বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ঘোষণাপত্র বা প্রোক্লামেশন তারাই তৈরি করবে। সব পক্ষের সাথে কথা বলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই ঘোষণাপত্র তৈরি হবে। যদিও সরকার এজন্য কোনো সময়সীমা বেধে দেয়নি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাদের ৩১ ডিসেম্বরের সমাবেশ থেকে এই ঘোষণাপত্রের জন্য সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেধে দিয়েছে।

সরকারের সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দূরত্বের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। তারা রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ড. ইউনূসের সরকার তাতে কান দেয়নি। শিক্ষার্থীদের এই দাবিতে সবচেয়ে আপত্তি জানায় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। ফলে রাষ্ট্রপতি এখনও বহাল আছেন। এরপর চিত্রনির্মাতা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকির উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে তীব্র আপত্তি তোলে শিক্ষার্থীরা। ফারুকির পদত্যাগ বা তাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবিতে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গরম করে রাখে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা এই দাবির সাথে একমত হননি। সেজন্য ফারুকি এখনও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত শিক্ষার্থীদের এবারের দাবি- বিপ্লবের ঘোষণাপত্র বা প্রোক্লামেশন অব রেভলিউশনের গতি কী হবে তা নিশ্চিত নয়।

গত ৩০ ডিসেম্বর গভীর রাতে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি থেকে সরে এসে কেন মার্চ ফর ইউনিটি নামে সম্মেলন করল, সে প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে ঢাকার আমার দেশ পত্রিকা লিখেছে, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া ঘোষণাপত্রের বিষয়ে সম্মত ছিলেন না অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ছাত্রদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, এ ঘোষণা হতে হবে সবার ঐকমত্যে। এটা না মানলে তিনি সরকারে থাকবেন না। উপদেষ্টাদের মধ্যেও এ নিয়ে বিরোধ ছিল। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল প্রস্তাবিত ঘোষণার ব্যাপারে সরাসরি বিরোধিতা করেন। গুঞ্জন ছিল- এ ইস্যুতে তিন ছাত্রউপদেষ্টা মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর মধ্যেও এ নিয়ে ছিল অস্বস্তি।” ঢাকার সাংবাদিক মহলে এই প্রচার ছিল, প্রধান উপদেষ্টার সরে যাওয়ার হুমকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের তাদের কর্মসূচী থেকে সরে আসতে বাধ্য করে।

এখন বিষয়টি চলে গেছে ড. ইউনূস সরকারের কোর্টে। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোসহ বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করবে সেটা দেখার বিষয়। ইতিমধ্যে এ নিয়ে রাজনৈতিক মতপার্থক্য প্রবল হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, একইসঙ্গে ছাত্র-জনতার আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন না ঘটলে সরকার ঘোষিত ঘোষণাপত্র মেনে নেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। সরকারের প্রস্তুতকৃত ঘোষণাপত্রে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য চান ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। কিন্তু এর সাথে একমত নয় বিএনপি। ঘোষণাপত্রের বিষয়টি সামনে আসতেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় বক্তব্য জানাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে তাদের তীব্র আপত্তির বিষয়টি জানিয়ে দেন মির্জা ফখরুল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ৭২-এর সংবিধানে কেউ হাত দিলে আমাদের গায়ে লাগে। কারণ এটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধান। দলটি মনে করে, বিগত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে এটা ঠিক। তাই বলে পুরো সংবিধান বাতিল করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। বিএনপি এখন চায়, গত ১৬ বছরে তারাসহ যেসব দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে তা এই ঘোষণাপত্রে থাকতে হবে।

তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা মানবজমিনকে বলেছেন, বর্তমান সংবিধান এত এত কাটাছেঁড়া হওয়ার পর তা যদি কার্যকর থাকে তাহলে জুলাই অভ্যুত্থান বিফলে যাবে। আমরা বলেছি, ৭২-এর সংবিধান পুরোপুরি বাদ দিতে হবে। সরকারের প্রস্তুতকৃত ঘোষণাপত্রে আমরা আশা করব এ দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির উল্লেখ থাকবে। জুলাই বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ থাকতে হবে। সরকার সব অংশীজনকে নিয়ে এ ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করতে যাচ্ছে। আমরা আশা করব সরকার এ বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেবে। যাতে ছাত্র-জনতার আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। ’৭২-এর সংবিধানের ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। উমামা ফতেমার এই বক্তব্য বিএনপিসহ বিভিন্ন দলকে আশাহত করতে পারে।

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলছেন, পাঁচ মাসে সরকার এ ধরনের উদ্যোগ নেয়নি, এখন নতুন করে উদ্যোগ নিয়ে কিছু করতে পারবে, তা তাঁর বোধগম্য হয় না। তিনি মনে করেন, সরকারের উচিত হবে আর কালক্ষেপণ না করে নতুন বছরের শুরুতেই সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা করে নির্বাচনের রোডম্যাপে যাওয়া।

নাগরিক অধিকার বিষয়ে সোচ্চার অধ্যাপক আনু মুহাম্মদও প্রথম আলোকে বলেছেন, এখন বিপ্লবী পরিবর্তনের বাস্তবতা আছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, পাঁচ মাস পর প্রোক্লেমেশন হয় না। সরকার পরিবর্তনের পরপর কীভাবে সামনে অগ্রসর হতে হবে, তা নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ ধরনের একটি প্রোক্লেমেশন হতে পারত; কিন্তু সেটা হয়নি। এখন সামনের দিনের পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ঘোষণা হতে পারে।

এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস