ধর্ম

মাহে রমজান : সংশোধন ও প্রশিক্ষণের মাস

পার্থিব জীবনের সব কাজে যেমন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়, তেমনি মুমিন জীবনের প্রশিক্ষণের মাস

হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত এই মহিমান্বিত রমজান মাস। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের পূর্ববর্তী জীবনের ভুল-ত্রুটি

ক্ষমা করার ও পরবর্তী জীবনে তার নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী চলার জন্য এ মাসকে প্রশিক্ষণের

মাস হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন; ‘তোমাদের মধ্যে যে

কেউ রমজান মাসে উপস্থিত (জীবিত) থাকে, তারই সিয়াম পালন করা অবশ্য কর্তব্য।’ [২-সূরা

বাকারা : ১৮৫] অন্য সময়ের তুলনায় মানুষ প্রশিক্ষণকালে আত্মসংশোধন ও নিত্যনতুন জ্ঞানার্জনে

বেশি মনোযোগী ও সচেতন থাকে। তেমনি রমজানের সিয়ামসহ সাধারণ দিনের চেয়ে বাড়তি

ইবাদতগুলো প্রশিক্ষণমূলকভাবে সাজানো হয়েছে। আল্লাহ তার বান্দার জন্য এ মাসকে তিনটি ভাগে

বিভক্ত করে একটি কোর্সের ব্যবস্থা করেছেন। প্রথম ভাগের দশদিন হচ্ছে রহমতের। এ দিনগুলোতে

বান্দা মুনিবের কাছে তাওবাহ-ইস্তেগফার করে। পূর্বের দিনগুলোর তুলনায় ফরজ ওয়াজিবের

পাশাপাশি বেশি বেশি নফল ইবাদতে মশগুল হয়। তখন আল্লাহ তার উপর অবারিত রহমত নাযিল

করেন। দ্বিতীয় ভাগ হচ্ছে মাগফিরাতের। এ সময় আল্লাহ তার গোনাহগার বান্দাদের তাওবা কবুল

করে ক্ষমা করে দেন। শেষ ভাগ হচ্ছে জাহান্নাম থেকে মুক্তির। রমজানের শেষ দশকে আল্লাহ তাঁর

বান্দাদের অনুগ্রহ করে জাহান্নমের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ দান করেন। মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা

এমন এক প্রশিক্ষণ, যা মানুষের কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য- এই ষড়রিপুর তাড়না

অবদমিত করে এবং মুমিন ব্যক্তি ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংযম, সহানুভূতি, সাম্য ও যাবতীয় সৎ মানবিক

গুণাবলী অর্জন করতে পারে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ নিজের কামনা-বাসনা ও কুপ্রবৃত্তি দমন

করার সর্বত্মক চেষ্টা করে। বছরের অন্যান্য সময় থেকে এ মাসে নিয়মতান্ত্রিক ও বাধ্যতামূলক

কাজের মাধ্যমে মানুষের জীবনবোধকে জাগ্রত করে। সারাদিন পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত

থাকা, নিয়মিত রাতে তারাবিহর নামাজ আদায় করা, মিথ্যা কথা না বলা, অন্যের মনে আঘাত না

করা, চোগলখুরি না করা, মানুষের হক নষ্ট না করা, অন্যায় জুলুম না করা- এমনি অনেক নির্দেশ

পালনের মাধ্যমে সিয়াম মানুষকে মুত্তাকি বানাতে কাজ করে। ইবাদতের নানামুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ

লাভের অফুরন্ত সুযোগ আসে এ মাসে। আর রমজানের প্রধান ইবাদত হচ্ছে সিয়াম। একে যথার্থভাবে

সুন্নাহ মোতাবেক পালন করে তা থেকে জীবনের মূল মর্ম ও শিক্ষা গ্রহণ করে দুনিয়া-আখিরাতে

সফলকাম হওয়ার এত অবারিত সুযোগ। রমজান মাসে স্বাভাবিকভাবেই সবার মধ্যে খুব ভাবগাম্ভীর্য

চলে আসে। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় সবাই বেশি বেশি ভালো কাজ করতে চায়। খারাপ কাজ

থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করে। তাই দেখা যায় কোনো ব্যক্তি খারাপ বা অশ্লীল কোনো কাজ করতে

গেলে অন্যরা বলে ওঠে, রমজান মাসের দিন এটা করো না। এভাবে মানুষেরা সৎ কাজের আদেশ ও

অসৎ কাজের নিষেধ এর চর্চা করে থাকে। যা মুসলমান জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তেমনি

মানুষেরা একে ওপরকে ভালো কাজে উৎসাহিত করে। দৈনন্দিন জীবনেও সবাইকে খুব সংযমী ও

ধৈর্যশীল দেখা যায়। যা মানুষের মানবিক গুণাবলীর বিকাশে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে।নিজেকে

গঠনের, সংশোধনের ও বিচার করার এক উপযুক্ত সময় এই মাস। ন্যায়, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের এক

অপার সম্মিলন ঘটে এই মাসে। এছাড়া ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় রমজান

মাস। এ মাসে সব মুসলমানরা একই পদ্ধতি ও জীবনধারা অনুসরণ করে। সেহরী, ইফতার, শোয়া,

উঠার নিয়ম-নীতি এক ও অভিন্ন। তাই এটি মুসলিম ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠারও এক উপযুক্ত সময়। একটি

সুশৃংখলাবদ্ধ জীবনেরও প্রশিক্ষণ হয় এই মাসে। নির্দিষ্ট সময় সেহরি খাওয়া, ইফতার করা, সালাত

আদায় করা ইত্যাদি কার্যকলাপ আমাদের জীবনকে একটি সুন্দর সুশৃংখল করতে সাহায্য করে। ধৈর্য

এবং সবরেরও এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ শেখা যায় রমাজন মাসে। গরীব-দুঃখীর কষ্টও অনুভব করতে

পারে সবাই। তারা যেভাবে উপোস করে সে অনুভব হয় সব শ্রেণীর মানুষের। তেমনি পবিত্র রমজান

মাসে যাকাত ও ফিতরা আদায়ের মাধ্যমে সমবায় সমাজ গঠনের এক অবারিত সুযোগ আসে।

রমজানের পুরো মাস জুড়ে বান্দার জন্য মহান রবের অফুরন্ত রহমত বর্ষিত হয় হিসেববিহীন। এটি

হচ্ছে নেক কাজের মৌসুম। এ মাসে আল্লাহ দিয়েছেন কদরের রাত। যা হাজার মাসের চাইতে উত্তম।

এ মাসেই আল্লাহ পবিত্র কোরআন নাযিল করেছেন। শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রাখেন, তাই সে

মুমিনদেরকে কুমন্ত্রণা দিতে পারে না। এ সময় মহান মুনিবের সাথে বান্দার সম্পর্ক শক্তিশালী হয়।

রমজান মাস আত্মসমালেচনার উত্তম সময়। ঐ এগারো মাসে মানুষের লোভ-লালসা ও কামনা বসনা

দীর্ঘায়িত হতে থাকে। রমজান সেই কামনা বাসনার লাগাম টেনে ধরে। রমজান মুমিনের অন্তরে নেক

অনুভূতির জন্ম দেয়। যাতে আমাদের আত্মার উন্নাতি হয়। এবং খালেসভাবে সিয়াম পালন করে মহান

রবের প্রিয় হবার সুযোগ আসে। তাই রমজানের এসব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে কাজে লাগিয়ে আমাদের

পুরো জীবন পরিচালিত করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন।

লেখক :
সাংবাদিক-কলামিস্ট