐ অঞ্চল যেন হঠাৎই জেগে উঠেছিল গর্ব আর ভালোবাসার এক দুর্লভ উপলক্ষ্য। ইতিহাস গড়ে এশিয়ান কাপের মূল পর্বে জায়গা করে নেওয়া বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল ফিরেছে দেশে। আর সেই বিজয়ীর প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে আয়োজন হয়েছিল ভোর রাতের এক অভূতপূর্ব সংবর্ধনার। 
যেখানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়ালসহ ফেডারেশনের কর্মকর্তাসহ উপস্থিত ছিল কয়েক শ ফুটবল সমর্থক। সেখানে ঘুম জড়ানো চোখে, বিজয়ের আলো মুখে নিয়ে মঞ্চে ওঠেন আফঈদা, ঋতুপর্ণা, মনিকারা। মধ্যরাতে এমন আয়োজনে তাদের লম্বা ভ্রমণক্লান্তি যেন সব কেটে সবার মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি। এ অনুষ্ঠানে দলের মেসি খ্যাতি পাওয়া ঋতুপর্ণা চাকমা সবাইকে দলের প্রতি আস্থা রাখার অনুরোধ জানান, অধিনায়ক আফঈদা স্বপ্ন দেখান বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করার।  
রোববার দিবাগত রাত দেড়টায় মিয়ানমার থেকে ব্যাংকক হয়ে ঢাকায় পা রাখে বাংলাদেশ নারী দল। সেখানে তাদের ফুল দিয়ে বরণ করেন বাফুফের কর্তারা। সেখান থেকে সংবর্ধনার টিম বাসে করে নিয়ে আসা হয় হাতিরঝিলে সাজানো মঞ্চে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে ফের একবার ফেডারেশনের পক্ষ থেকে দল গ্রহণ করে ফুলেল শুভেচ্ছা। মধ্যরাতের এই অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও গোলরক্ষক আমিনুল হক সবাইকে অভিনন্দন জানান। এ সময় উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের ফুটবলের ক্রেজ এটাই। দেশের মানুষ ফুটবলকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, এটাই তার প্রমাণ।' সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নারী দলের মেসি খ্যাত তারকা ফরোয়ার্ড ঋতুপর্ণা চাকমার কথায় ফুটে ওঠে দেশের সংগ্রামী মেয়েদের প্রতিচ্ছবি। তার জোড়া গোলে মিয়ানমারকে হারিয়ে চূড়ান্ত পর্বে যাওয়ার টিকিট নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। ঋতুপর্ণা বলেন, 'প্রথমেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি দর্শকবৃন্দকে। এত রাতে আমাদের বরণ করে নেওয়ার জন্য। সভাপতি ও কিরণ ম্যাডামকে অভিনন্দন, এত কষ্ট করে এই আয়োজন করার জন্য। বর্তমানে আমরা যে পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি-এটা হয়েছে দলীয় প্রচেষ্টায়, ফুটবল কোনো ব্যক্তিগত নৈপুণ্যনির্ভর খেলা নয়। আমরা বাংলাদেশের মেয়েরা জানি, কীভাবে কঠিন পরিস্থিতিতে লড়াই করতে হয়। আপনারা আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখবেন, আমরা আপনাদের নিরাশ করবো না। আমরা শুধু এশিয়া নয়, বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চাই।'   এ দিকে অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন নারী কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণের প্রতি। তিনি বলেন, 'প্রথমেই ধন্যবাদ জানাতে চাই, ফেডারেশনের সভাপতি তাবিথ আউয়াল স্যার, কিরণ (মাহফুজা আক্তার) ম্যাডামসহ সবাইকে এত রাতে এত সুন্দর একটা আয়োজনের জন্য। আমাদের এই সাফল্য এক দিনে আসেনি। এই সাফল্যের পেছনের একজনের কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন কিরণ ম্যাডাম। তার এতদিনের পরিশ্রমের ফল আমরা এখন পাচ্ছি। তাই ব্যক্তিগতভাবে এবং সকল টিমম্যাটের পক্ষ থেকে ম্যাডামকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।'  এ সময় বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চান এমন আশা ব্যক্ত করে তিনি আরও বলেন, 'এই মুহূর্ত ভোলার মতো নয়। সকলে দোয়া করবেন আমরা যাতে আরও ভালো কিছু করতে পারি। কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয়, এশিয়াও নয় বাংলাদেশকে যেন বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যেতে পারি।' কোচ পিটার জেমস বাটলার মাইক্রোফোন হাতে প্রথমেই সবাইকে আসসালামু আলাইকুম বলেন। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত দর্শক সালামের জবাব দেন। ইতিহাস গড়া মেয়েদের প্রশংসায় ভাসালেন। তিনি বলেন, 'আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিব। কারণ সকাল হতে বেশি দেরি নেই। আমি এই সময়ে কথা বলতে অভ্যস্ত নই।'    নিজেদের পরিশ্রমের কথা শুনিয়ে তিনি আরও বলেন, 'এটা কঠিন একটা সপ্তাহ ছিল এবং আমি বলবো, সম্ভবত এটা স্রেফ কঠিন একটা সপ্তাহ ছিল না, কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সবশেষ ৯ থেকে ১২ সপ্তাহ আমাদের অনেক কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। গত বছর থেকে যেটা শুরু হয়েছিল, আমাদের ওঠা-নামার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। টালমাটাল সময় ছিল। তবে, এই মেয়েদের ছাড়া আজ আমরা এখানে থাকতে পারতাম না।' সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী প্রশংসায় ভাসান ঋতুপর্ণাকে। তিনি বলেন, 'খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ। আপনারা দুর্দান্ত। আমি আপনাদের খেলা দেখেছি। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জয়ের পর আমি ফেসবুকে লিখেছিলাম, বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের মধ্যে ঋতুপর্ণা আমার ফেভারিট। একটু কারেকশন করতে চাই। এখন আর ঋতুপর্ণা শুধু আমার পছন্দের খেলোয়াড়ই না, আপনি (ঋতুপর্ণা) আমার কাছে ফেভারিট স্পোর্টস পার্সোনালিটি। আপনি যেভাবে বলেছেন, আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখবেন, বাংলাদেশের মেয়েরা জানে কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দৌড়াতে হয়, এটা অসাধারণ। আসলে এটাই প্রমাণ করে, আপনারা কারা এবং কী করার সামর্থ্য রাখেন।' এ সময় বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল বলেন, 'আপনারা দুটি কাজ করেছেন। নতুন করে ইতিহাস লিখছেন এবং আমাদের সমাজের মন-মানসিকতা বদলানোর একটা যাত্রায় আমাদের এগিয়ে নিচ্ছেন। আমরা ১৮ কোটি মানুষ, এটা একটা টিম ওয়ার্ক। আপনারা এগিয়ে যান। পেছনে তাকাতে হবে না, আমাদের জন্য। সমর্থন, দোয়া এবং সমস্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগাব। আপনারা শুধু আপনাদের কাজটা চালিয়ে যান। এখন আমাদের একটাই লক্ষ্য সেটা হল মিশন অস্ট্রেলিয়া।'   এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস