সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সাজা বহাল থাকায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিকাষ্ঠেই যেতে হবে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার মাত্র দুই মিনিটে এই রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেন। আর সর্বোচ্চ সাজার এই রায় আসে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টায় বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে।
এই বেঞ্চের বাকি তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
এই প্রথম বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করা কোনো রাজনীতিবিদ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলতে যাচ্ছেন।
বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মুজাহিদই যে চার দশক আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণকে দমাতে গঠিত আলবদর বাহিনীর মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তা উঠে আসে এই মামলার রায়ে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপরণের পর হত্যা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ওই দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছিল বিচারিক আদালত।
একই রায় এসেছিল সপ্তম অভিযোগে, ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা-নিযার্তনের ঘটনায়।
আপিল বিভাগের রায়ে প্রথম অভিযোগে আসামির আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। সপ্তাম অভিযোগে তার সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
আর ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
পঞ্চম অভিযোগে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, গেরিলা যাদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফি ইমাম রুমি, বদিউজ্জামান, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদসহ কয়েকজনকে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে আটকে রেখে নির্যাতন এবং জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার জন্য ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদকে দেয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আপিল বিভাগের রায়ে সেই সাজাই বহাল রাখা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে তৃতীয় অভিযোগে ফরিদপুর শহরের খাবাসপুরের রণজিৎ নাথকে অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় মুজাহিদকে। ওই সাজা তার প্রাপ্য বলে আপিল বিভাগও মনে করেছে।
এছাড়া দ্বিতীয় অভিযোগে ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে হিন্দু গ্রামে গণহত্যা এবং চতুর্থ অভিযোগে আলফাডাঙ্গার আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলেও তাতে মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে খালাস দিয়েছিল। এ কারণে এ দুটি অভিযোগ আপিল বিভাগের রায়ে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে মুজাহিদ হলেন চতুর্থ ব্যক্তি, আপিল বিভাগে যার মামলার নিষ্পত্তি হল।
২১ অগাস্ট গ্রেনেড মামলায় হাজিরার জন্য মুজাহিদকে আগের দিন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। আপিল বিভাগ যখন যুদ্ধাপরাধ মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করছে, ৬৭ বছর বয়সী এই জামায়াত নেতা তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল থাকায় আদালতের বাইরে এ মামলার সাক্ষী ও মুক্তিযোদ্ধারা সন্তোষ প্রকাশ করেন।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মুজাহিদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ এ মামলায় ছিল না বলেই তিনি মনে করেন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পেলেই তারা রিভিউ আবেদন করবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “রায়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এটা বিচার। বিচারিক প্রক্রিয়ায় হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।”
অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, আসামি মুজাহিদের ফাঁসির রায় এসেছে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে। এই রায়ে বাংলাদেশের সবাই খুশি হবে।
“এক শতাব্দীতে এরকম বুদ্ধিজীবী তৈরি হবে না। তবে এইটুকু সান্ত্বনা, বিচার পাওয়া গেল।”
নিয়ম অনুযায়ী, এখন আপিলের রায় ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। সেটি হাতে পেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে ট্রাইব্যুনাল। সেই মৃত্যু পরোয়ানা ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনাবে কারা কর্তৃপক্ষ।
সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ। তবে রায়ের নির্ভরযোগ্যতায় ‘খাদ আছে’ বা ‘বিচার-বিভ্রাটের’ আশঙ্কা আছে বলে মনে করলেই আদালত তা পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রহণ করবে।
রিভিউ যে আপিলের সমকক্ষ হবে না, তা যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ‘রিভিউ’ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়েই স্পষ্ট করা হয়েছে।
রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে এবং তাতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।
দুই জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায় বাস্তবায়নের আগে পালিত প্রক্রিয়াগুলো এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসাবে থাকছে।
বদর নেতা থেকে মন্ত্রী
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি, ফরিদপুর জেলার পশ্চিম খাবাসপুরে। ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পাসের পর তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন এবং উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালেই জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তাকে সংগঠনের জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯৭১ সালে বাংলার মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই বছর জানুয়ারিতে ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি হন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জুলাই মাসে সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারির এবং এরপর প্রাদেশিক সভাপতির দায়িত্ব পান।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার সভাপতি ও জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী। অক্টোবরে ওই বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ।
তার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী যুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায় বলে আদালতের রায়ে উঠে এসেছে। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন মুজাহিদ।
একাত্তরে তার কর্মকাণ্ডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকেও যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
স্বাধীনতার পর মুজাহিদ জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং ১৯৮২ সালে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৮৯ থেকে দুই বছর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হন তিনি।
কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলেও বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুজাহিদ। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের পরিচালনা পর্ষদেরও প্রধান ছিলেন তিনি।
যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২০১০ সালের মার্চে জামায়াতে ইসলামীর এক সংবাদ সম্মেলনে মুজাহিদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো ধরনের অপরাধে জামায়াত নেতারা জড়িত ছিলেন না।
বিচার পরিক্রমা
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করার পর ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
মামলার শুনানি শেষে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ২১ জুন ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিচার শুরু হয়।
২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ট্রাইব্যুনালে এই জামায়াত নেতার ফাঁসির রায় আসে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১১ অগাস্ট আপিল করেন মুজাহিদ।
রাষ্ট্রপক্ষ আপিল না করলেও শুনানিতে অংশ নিয়ে দণ্ড বহাল রাখতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। গত ২৯ এপ্রিল শুনানি শুরুর পর মঙ্গল ও বুধবার যুক্তি উপস্থাপনসহ নয় দিন আপিলের ওপর শুনানি গ্রহণ করেন বেঞ্চের চার বিচারপতি।
রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল মো. রশির আহমেদ।
আদালতে আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাজাহান। সঙ্গে ছিলেন শিশির মনির।
চতুর্থ রায়
ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত হওয়া ১৯টি মামলার রায়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৩টিতে দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আবুল কালাম আযাদ, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান এবং ফরিদপুরের জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকার পলাতক থাকায় এ সুযোগ পাননি।
আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল জব্বারও একই কারণে আপিল করতে পারেননি।
মুজাহিদের মামলাসহ চূড়ান্ত রায় এসেছে চার মামলায়।
এর আগে গত ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সর্বোচ্চ সাজা দিলে চলতি বছর ১১ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং তার ঠিক এক বছর আগে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
আপিল শুনানি চলাকালেই মৃত্যু হয়েছে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের।
এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিল মঙ্গলবার আদালতের কার্যতালিকায় আসে।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার মাত্র দুই মিনিটে এই রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেন। আর সর্বোচ্চ সাজার এই রায় আসে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টায় বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে।
এই বেঞ্চের বাকি তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
এই প্রথম বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করা কোনো রাজনীতিবিদ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলতে যাচ্ছেন।
বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মুজাহিদই যে চার দশক আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণকে দমাতে গঠিত আলবদর বাহিনীর মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তা উঠে আসে এই মামলার রায়ে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপরণের পর হত্যা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ওই দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছিল বিচারিক আদালত।
একই রায় এসেছিল সপ্তম অভিযোগে, ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা-নিযার্তনের ঘটনায়।
আপিল বিভাগের রায়ে প্রথম অভিযোগে আসামির আপিল মঞ্জুর করে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। সপ্তাম অভিযোগে তার সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
আর ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
পঞ্চম অভিযোগে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, গেরিলা যাদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, শহীদজননী জাহানারা ইমামের ছেলে শাফি ইমাম রুমি, বদিউজ্জামান, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদসহ কয়েকজনকে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে আটকে রেখে নির্যাতন এবং জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার জন্য ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদকে দেয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আপিল বিভাগের রায়ে সেই সাজাই বহাল রাখা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে তৃতীয় অভিযোগে ফরিদপুর শহরের খাবাসপুরের রণজিৎ নাথকে অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় মুজাহিদকে। ওই সাজা তার প্রাপ্য বলে আপিল বিভাগও মনে করেছে।
এছাড়া দ্বিতীয় অভিযোগে ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে হিন্দু গ্রামে গণহত্যা এবং চতুর্থ অভিযোগে আলফাডাঙ্গার আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলেও তাতে মুজাহিদের সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে খালাস দিয়েছিল। এ কারণে এ দুটি অভিযোগ আপিল বিভাগের রায়ে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে মুজাহিদ হলেন চতুর্থ ব্যক্তি, আপিল বিভাগে যার মামলার নিষ্পত্তি হল।
২১ অগাস্ট গ্রেনেড মামলায় হাজিরার জন্য মুজাহিদকে আগের দিন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। আপিল বিভাগ যখন যুদ্ধাপরাধ মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করছে, ৬৭ বছর বয়সী এই জামায়াত নেতা তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল থাকায় আদালতের বাইরে এ মামলার সাক্ষী ও মুক্তিযোদ্ধারা সন্তোষ প্রকাশ করেন।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মুজাহিদের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ এ মামলায় ছিল না বলেই তিনি মনে করেন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পেলেই তারা রিভিউ আবেদন করবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “রায়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এটা বিচার। বিচারিক প্রক্রিয়ায় হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।”
অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, আসামি মুজাহিদের ফাঁসির রায় এসেছে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে। এই রায়ে বাংলাদেশের সবাই খুশি হবে।
“এক শতাব্দীতে এরকম বুদ্ধিজীবী তৈরি হবে না। তবে এইটুকু সান্ত্বনা, বিচার পাওয়া গেল।”
নিয়ম অনুযায়ী, এখন আপিলের রায় ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে। সেটি হাতে পেলে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে ট্রাইব্যুনাল। সেই মৃত্যু পরোয়ানা ফাঁসির আসামিকে পড়ে শোনাবে কারা কর্তৃপক্ষ।
সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ। তবে রায়ের নির্ভরযোগ্যতায় ‘খাদ আছে’ বা ‘বিচার-বিভ্রাটের’ আশঙ্কা আছে বলে মনে করলেই আদালত তা পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রহণ করবে।
রিভিউ যে আপিলের সমকক্ষ হবে না, তা যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ‘রিভিউ’ খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায়েই স্পষ্ট করা হয়েছে।
রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়ে গেলে এবং তাতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে আসামিকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে গেলে সরকার কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।
দুই জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায় বাস্তবায়নের আগে পালিত প্রক্রিয়াগুলো এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসাবে থাকছে।
বদর নেতা থেকে মন্ত্রী
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি, ফরিদপুর জেলার পশ্চিম খাবাসপুরে। ১৯৬৪ সালে মাধ্যমিক পাসের পর তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন এবং উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালেই জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তাকে সংগঠনের জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯৭১ সালে বাংলার মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই বছর জানুয়ারিতে ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি হন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জুলাই মাসে সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারির এবং এরপর প্রাদেশিক সভাপতির দায়িত্ব পান।
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার সভাপতি ও জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী। অক্টোবরে ওই বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ।
তার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী যুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায় বলে আদালতের রায়ে উঠে এসেছে। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন মুজাহিদ।
একাত্তরে তার কর্মকাণ্ডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী পলাতক আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকেও যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
স্বাধীনতার পর মুজাহিদ জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং ১৯৮২ সালে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৮৯ থেকে দুই বছর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হন তিনি।
কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে না পারলেও বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুজাহিদ। জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের পরিচালনা পর্ষদেরও প্রধান ছিলেন তিনি।
যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২০১০ সালের মার্চে জামায়াতে ইসলামীর এক সংবাদ সম্মেলনে মুজাহিদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো ধরনের অপরাধে জামায়াত নেতারা জড়িত ছিলেন না।
বিচার পরিক্রমা
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করার পর ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
মামলার শুনানি শেষে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ২১ জুন ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিচার শুরু হয়।
২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ট্রাইব্যুনালে এই জামায়াত নেতার ফাঁসির রায় আসে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১১ অগাস্ট আপিল করেন মুজাহিদ।
রাষ্ট্রপক্ষ আপিল না করলেও শুনানিতে অংশ নিয়ে দণ্ড বহাল রাখতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। গত ২৯ এপ্রিল শুনানি শুরুর পর মঙ্গল ও বুধবার যুক্তি উপস্থাপনসহ নয় দিন আপিলের ওপর শুনানি গ্রহণ করেন বেঞ্চের চার বিচারপতি।
রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল মো. রশির আহমেদ।
আদালতে আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাজাহান। সঙ্গে ছিলেন শিশির মনির।
চতুর্থ রায়
ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত হওয়া ১৯টি মামলার রায়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৩টিতে দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আবুল কালাম আযাদ, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান এবং ফরিদপুরের জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকার পলাতক থাকায় এ সুযোগ পাননি।
আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল জব্বারও একই কারণে আপিল করতে পারেননি।
মুজাহিদের মামলাসহ চূড়ান্ত রায় এসেছে চার মামলায়।
এর আগে গত ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সর্বোচ্চ সাজা দিলে চলতি বছর ১১ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং তার ঠিক এক বছর আগে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
আপিল শুনানি চলাকালেই মৃত্যু হয়েছে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের।
এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিল মঙ্গলবার আদালতের কার্যতালিকায় আসে।