আজ ২৩ জুন ঐতিহাসিক পলাশী ট্রাজেডি দিবস। ২৫৮ বছর আগে এ দিনে পলাশীর আম বাগানে
ইংরেজদের সঙ্গে এক যুদ্ধে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে
অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। পরাজয়ের পর নবাবের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও
উপমহাদেশের মানুষ নবাবকে আজও শ্রদ্ধা জানায়। তার সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাদের
স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। ইতিহাসবিদ নিখিল নাথ রায়ের লেখা 'মুর্শিদাবাদ কাহিনী' থেকে জানা যায়,
নবাবের সেনা বাহিনীর তুলনায় ইংরেজদের সেনা সংখ্যা ছিল অনেক কম। সেখানে বিশ্বাসঘাতকতা না
হলে নবাবের বিজয় ছিল সুনিশ্চিত।
ষোল শতকের শেষের দিকে ওলন্দাজ, পর্তুগীজ ও ইংরেজদের প্রাচ্যে ব্যাপক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে।
এক পর্যায়ে ইংরেজরা হয়ে যায় অগ্রগামী। এদিকে বাংলার সুবাদার-দিওয়ানরাও ইংরেজদের সাথে
সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৭১৯ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। তার মৃত্যুর পর ওই
বছরই সুজাউদ্দিন খাঁ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসন লাভ করেন। এই ধারাবাহিকতায় আলীবর্দী
খাঁর পর ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হন।
তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। তরুণ নবাবের সাথে ইংরেজদের বিভিন্ন কারণে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
এছাড়া রাজ সিংহাসনের জন্য লালায়িত ছিলেন সিরাজের পিতামহ আলীবর্দী খাঁর বিশ্বস্ত অনুচর মীর
জাফর ও খালা ঘষেটি বেগম। ইংরেজদের সাথে তারা যোগাযোগ স্থাপন ও কার্যকর করে নবাবের
বিরুদ্ধে নীলনকশা পাকাপোক্ত করে।
দিন যতই গড়াচ্ছিল এ ভূখন্ডের আকাশে ততই কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছিল। ১৭৫৭ সালের ২৩
এপ্রিল কলকাতা পরিষদ নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার পক্ষে প্রস্তাব পাস করে। এই প্রস্তাব কার্যকর
করতে ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ রাজদরবারের অভিজাত সদস্য উমিচাঁদকে ‘এজেন্ট' নিযুক্ত
করেন। এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়ক মীর জাফর তা আঁচ করতে পেরে নবাব তাকে প্রধান সেনাপতির
পদ থেকে অপসারণ করে আব্দুল হাদীকে অভিষিক্ত করেন। কূটচালে পারদর্শী মীর জাফর পবিত্র
কুরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করায় নবাবের মন গলে যায় এবং মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতি পদে
পুনর্বহাল করেন। সমসাময়িক ঐতিহাসিক বলেন, এই ভুল সিদ্ধান্তই নবাব সিরাজের জন্য ‘কাল' হয়ে
দাঁড়ায়।
ইংরেজ কর্তৃক পূর্ণিয়ার শওকত জঙ্গকে সাহায্য করা, মীরজাফরের সিংহাসন লাভের বাসনা ও
ইংরেজদের পুতুল নবাব বানানোর পরিকল্পনা, ঘষেটি বেগমের সাথে ইংরেজদের যোগাযোগ, নবাবের
নিষেধ সত্ত্বেও ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সংস্কার, কৃষ্ণ বল্লভকে কোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় দান প্রভৃতি
কারণে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আমবাগানে সকাল সাড়ে ১০টায়
ইংরেজ ও নবাবের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মীর মদন ও মোহন লালের বীরত্ব সত্ত্বেও জগৎশেঠ,
রায় দুর্লভ, উর্মিচাঁদ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ কুচক্রী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে
নবাবের পরাজয় ঘটে। সেই সাথে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য পৌনে দু'শ বছরের জন্য অস্তমিত হয়।
ঐতিহাসিক মেলেসন পলাশীর প্রান্তরে সংঘর্ষকে ‘যুদ্ধ' বলতে নারাজ। তার মতে, ‘নবাবের পক্ষে ছিল
৫০ হাজার সৈন্য আর ইংরেজদের পক্ষে মাত্র ৩ হাজার সৈন্য। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী ও কুচক্রী
মীরজাফর, রায় দুর্লভ ও খাদেম হোসেনের অধীনে নবাব বাহিনীর একটি বিরাট অংশ পলাশীর
প্রান্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কার্যত কোনো অংশগ্রহণই করেনি। এই কুচক্রীদের চক্রান্তে যুদ্ধের
প্রহসন হয়েছিলো।' আরেক ঐতিহাসিক ড. রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন
ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর যদি মীর জাফরকে বন্দি করতেন, তবে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী ভয় পেয়ে
যেতো এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে পলাশীর যুদ্ধ হতো না।'
ইতিহাসবিদ মোবাশ্বের আলী তার ‘বাংলাদেশের সন্ধানে' গ্রন্থে লিখেছেন, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রায়
লাখ সেনা নিয়ে ক্লাইভের স্বল্পসংখ্যক সেনার কাছে পরাজিত হন মীর জাফরের মোনাফেকীতে'। অতি
ঘৃণ্য মীর জাফরের কুষ্ঠরোগে মৃত্যু হয়। কিন্তু বাংলাদের ট্রাজেডি এই যে, মীর জাফরেরা বার বার
গোর থেকে উঠে আসে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মীর জাফর ও ঘষেটি বেগম প্রচন্ড ক্ষমতালোভী ও
জাতীয়তাবিরোধী ছিলেন। ধারাবাহিকতা রক্ষায় তাদের উত্তরসূরীরাও একই আচরণ অব্যাহত
রেখেছে। তারা এ দেশকে ‘কলোনি' বানাবার স্বপ্নে বিভোর।
ইংরেজদের সঙ্গে এক যুদ্ধে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে
অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। পরাজয়ের পর নবাবের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও
উপমহাদেশের মানুষ নবাবকে আজও শ্রদ্ধা জানায়। তার সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাদের
স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। ইতিহাসবিদ নিখিল নাথ রায়ের লেখা 'মুর্শিদাবাদ কাহিনী' থেকে জানা যায়,
নবাবের সেনা বাহিনীর তুলনায় ইংরেজদের সেনা সংখ্যা ছিল অনেক কম। সেখানে বিশ্বাসঘাতকতা না
হলে নবাবের বিজয় ছিল সুনিশ্চিত।
ষোল শতকের শেষের দিকে ওলন্দাজ, পর্তুগীজ ও ইংরেজদের প্রাচ্যে ব্যাপক বাণিজ্যের প্রসার ঘটে।
এক পর্যায়ে ইংরেজরা হয়ে যায় অগ্রগামী। এদিকে বাংলার সুবাদার-দিওয়ানরাও ইংরেজদের সাথে
সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৭১৯ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। তার মৃত্যুর পর ওই
বছরই সুজাউদ্দিন খাঁ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসন লাভ করেন। এই ধারাবাহিকতায় আলীবর্দী
খাঁর পর ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হন।
তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। তরুণ নবাবের সাথে ইংরেজদের বিভিন্ন কারণে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
এছাড়া রাজ সিংহাসনের জন্য লালায়িত ছিলেন সিরাজের পিতামহ আলীবর্দী খাঁর বিশ্বস্ত অনুচর মীর
জাফর ও খালা ঘষেটি বেগম। ইংরেজদের সাথে তারা যোগাযোগ স্থাপন ও কার্যকর করে নবাবের
বিরুদ্ধে নীলনকশা পাকাপোক্ত করে।
দিন যতই গড়াচ্ছিল এ ভূখন্ডের আকাশে ততই কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছিল। ১৭৫৭ সালের ২৩
এপ্রিল কলকাতা পরিষদ নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার পক্ষে প্রস্তাব পাস করে। এই প্রস্তাব কার্যকর
করতে ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ রাজদরবারের অভিজাত সদস্য উমিচাঁদকে ‘এজেন্ট' নিযুক্ত
করেন। এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়ক মীর জাফর তা আঁচ করতে পেরে নবাব তাকে প্রধান সেনাপতির
পদ থেকে অপসারণ করে আব্দুল হাদীকে অভিষিক্ত করেন। কূটচালে পারদর্শী মীর জাফর পবিত্র
কুরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করায় নবাবের মন গলে যায় এবং মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতি পদে
পুনর্বহাল করেন। সমসাময়িক ঐতিহাসিক বলেন, এই ভুল সিদ্ধান্তই নবাব সিরাজের জন্য ‘কাল' হয়ে
দাঁড়ায়।
ইংরেজ কর্তৃক পূর্ণিয়ার শওকত জঙ্গকে সাহায্য করা, মীরজাফরের সিংহাসন লাভের বাসনা ও
ইংরেজদের পুতুল নবাব বানানোর পরিকল্পনা, ঘষেটি বেগমের সাথে ইংরেজদের যোগাযোগ, নবাবের
নিষেধ সত্ত্বেও ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সংস্কার, কৃষ্ণ বল্লভকে কোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় দান প্রভৃতি
কারণে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আমবাগানে সকাল সাড়ে ১০টায়
ইংরেজ ও নবাবের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মীর মদন ও মোহন লালের বীরত্ব সত্ত্বেও জগৎশেঠ,
রায় দুর্লভ, উর্মিচাঁদ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ কুচক্রী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে
নবাবের পরাজয় ঘটে। সেই সাথে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য পৌনে দু'শ বছরের জন্য অস্তমিত হয়।
ঐতিহাসিক মেলেসন পলাশীর প্রান্তরে সংঘর্ষকে ‘যুদ্ধ' বলতে নারাজ। তার মতে, ‘নবাবের পক্ষে ছিল
৫০ হাজার সৈন্য আর ইংরেজদের পক্ষে মাত্র ৩ হাজার সৈন্য। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী ও কুচক্রী
মীরজাফর, রায় দুর্লভ ও খাদেম হোসেনের অধীনে নবাব বাহিনীর একটি বিরাট অংশ পলাশীর
প্রান্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কার্যত কোনো অংশগ্রহণই করেনি। এই কুচক্রীদের চক্রান্তে যুদ্ধের
প্রহসন হয়েছিলো।' আরেক ঐতিহাসিক ড. রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন
ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর যদি মীর জাফরকে বন্দি করতেন, তবে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী ভয় পেয়ে
যেতো এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে পলাশীর যুদ্ধ হতো না।'
ইতিহাসবিদ মোবাশ্বের আলী তার ‘বাংলাদেশের সন্ধানে' গ্রন্থে লিখেছেন, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রায়
লাখ সেনা নিয়ে ক্লাইভের স্বল্পসংখ্যক সেনার কাছে পরাজিত হন মীর জাফরের মোনাফেকীতে'। অতি
ঘৃণ্য মীর জাফরের কুষ্ঠরোগে মৃত্যু হয়। কিন্তু বাংলাদের ট্রাজেডি এই যে, মীর জাফরেরা বার বার
গোর থেকে উঠে আসে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মীর জাফর ও ঘষেটি বেগম প্রচন্ড ক্ষমতালোভী ও
জাতীয়তাবিরোধী ছিলেন। ধারাবাহিকতা রক্ষায় তাদের উত্তরসূরীরাও একই আচরণ অব্যাহত
রেখেছে। তারা এ দেশকে ‘কলোনি' বানাবার স্বপ্নে বিভোর।