ধর্ম

মুবারক হো মাহে রমজান

সদকাতুল ফিতরবান্দাহর উপর আল্লাহপাকের অসংখ্য নেয়ামত রয়েছে। যার সংখ্যা হিসাব করে, গুণে শেষ করা যাবে না। অনুরূপ শ্রেষ্ঠ নেয়ামত হলো মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা। মহান রাব্বুল আলামীন পূর্ণ-রমজান মাস সিয়াম পালনের তাওফিক এনায়েত করেছেন এবং রমজান মাস শেষে পানাহারের অনুমতি প্রদান করেছেন, তাই তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতের শোকর আদায় করা একান্তই জরুরি। এ প্রসঙ্গে কোরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে : “আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর আদায় কর”। (সূরা বাকারাহ : ১৮৫)। এই আয়াতে ‘লায়াল্লাকুম তাশকুরুন’ বাক্যের মধ্যে সদকাতুল ফিতর আদায়ের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে হজরত ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : “গোলাম, স্বাধীন পুরুষ, নারী, ছোট, বড় সকল মুসলমানের উপর রাসূলুল্লাহ (সা.) এক সা’ খেজুর, অথবা এক সা’ গম সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন এবং সালাতের পূর্বে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম)। সহীহ বুখারীর অপর একটি বর্ণনায় আছে, ইমাম নাফে (র.) বলেছেন : ইবনে ওমর (রা.) ছোট-বড় সবার পক্ষ থেকে তা আদায় করতেন, তিনি আমার সন্তানদের পক্ষ হতেও আদায় করতেন। যারা তা গ্রহণ করত, ইবনে ওমর (রা.) তাদেরকে তা প্রদান করতেন। তিনি ঈদুল ফিতরের একদিন অথবা দু’দিন পূর্বে তা আদায় করতেন। (সহীহ বুখারী)। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা’ খাদ্য, অথবা এক সা’ গম, অথবা এক সা’ খেজুর, অথবা এক সা’ পনির, অথবা এক সা’ কিসমিস দ্বারা। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, “রোজাদারকে অশ্লীলতা থেকে পবিত্র করা ও মিসকিনদের খাদ্যের ব্যবস্থা স্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সা.) সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। সালাতের পূর্বে যে আদায় করল, তা গ্রহণযোগ্য যাকাত। যে তা সালাতের পর আদায় করল, তা সাধারণ সদকাহ”। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)। কায়েস ইবনে সাদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : যাকাত ফরজ হওয়ার পূর্বে আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা.) সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফিতরার পরিমাণ সম্পর্কে বহু হাদীস, হাদীসের সংকলন গ্রন্থসমূহে উদ্ধৃত হয়েছে। এ পর্যায়ে আরেকটি হাদীস এই : “আবদুল্লাহ ইবনে সা’লাবাতা ইবনে ছুগাইর আল উসরী তার পিতা হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর এক ভাষণে বলেছেন : তোমরা প্রত্যেক স্বাধীন, ক্রীতদাস, ছোট কিংবা বড়’র তরফ হতে অর্ধ সা’ গম কিংবা এক সা’ যব কিংবা এক সা’ খেজুর ফেতরা বাবদ আদায় কর। (আবু দাউদ, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, দারে কুতনী, তাবারানী, মোস্তাদরেকে হাকেম)। এই হাদীসে এবং অন্যান্য হাদীসে ‘আদায় কর’ স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ উদ্ধৃত হলেও ইহা হতে সদাকাতুল ফিতর আদায় করা ফরজ প্রমাণিত হয় না। বরং এই নির্দেশের দ্বারা ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। কেননা ইহা (কেতয়ী দলীল) অকাট্য প্রমাণ নয়। উপরোক্ত আলোচনা হতে এ কথা জানা যায় যে, সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য মুসলিম হওয়া ছাড়া আর কোন শর্ত নেই। কিন্তু হানাফী মাযহাবে স্বাধীন হওয়ার শর্ত করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্যে হলো, স্বাধীন হলে তার ইসলাম পালন ও মালিকানা গ্রহণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হয়। কিন্তু ক্রীতদাস হলে তা হয় না। স্বাধীন ব্যক্তির সদকাহ বা দান আল্লাহপাকের নৈকট্য লাভের কারণ হয়। এ পর্যায়ে সচ্ছলতারও শর্ত করা হয়েছে। সহীহ বুখারী এবং মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত একটি হাদীসে উক্ত হয়েছে যে, “বাহ্যত সচ্ছলতা ও ঐশ্বর্যশীলতা ছাড়া সদকাহ ওয়াজিব হয় না।” কিন্তু ইমাম শায়েদী (রহ.) এই মত সমর্থন করেননি। তার মতে, যে লোক (ঈদের দিন) তার নিজের ও পরিবারবর্গের ঈদের দিনের খাদ্য পরিমাণের অধিক সম্পদের মালিক হবে তার উপরই সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। বস্তুত সদকায়ে ফিতরের আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ দিগন্ত বিস্তৃত সূর্যালোকের ন্যায়। এর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ এই যে, প্রথমত : ফিতরা আদায়কারী ব্যক্তি শরীয়ত লঙ্ঘনকারী কোন কাজে লিপ্ত হবে না এবং স্বীয় অর্থের অপচয় করবে না। আর যদি অলক্ষ্যে ও অসতর্কতার কারণে কোন শরীয়তবিরোধী কাজ হয়ে যায়, কোন অশ্লীল কথা মুখ হতে বের হয়ে যায়, অথবা কোন পাপ কাজ করে ফেলে, তবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই সদকায়ে ফিতরের মাধ্যমে তা মাফ করে দেবেন। আর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ এই যে, এর দরুন সমাজের গরীব-মিসকীন লোকেরা সাময়িকভাবে হলেও এমন পরিমাণ অর্থ পেতে পারে, যার দ্বারা তাদের ও পরিবার বর্গের ঈদের দিনের ভালো কিংবা সাধারণ মানের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা সম্ভব হতে পারে। এতে করে ইসলামী সমাজের সর্বত্র শান্তি, স্বস্তি, প্রফুল্লতা, আনন্দ ও খুশির বারতার ঝর্ণ ধারা প্রবাহিত হতে থাকবে।