ঢাকায় জেনেভা ক্যাম্পে সংঘর্ষ
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে শনিবার দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে বিহারিদের। এতে পুলিশ, কাউন্সিলর ও বিহারিসহ আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। এর জেরে পুরো ক্যাম্পে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে পুরো ক্যাম্প এলাকায়। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ক্যাম্প এলাকায় মোতায়েন রয়েছে র্যাব ও পুলিশ।
প্রতিদিন সন্ধ্যার পর জেনেভা ক্যাম্পের সামনে মুসলিম, মোস্তাকিম, রহিম কাবাবসহ গোটা-দশেক কাবাবের দোকানে থাকে উপচেপড়া ভিড়। কাবারের দোকানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পানের দোকানে বিভিন্ন বিখ্যাত পান খেতে ভিড় থাকে।এছাড়া বোবার বিরিয়ানি, কামাল বিরিয়ানির মতো বিখ্যাত বিরিয়ানির দোকানে যে সময় ক্রেতাদের ভিড় থাকে তুঙ্গে সে সময়ে দোকানের শাটার বন্ধ।
সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত বেশির ভাগ দোকান। ভেঙে চুরমার করে দেয়া হয়েছে পানের দোকানগুলো। এ ঘটনায় আহত হয়েছে অনেক দোকান কর্মচারী। দিনের সেই আতঙ্ক বিরাজ করছে রাতে। খোলা হয়নি একটি দোকানও।
অনেকটা আতঙ্ক নিয়ে দোকান চালাচ্ছে জেনেভা ক্যাম্পের উত্তর পাশের বাবর রোডের দোকানিরা। একই অবস্থা ক্যাম্পের পূর্ব দিকের হুমায়ুন রোডে। সেখানে একটি লন্ড্রি দোকান, কয়েকটি চায়ের দোকান, কারচুপির পোশাক বিক্রির দোকান ও দুটি খাবার হোটেল ছাড়া অন্য দোকানগুলো খোলা হয়নি। শাহজাহান রোডের মতো একই অবস্থা দক্ষিণ পাশের গজনবী রোডে। একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজ ছাড়া বন্ধ রয়েছে বাকি সবকিছুই।
বিকাল চারটার পর পরিস্থিতি পুরোদমে স্বাভাবিক হয়ে এলেও যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে প্রস্তুত রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আনিসুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে। তবে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি যাতে না ঘটে তাই ছয় প্লাটুন পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। সেই সাথে বিপুলসংখ্যক র্যাব সদস্যও আছে।’
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
ক্যাম্পের বাসিন্দা কামাল হোসেন জানান, এক মাসেরও বেশি সময় ধরে জেনেভা ক্যাম্পে অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছিল বিদ্যুৎ বিপণনকারী সংস্থা ডিপিডিসি। এর প্রতিবাদে শুক্রবার রাস্তায় নামেন তারা। প্রতিবাদের মুখে ক্যাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরে।
শনিবার বেলা ১২টায় আবারও একই ঘটনা ঘটে। এসময় মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের পাশের রাস্তা শাহজাহান রোড ও গজনবী রোডে অবস্থান নেয় ক্যাম্পে বসবাসকারী উর্দুভাষীদের বিপুলসংখ্যক মানুষ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে আসেন ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান। এসময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়। কিছুক্ষণ পর তা রূপ নেয় হাতাহাতিতে। এরপরই বেলা একটা নাগাদ পরিস্থিতি সামাল দিতে লাঠিচার্জ করে কর্তব্যরত পুলিশ।
এরপর আন্দোলনকারীদের তুলে দিতে লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। পাশাপাশি কয়েক রাউন্ড রাবার বুলেট ছোঁড়ে। এসময় রাবার বুলেটের আঘাতে চোখ হারিয়েছেন রকি নামের এক যুবক। তিনি জেনেভা ক্যাম্পের একটি মোটর গ্যারেজের মেকানিক হিসেবে কাজ করতেন। এছাড়া সংঘর্ষে আহত হয় উর্দুভাষীদের অর্ধশতাধিক মানুষ।
সংঘর্ষ শেষে দলে দলে জেনেভা ক্যাম্পে ঢুকে পুলিশ সদস্যরা। এ সময় পুলিশের উপর হামলা ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে সাতজনকে আটক করা হয়।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জেনেভা ক্যাম্পের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী জানান, তারা এক মাসের বেশি সময় ধরে প্রতিদিন সাত থেকে আট ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শিকার। বিদ্যুতের দাবিতে রাস্তায় নেমে এলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হতো। প্রতিদিনের মতো শনিবার দুপুর ১২টায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে ক্যাম্পের অধিবাসীরা রাস্তায় নেমে আসে। সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে জনপ্রতিনিধি হাবিবুর রহমান মিজান ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। সেখানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর টিয়ারশেল, রাবার বুলেট এবং লাঠিচার্জ করলে অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়।
সংঘর্ষ চলাকালে আন্দোলনকারীরা শাহজাহান রোডের পাশে তাজমহল রোডে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের একটি গাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়ে দেয়। পুলিশ জানায়, সংঘর্ষের ১৫ থেকে ২০ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে।
ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ হতো যেভাবে
জানা যায়, জেনেভা কনভেনশনের আলোকে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হতো। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পরিচালক একটি থোক বরাদ্দের মাধ্যমে ডিপিডিসিকে এই বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতেন।
২০১৭ সালের ৩ জুলাই সর্বশেষ এই ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এরপর আর কোনো বিল পরিশোধ করা হয়নি। ফলে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত বকেয়া বিলের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪ কোটি ৬০ লাখ ৫৪ হাজার ৭০১ টাকা।
ক্যাম্পবাসীর অভিযোগ, ডিপিডিসির পক্ষ থেকে জেনেভা ক্যাম্পে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো এর গ্রাহক ক্যাম্পবাসী নন। বরং দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বিল বকেয়া থাকলে ডিপিডিসি ওই মন্ত্রণালয়ের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলবে।
ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ শামীম বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ ব্যবহার করি রিলিফের। যার বিল জাতিসংঘ থেকে আসে। এখন বাংলাদেশে যতগুলো ক্যাম্প আছে, তার কোনোটায় কোনো সমস্যা নাই। সমস্যা এই জেনেভা ক্যাম্প নিয়ে।’
সংকট সমাধানে ক্যাম্পবাসীর পক্ষ থেকে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, ডিপিডিসি ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার পাশাপাশি লিখিতভাবে আবেদন জানানো হয়েছে বলেও জানান জেনেভা ক্যাম্পের অধিবাসীরা।
জেনেভা ক্যাম্পের একশ গজের মধ্যে রয়েছে উর্দুভাষিদের আরও একটি ক্যাম্প। জান্নাতবাগ ক্যাম্প নামের ওই ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। একই অবস্থা জেনেভা ক্যাম্প থেকে তিনশ গজ দূরের কৃষি মার্কেট ঢোল ক্যাম্পেও। বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো সমস্যা নেই মোহাম্মদপুর টাউনহল ক্যাম্পেও।
শেয়ার করুন