ফিচার

সোনা পাচারের যতসব বিচিত্র উপায়


ভারতের মাফিয়া ডন হাজী মাস্তান বা দাউদ ইব্রাহীমরা এক সময়ে সমুদ্রপথে সোনা পাচার করতো। এছাড়াও অনেকে সোনার গয়না পরে চলে আসত পাচারের উদ্দেশ্যে নিয়ে, অথবা বিদেশ থেকে ফেরার পথে স্যুটকেসের লুকানো কুঠরিতে থাকত সোনার বাঁট বা গয়না। এখন দিন পাল্টেছে। পাচারকারীরা বদলেছে সোনা স্মাগলিংয়ের ধরণ। গত কয়েক বছরে নতুন নতুন পদ্ধতিতে পাচার করে নিয়ে আসার সময়ে ধরা পড়েছে প্রচুর সোনার বাঁট আর বিস্কুট।

মলদ্বারে সোনার বিস্কুট
গত কয়েক মাসে ভারতের শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ এমন তিনজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে, যারা নিজেদের মলদ্বারে সোনার বিস্কুট লুকিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন। তিনটে ঘটনাই মুম্বাই বিমানবন্দরের। শুল্ক গোয়েন্দারা বলছেন, এপ্রিল মাসের এক রাতে শ্রীলঙ্কার দুই নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়, যারা বিমানবন্দর থেকে বেরুনোর চেষ্টা করছিল। দু’জনেই দুবাই থেকে মুম্বাইতে এসেছিল। সন্দেহ হওয়াতে দু’জনকেই আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। আর তাতেই জানা যায় যে, নিজেদের মলদ্বারে সোনার বিস্কুট লুকিয়ে নিয়ে এসেছে তারা। দু’জনের কাছ থেকে ২৪টা সোনার বিস্কুট পাওয়া যায়, যার ওজন তিন কেজি, দাম প্রায় এক কোটি টাকা।

মে মাসে আরও একটি ঘটনা ধরা পড়ে ওই মুম্বাই বিমানবন্দরেই। কলম্বো থেকে আসা এক শ্রীলঙ্কান যখন মেটাল ডিটেক্টর যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, তখনই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তার শরীরে কোনো ধাতব বস্তু রয়েছে। ওই যাত্রীকে জেরা করে জানা যায় যে সেও মলদ্বারে সোনার বিস্কুট লুকিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে মলদ্বার থেকে ছয়টা সোনার বিস্কুট বার করা হয়। ২০৪ গ্রামের ওই সোনার বিস্কুটগুলোর মূল্য প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা।

মলদ্বার থেকে সোনা বার করতে স্মাগলারদের অনেক সময়েই প্রচুর কলা খাওয়াতে হয়, যাতে মলের সঙ্গে বিস্কুট অথবা নিষিদ্ধ মাদক বেরিয়ে আসে। গতবছর কলকাতা বিমানবন্দরে কুয়ালালামপুর থেকে আসা এক বাংলাদেশীকে দেখে সন্দেহ হয়েছিল শুল্ক কর্তাদের। মেটাল ডিটেক্টের প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছে যে ওই ব্যক্তির শরীরে কোনো ধাতু রয়েছে। জেরা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটি স্বীকার করে যে, তার পেটের মধ্যে সোনা রয়েছে। এরপর তিন-চার ঘণ্টা ধরে পেট পরিষ্কার করার ওষুধ আর পানি খাওয়ানো চলে। সকালে লোকটি যখন টয়লেটে যায়, তখনই পেট থেকে বেরিয়ে আসে ১১টি সোনার বিস্কুট। ওজন এক কিলোগ্রামের কিছুটা বেশি, দাম ৩৪ লক্ষ টাকা।

ফলের জুসার আর ওয়াশিং মেশিনের মধ্যে সোনা
গালফ এয়ারের বিমানে দুবাই থেকে মুম্বাইতে এসে পৌঁছানো এক যাত্রীর ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছিল শুল্ক বিভাগের অফিসারদের। তাঁরা জেরা করতে শুরু করেন ওই ব্যক্তিকে। শেষমেশ সব মালপত্র পরীক্ষা করে দেখা যায় হাতে ঘুরিয়ে ফলের রস বের করার একটি যন্ত্রের মধ্যে লুকানো রয়েছে প্রায় ৫৭০ গ্রাম সোনা, যার মূল্য ১৭ লক্ষ টাকা। এমিরেটস-এর দুবাই-মুম্বাই বিমানের এক যাত্রীর সঙ্গে আনা ওয়াশিং মেশিন বাজেয়াপ্ত করেছিলেন শুল্ক অফিসারেরা। পরে ওয়াশিং মেশিনের ভেতরে থাকা মোটরে প্রায় সোয়া দুই কেজি ওজনের একটি সোনার বাঁট খুঁজে পাওয়া যায়।

ময়লার ঝুড়িতেও সোনা
জেট এয়ারওয়েজের মাস্কট-মুম্বাই বিমান পৌঁছানোর আগেই গোয়েন্দাদের কাছে খবর চলে এসেছিল যে ওই বিমানে সোনা পাচার করা হবে। বিমানটা মুম্বাইয়ের মাটি ছোঁয়ার পরেই শুরু হয়েছিল সোনার খোঁজ। কিন্তু কোথাও সোনা পাওয়া যাচ্ছে না! অবাক লেগেছিল গোয়েন্দাদের। অবশেষে তাঁদের নজর পড়ে বিমানের পেছনের দিকে টয়লেটের কাছে রাখা একটি ময়লা ফেলার ঝুড়ির দিকে। পরীক্ষা করে দেখা যায়, ওই ঝুড়িটার দুটো ভাগ রয়েছে, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। একটা ফোঁকড় তৈরী করে তার মধ্যেই টেপ দিয়ে আটকিয়ে রাখা ছিল আটটা সোনার বাঁট। একেকটার ওজন এক কিলোগ্রাম করে। দাম দুই কোটি টাকা।

কয়েক বছর আগে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছানো একটি বেসরকারী এয়ারলাইন্সের বিমান থেকে ২৪ কেজি সোনা পাওয়া গিয়েছিল। কেউই সেই সোনা আর দাবি করেনি। টয়লেটের মধ্যে একটি গোপন কুঠুরি বানিয়ে সেখানে রেখে দেওয়া হয়েছিল সোনার বাঁটগুলি। মনে করা হয়, বিমানকর্মীদের যোগসাজসেই ওই সোনা পাচার করা হচ্ছিল।

পানির বোতলে সোনা
গত মাসে একই বিমানে সফররত ২১ জনকে একসঙ্গে আটক করা হয়। খবর ছিল যে এরা সোনা পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। সবাই জেদ্দা থেকে মুম্বাই আসছিল। বিমানটা মুম্বাইতে পৌঁছানোর পরে যখন শুল্ক অফিসারেরা মালপত্র পরীক্ষা করতে শুরু করেন, দেখা যায় পানির বোতলের নিচে আর বোতলের ছিপির ভেতরে সোনার ছোট ছোট টুকরো লুকিয়ে রেখেছে ওই পাচারকারীরা।

সকলের কাছ থেকে মোট সাড়ে পাঁচ কিলোগ্রাম সোনা উদ্ধার করা হয়, যার বাজার মূল্য এক কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। জেরা করে জানা যায়, এরা সকলেই উত্তরপ্রদেশের লখ্‌নৌর এক পাচার চক্রের সদস্য।

বেল্ট, জুতো আর টর্চের মধ্যে সোনা
ইস্তানবুল থেকে আগত এক তুর্কী নাগরিক বিশেষভাবে তৈরী বেল্টে লুকিয়ে সোনা নিয়ে আসতে গিয়ে ধরা পড়ে। বেল্টের ভেতরে ছোট্ট ছোট্ট খুপড়ি তৈরী করা হয়েছিল সোনা রাখার জন্য। মোট তিন কেজি সোনা পাওয়া গিয়েছিল তার কাছে। মার্চ মাসে মুম্বাই বিমানবন্দরে কর্মরত শুল্ক কর্মকর্তারা লক্ষ্য করেন যে এক যাত্রী সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছেন। কিছুদিন আগেও ওই ব্যক্তিকে দেখেছিলেন কর্মকর্তারা। তাতেই সন্দেহটা বাড়ে।

তিনি সিঙ্গাপুর থেকে মুম্বাই এসেছিলেন। মেটাল ডিটেক্টরের সামনে নিয়ে যেতেই যন্ত্র জানিয়ে দেয় যে ধাতব পদার্থ রয়েছে ওই ব্যক্তির কাছে। তারপর তল্লাশি করে পাওয়া যায় জুতোর তলায় একটা গোপন কুঠুরি বানিয়ে সোনা রাখা হয়েছে। ১২টা সোনার বিস্কুট পাওয়া যায় ওই ব্যক্তির কাছ থেকে। এর আগে রিয়াদ থেকে মুম্বাই পৌঁছানো জেট এয়ারওয়েজের একটি বিমানে এক যাত্রী এলইডি টর্চের ব্যাটারি রাখার জায়গায় সোনার ছোট ছোট বিস্কুট ভরে আনে। তার পার্সেও সোনার বিস্কুট ছিল। প্রায় এক কিলোগ্রাম সোনা পাওয়া গিয়েছিল তার কাছ থেকে।

সোনা দিয়ে তৈরী হ্যান্ডব্যাগের রিং
মুম্বাইয়ের ভিলে পার্লের বিদেশী ডাকঘরে একটা তল্লাশী অভিযান চালানো হয় সম্প্রতি। এ সময় শুল্ক অফিসাররা ১২টি এমন পার্সেল বাজেয়াপ্ত করেন, যার মধ্যে পাচার করা সোনা ছিল। বিশেষ তদন্ত দলের কাছে খবর এসেছিল যে মেয়েদেরে পার্স আর হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে সোনা পাচার হচ্ছে। পরীক্ষা করে দেখা যায়, ওই হ্যান্ডব্যাগ ও পার্সের রিংগুলো আসল সোনা দিয়ে তৈরী। চার কেজিরও বেশি সোনা উদ্ধার হয়েছিল ওই অভিযান থেকে।

বিমানে সোনা
ভারতে গত কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে বিমানে করে সোনা পাচার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিরেক্টরেট অব রেভেনিউ ইন্টেলিজেন্স বা ডিআরআই বলছে, ২০১৪ সাল থেকে পরবর্তী আড়াই বছরে তারা মোট সাত হাজার কিলোগ্রাম পাচার হওয়া সোনা উদ্ধার করেছে, যার দাম দুই হাজার কোটি রুপিরও বেশি। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম অর্দ্ধে প্রায় ৯১ কোটি টাকা মূল্যের সোনা উদ্ধার করা হয়েছে।

বিমানে করে সোনা পাচারের বিষয়টাও ওই সময়েই প্রথমে নজরে আসে গোয়েন্দাদের। গুয়াহাটি থেকে নিয়মিত ''অতি মূল্যবান দ্রব্য'' বলে একটি বিশেষ বেসরকারী এয়ারলাইন্সের বিমানে করে প্যাকেট আসতে শুরু করেছিল দিল্লিতে। মোট ৬১৭ বার ওভাবে 'বিশেষ' প্যাকেট আসাতেই সন্দেহ হয় গোয়েন্দাদের। আন্তর্দেশীয় বিমানেই আনা হচ্ছিল ওই 'বিশেষ' প্যাকেট,যাতে শুল্ক দপ্তর টের না পায়। মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ওই সোনা ভারতে আনা হয়েছিল বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।

গাড়ির ইঞ্জিন
এর আগে ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি এলাকায় একসঙ্গে ৮৭ কিলোগ্রাম সোনা ধরা পড়েছিল ডিআরআই'য়ের হাতে। একটি সদ্য কেনা গাড়ির ইঞ্জিনের মধ্যে লুকানো ছিল ওই সোনা। সেটাও মিয়ানমার থেকে মিজোরাম-আসাম হয়েই পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছিল বলে জানিয়েছিলেন কর্মকর্তারা।

গতবছর নরেন্দ্র মোদীর সরকার বড় ব্যাংকনোট বাতিল ঘোষণা করার পরের দুই মাসে ভারতের ৫৯টি বিমানবন্দর থেকে ৩৫১ কেজি সোনা, ৫০ কেজি রূপা উদ্ধার করেছিল বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় শিল্প নিরাপত্তা ফোর্স। সূত্র : বিবিসি