কালিহাতী সাতুটিয়ায় মা ও ছেলেকে
বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার জেরে
এলাকাবাসী ও পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ
হয়ে তিনজন নিহত ও প্রায় অর্ধশত আহত
হয়েছেন। নিহতরা হচ্ছেন- কালিহাতীর
সাতুটিয়া গ্রামের ফারুক, ঘাটাইলের সালেঙ্গা
গ্রামের শামীম ও হরিপুর গ্রামের শ্যামল।
আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ সাতজনকে
টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
ভর্তির পর আশংকাজনক অবস্থায় চারজনকে ঢাকা
মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে।
ঢাকা
মেডিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে ভর্তিরা
হচ্ছেন- কালিহাতীর সমীর, ঘাটাইল
হরিপুরের ইউসুফ, রুবেল ও লিটন এবং টাঙ্গাইল
মেডিকেলে চিকিৎসাধীন আছেন ঘাটাইল
হরিপুরের সাইদ, গারোবাজারের শামসুল ও
শামীম। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ১০ জনকে
আটক করেছে। শুক্রবার বিকালে কালিহাতী
সদরের পার্শ্ববর্তী ঘাটাইল থানার হামিদপুর বাজার ও
কালিহাতী বাস স্ট্যান্ডে দুই থানার কয়েক হাজার
বিক্ষুব্ধ মানুষের সঙ্গে পুলিশের দু’দফা সংঘর্ষে
এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কালিহাতী থানার
এসআই ফারুক, কনস্টেবল লিয়াকত ও হারুন গুরুতর
আহত হন। নিহতদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা
ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা প্রদান, আহতদের উন্নত চিকিৎসায়
অর্থদান এবং ভিকটিম পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়ার
ব্যাপারে রাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও
র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। এলাকায়
উত্তেজনা বিরাজ করছে। এ সংঘর্ষের কারণে
প্রায় ৪ ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। টাঙ্গাইল-
ময়মনসিংহ সড়কের কালিহাতী বাস স্ট্যান্ডের
উত্তরে ও দক্ষিণে দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার
এলাকাজুড়ে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে এ
রুটে যাতায়াতকারী হাজার হাজার যাত্রীকে
তীব্র গরমের মধ্যে অবর্ণনীয়
দুর্ভোগের শিকার হতে হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসী জানান, মঙ্গলবার
কালিহাতী উপজেলার সাতুটিয়া গ্রামে মা ও
ছেলেকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে
একই গ্রামের রফিকুল ইসলাম ওরফে রোমা ও তার
ভগ্নিপতি হাফিজ উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন বখাটে।
এ ঘটনায় নারী নির্যাতন আইনে মামলার পর পুলিশ
মূল আসামি রোমাসহ তিনজনকে গ্রেফতার
করলে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার এলাকাবাসী
কালিহাতী উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল
বের করেন। এ বিক্ষোভ মিছিলেও পুলিশ
লাঠিচার্জ করে। এতে ১০ জন আহত হন। এর
জেরে শুক্রবার বিকালে ঘাটাইল উপজেলার
আঠারোদানা, কালিহাতী উপজেলার সাতুটিয়া ও
পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ মাইকে ঘোষণা দিয়ে
সমবেত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
প্রথম মিছিলটি বের হয় ঘাটাইল থানার হামিদপুর বাজারে।
এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন বিচারের দাবিতে মিছিল
নিয়ে কালিহাতী বাস স্ট্যান্ড হয়ে থানা ঘেরাও
করার জন্য যাওয়ার সময় হামিদপুর বাজারে ঘাটাইল থানা পুলিশ
তাদের বাধা দেয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ লোকজনের
সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইট-পাটকেল
ছোড়াছুড়ি হয়। পুলিশ লোকজনের ওপর
বেধড়ক লাঠিচার্জ ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
প্রায় ১ ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষের খবর ছড়িয়ে
পড়লে কালিহাতীর সাতুটিয়া এলাকার লোকজনও
বাস স্ট্যান্ডে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল
বের করেন। এখানেও পুলিশ প্রথমে তাদের
বাধা দেয় এবং লাঠিচার্জ করে। বন্ধ হয়ে যায়
এলাকার দোকানপাট ও কালিহাতী-ময়মনসিংহ সড়কে
যানবাহন চলাচল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একপর্যায়ে
পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও
গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই ৯ জন
গুলিবিদ্ধ হয়ে বাস স্ট্যান্ডের পাকা সড়কে
লুটিয়ে পড়েন এবং ৫০ জনেরও বেশি আহত
হন। গুলিবিদ্ধদের মধ্যে ঘটনাস্থলে ফারুক ও
শ্যামল এবং টাঙ্গাইল মেডিকেলে নেয়ার
পথে শামীমের মৃত্যু হয় এবং বাকিদের
প্রথমে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও
পরে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
ভর্তি করা হয়।
টাঙ্গাইল মেডিকেলে ভর্তি গুলিবিদ্ধ সুমন জানান,
শুক্রবার বিকালে মাইকিং করে ঘাটাইলের
আঠারোদানা ও সাতুটিয়া গ্রামের লোকজনকে
সমবেত করা হয়। প্রথমে হামিদপুর বাজার থেকে
বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। সেখানে পুলিশ বাধা
দেয়। পরে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে
বিক্ষোভকারীরা মিছিল শুরু করলে পুলিশ
প্রথমে লাঠিচার্জ করে। পরে জনতা পুলিশের
ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ গুলি ও
টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় সংঘর্ষ হামিদপুর
বাজার থেকে কালিহাতী বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত
ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই
তিনজন নিহত হন। কালিহাতী স্বাস্থ্য ও পরিবার
পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেলোয়ার হাসেন
তিনজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, কালহাতী
উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সোহেল
হাজারীর ডাকে সাতুটিয়া গ্রামের লোকজন
বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেন এবং
একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে
জড়িয়ে পড়েন। কালিহাতীর সাতুটিয়া ও
ঘাটাইলের আঠারোদানা গ্রামের সাধারণ মানুষ
ছিলেন এ সময় বেপরোয়া। জনগণ রাস্তায়
টায়ারে আগুন দিয়ে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়কে
যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন। ঘাটাইল ও
কালিহাতী থানা পুলিশও বিক্ষোভকারী
জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ছিল মারমুখী।
কালিহাতীর সাতুটিয়া গ্রামে মা ও ছেলেকে
বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় কালিহাতী থানায়
মামলা হয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার
অভিযোগে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে
পুলিশ। তারা এ ঘটনার মূল হোতা বলে জানা
গেছে। তাদের বৃহস্পতিবার সকালে নিজ এলাকা
থেকে গ্রেফতার করা হয়। আর
নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে
বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভ মিছিল করে এলাকাবাসী।
তবে সেই মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে
কয়েকজন আহত হন। পরে লাঠিচার্জের
প্রতিবাদে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়ক প্রায় ১ ঘণ্টা
অবরোধ করে রাখেন বিক্ষোভকারীরা।
এলাকার মহিলারাও এ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ
করেন।
কালিহাতী থানার ওসি শহীদুল ইসলাম জানান, শুক্রবার
বিকালে কালিহাতী পৌর এলাকার সাতুটিয়া ও ঘাটাইলের
আঠারোদানা গ্রামের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিক্ষোভ
মিছিলের নাম করে পুলিশের ওপর হামলা করেন।
তারা থানা ঘেরাও করতে মিছিল নিয়ে পুলিশের
ব্যারিকেড ভেঙে যেতে থাকেন। এ হামলা
ঠেকাতেই পুলিশ বাধ্য হয়ে লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল
ও ফাঁকা গুলি নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় এক এসআইসহ
পাঁচ পুলিশ আহত হন বলে তিনি জানান। পুলিশের
গুলিতে নিহত হওয়ার কথা তিনি অস্বীকার করে
বলেন, ঘাটাইল কানার হামিদপুর ও কালিহাতী বাস
স্ট্যান্ডসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রায় ২
ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষে কিভাবে তিনজন নিহত
হয়েছে তা তিনি নিশ্চিত না হয়ে বলতে
পারবেন না।
ঘাটাইল থানার ওসি মোখলেছুর রহমান জানান, বড়
ধরনের সংঘর্ষ এড়াতেই হামিদপুরে বিক্ষুব্ধ
জনতাকে বাধা দেয়া হয়। কিন্তু পুলিশের বাধা
দেখেই কয়েক হাজার মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে
পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু
করলে বাধ্য হয়েই পলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল
নিক্ষেপ ও শটগানের গুলি ছোড়ে। পুলিশ
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঝুঁকি নিয়ে চেষ্টা না
করলে ঘটনা আরও মারাত্মক হতে পারত।
এ ব্যাপারে কালিহাতী উপজেলা চেয়ারম্যান
মো. মোজহারুল ইসলাম তালুকদার (ঠাণ্ডু) ও পৌরসভা
চেয়ারম্যান আনসার আলী যুগান্তরকে বলেন,
ঘটনাটি খুবই অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক। বিক্ষুব্ধ
জনতাকে ম্যানেজ করতে পুলিশেরও যেমন
চেষ্টার ত্রুটি ছিল না, তেমনি কোনো
কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িও ছিল। তাছাড়া
বিক্ষুব্ধ জনতাও ছিল মারমুখী। ফলে প্রাণহানির
মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। আমরা তদন্ত
করে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
গ্রহণ করব। নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেব। একই
সঙ্গে এলাকাবাসীকেও ধৈর্য ধরার জন্য আহ্বান
জানাই। আমরা সাতুটিয়া গ্রামের লজ্জাজনক ঘটনার
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য প্রশাসনের পক্ষ
থেকে সব ধরনের ব্যবস্থার আশ্বাস দিচ্ছি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ন্যক্কারজনক এ ঘটনায়
জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শুক্রবার
এলাকাবাসীর বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ
করলে গোটা এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে
পড়ে। পুলিশ লাঠিচার্জের বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত ও
দোষীদের বিচারের আশ্বাস দিলে
বিক্ষোভকারীরা শান্ত হন। ৬টার দিকে
স্থানীয় নেতারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে
বিষয়টির চূড়ান্ত সমাধানের আশ্বাস দিলে
বিক্ষোভকারীরা অবরোধ প্রত্যাহার করে
নেন। ফলে অবসান ঘটে প্রায় ৩ ঘণ্টার
অবরোধ এবং দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার দুঃসহ
যানজটের। সন্ধ্যা ৭টার দিকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ
সড়কে যানবাহন চলাচল আবার শুরু হয়।
ক্ষতিপূরণ দেয়ার সিদ্ধান্ত : শুক্রবার রাতে ঘটনা
পর্যালোচনায় টাঙ্গাইলের ডিসি মাহবুব
হোসেনের নেতৃত্বে কালিহাতী থানায়
এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে নিহত তিনজনের
পরিবারকে আজকের মধ্যেই ক্ষতিপূরণ
হিসেবে ৫০ হাজার করে টাকা, পরিবারকে অন্যান্য
সাহায্য প্রদান, আহতদের উন্নত চিকিৎসা ব্যয়বহন এবং
ঘটনার শিকার আল আমীনের মাকে পুলিশি
নিরাপত্তা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। রাত ৮টা থেকে
১০টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত এসপি
সঞ্জয় সরকার, কালিহাতী উপজেলা চেয়ারম্যান
ও থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো.
মোজহারুল ইসলাম তালুকদার (ঠাণ্ডু), পৌরসভা
চেয়ারম্যান আনসার আলী বিকম, ঘাটাইল থানা
আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম
লেবুসহ দুই থানার ওসি উপস্থিত ছিলেন।
পূর্ব কাহিনী : কালিহাতী পৌর এলাকার সাতুটিয়া এলাকার
রফিকুল ইসলাম রোমার স্ত্রী হোসনে
আরার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ঘাটাইল উপজেলার
শ্রমজীবী আল আমীনের প্রেমের
সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কয়েক মাস আগে আল
আমীনের সঙ্গে রোমার স্ত্রী
হোসনে আরা পালিয়ে যান। পরে তাকে
ফিরিয়েও আনা হয়। এরপর ১২ সেপ্টেম্বর
আবারও হোসনে আরা আল আমীনের
সঙ্গে পালিয়ে যান। ১৫ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার
রোমা ও তার পরিবারের লোকজন আলোচনার
কথা বলে আল আমীন ও তার মাকে
কালিহাতীর সাতুটিয়ায় ডেকে আনে। এরপর
রোমা ও তার ভগ্নিপতি হাফিজসহ অন্য লোকজন
মিলে আল আমীন ও তার মাকে বেধড়ক
মারধরের পর সবার সামনে বিবস্ত্র করে।
ছড়িয়ে পড়ে আল আমীনের মাকে ধর্ষণ
করেছে রোমা। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে
আল আমীন নারী নির্যাতন ধারায় কালিহাতী
থানায় মামলা করলে পুলিশ ওই দিনই প্রধান আসামি
রোমা ও হাফিজসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে
কোর্টে পাঠায়। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট
তাদের কারাগারে প্রেরণ করেন।
বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার জেরে
এলাকাবাসী ও পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ
হয়ে তিনজন নিহত ও প্রায় অর্ধশত আহত
হয়েছেন। নিহতরা হচ্ছেন- কালিহাতীর
সাতুটিয়া গ্রামের ফারুক, ঘাটাইলের সালেঙ্গা
গ্রামের শামীম ও হরিপুর গ্রামের শ্যামল।
আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ সাতজনকে
টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
ভর্তির পর আশংকাজনক অবস্থায় চারজনকে ঢাকা
মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে।
ঢাকা
মেডিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে ভর্তিরা
হচ্ছেন- কালিহাতীর সমীর, ঘাটাইল
হরিপুরের ইউসুফ, রুবেল ও লিটন এবং টাঙ্গাইল
মেডিকেলে চিকিৎসাধীন আছেন ঘাটাইল
হরিপুরের সাইদ, গারোবাজারের শামসুল ও
শামীম। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ১০ জনকে
আটক করেছে। শুক্রবার বিকালে কালিহাতী
সদরের পার্শ্ববর্তী ঘাটাইল থানার হামিদপুর বাজার ও
কালিহাতী বাস স্ট্যান্ডে দুই থানার কয়েক হাজার
বিক্ষুব্ধ মানুষের সঙ্গে পুলিশের দু’দফা সংঘর্ষে
এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কালিহাতী থানার
এসআই ফারুক, কনস্টেবল লিয়াকত ও হারুন গুরুতর
আহত হন। নিহতদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা
ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা প্রদান, আহতদের উন্নত চিকিৎসায়
অর্থদান এবং ভিকটিম পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়ার
ব্যাপারে রাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও
র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। এলাকায়
উত্তেজনা বিরাজ করছে। এ সংঘর্ষের কারণে
প্রায় ৪ ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। টাঙ্গাইল-
ময়মনসিংহ সড়কের কালিহাতী বাস স্ট্যান্ডের
উত্তরে ও দক্ষিণে দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার
এলাকাজুড়ে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে এ
রুটে যাতায়াতকারী হাজার হাজার যাত্রীকে
তীব্র গরমের মধ্যে অবর্ণনীয়
দুর্ভোগের শিকার হতে হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসী জানান, মঙ্গলবার
কালিহাতী উপজেলার সাতুটিয়া গ্রামে মা ও
ছেলেকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে
একই গ্রামের রফিকুল ইসলাম ওরফে রোমা ও তার
ভগ্নিপতি হাফিজ উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন বখাটে।
এ ঘটনায় নারী নির্যাতন আইনে মামলার পর পুলিশ
মূল আসামি রোমাসহ তিনজনকে গ্রেফতার
করলে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার এলাকাবাসী
কালিহাতী উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল
বের করেন। এ বিক্ষোভ মিছিলেও পুলিশ
লাঠিচার্জ করে। এতে ১০ জন আহত হন। এর
জেরে শুক্রবার বিকালে ঘাটাইল উপজেলার
আঠারোদানা, কালিহাতী উপজেলার সাতুটিয়া ও
পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ মাইকে ঘোষণা দিয়ে
সমবেত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
প্রথম মিছিলটি বের হয় ঘাটাইল থানার হামিদপুর বাজারে।
এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন বিচারের দাবিতে মিছিল
নিয়ে কালিহাতী বাস স্ট্যান্ড হয়ে থানা ঘেরাও
করার জন্য যাওয়ার সময় হামিদপুর বাজারে ঘাটাইল থানা পুলিশ
তাদের বাধা দেয়। এ সময় বিক্ষুব্ধ লোকজনের
সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইট-পাটকেল
ছোড়াছুড়ি হয়। পুলিশ লোকজনের ওপর
বেধড়ক লাঠিচার্জ ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে।
প্রায় ১ ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষের খবর ছড়িয়ে
পড়লে কালিহাতীর সাতুটিয়া এলাকার লোকজনও
বাস স্ট্যান্ডে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল
বের করেন। এখানেও পুলিশ প্রথমে তাদের
বাধা দেয় এবং লাঠিচার্জ করে। বন্ধ হয়ে যায়
এলাকার দোকানপাট ও কালিহাতী-ময়মনসিংহ সড়কে
যানবাহন চলাচল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একপর্যায়ে
পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও
গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই ৯ জন
গুলিবিদ্ধ হয়ে বাস স্ট্যান্ডের পাকা সড়কে
লুটিয়ে পড়েন এবং ৫০ জনেরও বেশি আহত
হন। গুলিবিদ্ধদের মধ্যে ঘটনাস্থলে ফারুক ও
শ্যামল এবং টাঙ্গাইল মেডিকেলে নেয়ার
পথে শামীমের মৃত্যু হয় এবং বাকিদের
প্রথমে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও
পরে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে
ভর্তি করা হয়।
টাঙ্গাইল মেডিকেলে ভর্তি গুলিবিদ্ধ সুমন জানান,
শুক্রবার বিকালে মাইকিং করে ঘাটাইলের
আঠারোদানা ও সাতুটিয়া গ্রামের লোকজনকে
সমবেত করা হয়। প্রথমে হামিদপুর বাজার থেকে
বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। সেখানে পুলিশ বাধা
দেয়। পরে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে
বিক্ষোভকারীরা মিছিল শুরু করলে পুলিশ
প্রথমে লাঠিচার্জ করে। পরে জনতা পুলিশের
ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে পুলিশ গুলি ও
টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় সংঘর্ষ হামিদপুর
বাজার থেকে কালিহাতী বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত
ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই
তিনজন নিহত হন। কালিহাতী স্বাস্থ্য ও পরিবার
পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেলোয়ার হাসেন
তিনজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
স্থানীয় লোকজন জানান, কালহাতী
উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সোহেল
হাজারীর ডাকে সাতুটিয়া গ্রামের লোকজন
বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেন এবং
একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে
জড়িয়ে পড়েন। কালিহাতীর সাতুটিয়া ও
ঘাটাইলের আঠারোদানা গ্রামের সাধারণ মানুষ
ছিলেন এ সময় বেপরোয়া। জনগণ রাস্তায়
টায়ারে আগুন দিয়ে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়কে
যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন। ঘাটাইল ও
কালিহাতী থানা পুলিশও বিক্ষোভকারী
জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ছিল মারমুখী।
কালিহাতীর সাতুটিয়া গ্রামে মা ও ছেলেকে
বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় কালিহাতী থানায়
মামলা হয়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার
অভিযোগে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে
পুলিশ। তারা এ ঘটনার মূল হোতা বলে জানা
গেছে। তাদের বৃহস্পতিবার সকালে নিজ এলাকা
থেকে গ্রেফতার করা হয়। আর
নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে
বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভ মিছিল করে এলাকাবাসী।
তবে সেই মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে
কয়েকজন আহত হন। পরে লাঠিচার্জের
প্রতিবাদে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়ক প্রায় ১ ঘণ্টা
অবরোধ করে রাখেন বিক্ষোভকারীরা।
এলাকার মহিলারাও এ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ
করেন।
কালিহাতী থানার ওসি শহীদুল ইসলাম জানান, শুক্রবার
বিকালে কালিহাতী পৌর এলাকার সাতুটিয়া ও ঘাটাইলের
আঠারোদানা গ্রামের বিপুলসংখ্যক মানুষ বিক্ষোভ
মিছিলের নাম করে পুলিশের ওপর হামলা করেন।
তারা থানা ঘেরাও করতে মিছিল নিয়ে পুলিশের
ব্যারিকেড ভেঙে যেতে থাকেন। এ হামলা
ঠেকাতেই পুলিশ বাধ্য হয়ে লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল
ও ফাঁকা গুলি নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় এক এসআইসহ
পাঁচ পুলিশ আহত হন বলে তিনি জানান। পুলিশের
গুলিতে নিহত হওয়ার কথা তিনি অস্বীকার করে
বলেন, ঘাটাইল কানার হামিদপুর ও কালিহাতী বাস
স্ট্যান্ডসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্রায় ২
ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষে কিভাবে তিনজন নিহত
হয়েছে তা তিনি নিশ্চিত না হয়ে বলতে
পারবেন না।
ঘাটাইল থানার ওসি মোখলেছুর রহমান জানান, বড়
ধরনের সংঘর্ষ এড়াতেই হামিদপুরে বিক্ষুব্ধ
জনতাকে বাধা দেয়া হয়। কিন্তু পুলিশের বাধা
দেখেই কয়েক হাজার মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে
পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু
করলে বাধ্য হয়েই পলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল
নিক্ষেপ ও শটগানের গুলি ছোড়ে। পুলিশ
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঝুঁকি নিয়ে চেষ্টা না
করলে ঘটনা আরও মারাত্মক হতে পারত।
এ ব্যাপারে কালিহাতী উপজেলা চেয়ারম্যান
মো. মোজহারুল ইসলাম তালুকদার (ঠাণ্ডু) ও পৌরসভা
চেয়ারম্যান আনসার আলী যুগান্তরকে বলেন,
ঘটনাটি খুবই অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক। বিক্ষুব্ধ
জনতাকে ম্যানেজ করতে পুলিশেরও যেমন
চেষ্টার ত্রুটি ছিল না, তেমনি কোনো
কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িও ছিল। তাছাড়া
বিক্ষুব্ধ জনতাও ছিল মারমুখী। ফলে প্রাণহানির
মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। আমরা তদন্ত
করে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
গ্রহণ করব। নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেব। একই
সঙ্গে এলাকাবাসীকেও ধৈর্য ধরার জন্য আহ্বান
জানাই। আমরা সাতুটিয়া গ্রামের লজ্জাজনক ঘটনার
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য প্রশাসনের পক্ষ
থেকে সব ধরনের ব্যবস্থার আশ্বাস দিচ্ছি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ন্যক্কারজনক এ ঘটনায়
জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শুক্রবার
এলাকাবাসীর বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ
করলে গোটা এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে
পড়ে। পুলিশ লাঠিচার্জের বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত ও
দোষীদের বিচারের আশ্বাস দিলে
বিক্ষোভকারীরা শান্ত হন। ৬টার দিকে
স্থানীয় নেতারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে
বিষয়টির চূড়ান্ত সমাধানের আশ্বাস দিলে
বিক্ষোভকারীরা অবরোধ প্রত্যাহার করে
নেন। ফলে অবসান ঘটে প্রায় ৩ ঘণ্টার
অবরোধ এবং দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার দুঃসহ
যানজটের। সন্ধ্যা ৭টার দিকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ
সড়কে যানবাহন চলাচল আবার শুরু হয়।
ক্ষতিপূরণ দেয়ার সিদ্ধান্ত : শুক্রবার রাতে ঘটনা
পর্যালোচনায় টাঙ্গাইলের ডিসি মাহবুব
হোসেনের নেতৃত্বে কালিহাতী থানায়
এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে নিহত তিনজনের
পরিবারকে আজকের মধ্যেই ক্ষতিপূরণ
হিসেবে ৫০ হাজার করে টাকা, পরিবারকে অন্যান্য
সাহায্য প্রদান, আহতদের উন্নত চিকিৎসা ব্যয়বহন এবং
ঘটনার শিকার আল আমীনের মাকে পুলিশি
নিরাপত্তা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। রাত ৮টা থেকে
১০টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত এসপি
সঞ্জয় সরকার, কালিহাতী উপজেলা চেয়ারম্যান
ও থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো.
মোজহারুল ইসলাম তালুকদার (ঠাণ্ডু), পৌরসভা
চেয়ারম্যান আনসার আলী বিকম, ঘাটাইল থানা
আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম
লেবুসহ দুই থানার ওসি উপস্থিত ছিলেন।
পূর্ব কাহিনী : কালিহাতী পৌর এলাকার সাতুটিয়া এলাকার
রফিকুল ইসলাম রোমার স্ত্রী হোসনে
আরার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ঘাটাইল উপজেলার
শ্রমজীবী আল আমীনের প্রেমের
সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কয়েক মাস আগে আল
আমীনের সঙ্গে রোমার স্ত্রী
হোসনে আরা পালিয়ে যান। পরে তাকে
ফিরিয়েও আনা হয়। এরপর ১২ সেপ্টেম্বর
আবারও হোসনে আরা আল আমীনের
সঙ্গে পালিয়ে যান। ১৫ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার
রোমা ও তার পরিবারের লোকজন আলোচনার
কথা বলে আল আমীন ও তার মাকে
কালিহাতীর সাতুটিয়ায় ডেকে আনে। এরপর
রোমা ও তার ভগ্নিপতি হাফিজসহ অন্য লোকজন
মিলে আল আমীন ও তার মাকে বেধড়ক
মারধরের পর সবার সামনে বিবস্ত্র করে।
ছড়িয়ে পড়ে আল আমীনের মাকে ধর্ষণ
করেছে রোমা। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে
আল আমীন নারী নির্যাতন ধারায় কালিহাতী
থানায় মামলা করলে পুলিশ ওই দিনই প্রধান আসামি
রোমা ও হাফিজসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে
কোর্টে পাঠায়। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট
তাদের কারাগারে প্রেরণ করেন।