জিডিপির হিসাবে বিনিয়োগ স্থবির
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিনিয়োগ হিসাব করা হয়েছে ৩০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা ছিল ৩০ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অর্থাত্ এক বছরের ব্যবধানে দেশের জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের হার অনেকটাই স্থবির অবস্থায় রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করেছে। এতে এই তথ্য উঠে এসেছে। এর আগের দুই বছরের পরিসংখ্যানের সঙ্গে তুলনা করলে, এই হ্রাসমান পরিস্থিতি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিবিএসের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের হার ছিল ৩২ দশমিক ০৫ শতাংশ; এর আগের অর্থবছর ২০২০-২১ এ ছিল ৩১ দশমিক ০২ শতাংশ। সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের হার হতে হবে ৩৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা জানান, বাজেটে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলেও দীর্ঘদিন ধরেই এটি জিডিপির ৩০ থেকে ৩১ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকারের বিনিয়োগ বেশ বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অস্থিরতা, অন্যদিকে দেশের ভেতরে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব যেভাবে প্রকট হচ্ছে, তাতে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি কবে বিনিয়োগকারীদের জন্য অনুকূল হবে, তা বলা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের সাহস পাচ্ছেন না। দেশের অভ্যন্তরে এখন ডলারের দরে অস্থিরতা চলছে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আগের অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরও সরকার কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অনুসরণ করছে। এর প্রতিফলন সরকারি বিনিয়োগেও দেখা যাচ্ছে। চলতি বছরের বাজেটে সরকারি বিনিয়োগ এর আগের অর্থবছরের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। সরকার মূলত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে থাকে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এখাতে বরাদ্দের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ২ লাখ ৬৫ হজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ফলে এডিপি বাস্তবায়ন পরিস্থিতি চলতি অর্থবছরের তুলনায় ভালো না হলে আগামী অর্থবছরেও সরকারি বিনিয়োগ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
তবে নতুন অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগের হার কিছুটা বাড়তে পারে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবসার পরিবেশ সহজ করার পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুত্ পরিস্থিতির উন্নতি হলে ব্যবসায়ীরা কিছুটা আস্থা পাবেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, শিল্পের জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবেও অনেকে বিনিয়োগে নিরুত্সাহিত হচ্ছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি। আর এই সমস্যাগুলোকে আরো জটিল করে তুলেছে দেশে ব্যবসা পরিচালনার ক্রমবর্ধমান ব্যয় ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এতে কমে যাচ্ছে ব্যবসায়ের মুনাফা। সবকিছু মিলিয়ে বিনিয়োগে উত্সাহ পাচ্ছেন না সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে সঞ্চয় প্রবণতায় কিছু উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন এবং ব্যাংক ঋণের ওপর আরোপিত ক্যাপ প্রত্যাহারের কারণে সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের ডমেস্টিক সেভিংস বা অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের হার জিডিপির অনুপাতে ২৬ থেকে ২৭ শতাংশের মধ্যে ছিল। ২০২০ সালে আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দেওয়ার পর আগের বছরের ২৭ দশমিক ০৮ শতাংশ থেকে তা ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশে নেমে আসে। এর পরের অর্থবছরে এই হার আরো কমে ২৫ দশমিক ২২ শতাংশ হয়।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের হার সামান্য বেড়ে ২৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং সুদহারের ক্যাপ তুলে নেওয়ার কারণে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে এই হার বৃদ্ধি পেয়ে ২৭ দশমিক ৬১ শতাংশে উন্নীত হবে বলে পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। একইভাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ন্যাশনাল সেভিংস বা জাতীয় সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল জিডিপির অনুপাতে ৩১ দশমিক ৪২ শতাংশ, যা পরের অর্থবছরে কমে ৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশে নেমে যায়।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন