আপডেট :

        ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাবদাহে ব্রাজিল

        সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক অবরোধ

        প্রধানমন্ত্রী-ক্রাউন প্রিন্সেসের সাক্ষাৎ

        জলদস্যুতা নির্মূলে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ: মোদি

        সাব-রেজিস্ট্রার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ

        সাকিব ইস্যুতে ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য

        ২০০০ পিস ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার

        আসন্ন ঈদে বিআরটিসির ৫৫০টি বাস

        সাদিপুর ওয়েলফেয়ার সোসাইটি ১০ লক্ষ টাকা অনুদান

        হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে ৯ জনের যাবজ্জীবন

        রিশাদের ব্যাটে বাংলাদেশের সিরিজ জয়

        কণ্ঠশিল্পী খালিদ মারা গেছেন

        বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ

        গুণী প্রধান শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদান

        বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃ‌তিতে আইরিশ মন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন

        ইসলামবিদ্বেষ ঠেকাতে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস

        বাংলাদেশ-বৃটেন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫১ বছর: বৃটিশ হাইকমিশনার

        ঢাকায় সুইডিশ রাজকন্যা

        ইরাকের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তা করবে আইএইএ

        বিস্ফোরক মামলায় যুবদল-ছাত্রদলের ৪ নেতা কারাগারে

ভারতীয়দের ধর্মান্তর: অতীত থেকে বর্তমান

ভারতীয়দের ধর্মান্তর: অতীত থেকে বর্তমান

এমনিতেই ৩০ জানুয়ারি দিনটি স্মরণীয়। হিন্দুত্ববাদীদের হাতে ঐদিন গিয়েছিল জাতির জনক মহাত্মা গন্ধীর প্রাণ। তা গত বছরের ৩০ জানুয়ারি আরো একটু বেশি স্মরণীয় হয়ে উঠেছিল। দলিত ক্যামেরা নামক ইউটিউব চ্যানেলের প্রতিষ্ঠাতার ইসলামে ধর্মান্তরে।


২০১২ সালে হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রবীচন্দ্রন বথরান প্রতিষ্ঠা করেন 'দলিত ক্যামেরা' নামক ইউটিউব চ্যানেল। উদ্দেশ্য, ভারতের দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের জীবন তুলে ধরা। এই রবীচন্দ্রন ২০২০ সালে ইসলামে ধর্মান্তরিত হন। তাঁর নতুন নাম হয় রইস মহম্মদ।এই পরিবর্তনের কারণ সম্বন্ধে প্রিন্ট নামক একটি ওয়েবসাইটে জানিয়েছেন, আত্মসম্মানের সঙ্গে জীবনধারণই এর কারণ।

তাঁদের বংশানুক্রমিক পেশা মেথরগিরি। এই পেশাকে হিন্দুসমাজ দেখে অত্যন্ত হীন চোখে। তাদেরকে হিন্দুসমাজ বলে অস্পৃশ্য। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বাড়ি যেতে পারেন না তাঁরা। তাঁর মতো শিক্ষিত হলেও পরিত্রাণ নেই। যিনি অস্পৃশ্য জাতে জন্মগ্রহণ করেছেন, তিনি যতই শিক্ষিত হোন না কেন, অস্পৃশ্য হয়েই থাকবেন। এটাই উচ্চবর্ণের বানানো জাতপ্রথার বিধান। এর শেকল বড়োই মজবুত।

রবীচন্দ্রণের মতো নিম্নবর্ণের মানুষরা প্রথম থেকেই দলে দলে হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে অন্যধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এবং তা ঐ জাতপ্রথার কড়াকড়ির জন্য। প্রথমে এঁদের পছন্দের ছিল বৌদ্ধধর্ম। পরে আরব বণিকদের মাধ্যমে অখণ্ড ভারতবর্ষে ইসলাম ছড়িয়ে পড়লে এঁরা এই ধর্ম গ্রহণ করে। কিছু খ্রিস্টধর্মও গ্রহণ করেছে। তবে যেটা বলার কথা, ভারতের খ্রিস্টান বা মুসলমানরাও আদ্যোপান্ত ভারতীয়। এঁরা কেউই ইউরোপ বা আরব থেকে উদয় হননি।


এই প্রসঙ্গে উঠে আসে চের রাজা চেরমন পেরুমলের কথা। এঁর পুরো নাম চেরমন পেরুমল রাম বর্মা কুলক্ষেত্র। তখন কেরল মহোদয়পুরম নামে পরিচিত ছিল। ইনি ছিলেন সমগ্র মহোদয়পুরমের রাজা। মালাবার উপকুলে আসা আরব ব্যবসায়ীদের প্রভাবে ইনি ইসলাম ধর্মে আকৃষ্ট হন এবং মক্কায় গিয়ে রসূলের কাছ থেকে এই ধর্ম গ্রহণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। মক্কা যাওয়ার আগে তাঁর রাজ্যকে তিন ভাগ করে তা পুত্র এবং ভাগনাদের মধ্যে বিলি করেন। এর পর মক্কায় গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি।  তাঁর নাম হয় তাজউদ্দিন। কিন্তু ফেরার পথে ওমানে তাঁর মৃত্যু হয়। এর পর  রসূল তাঁর সহচর মালিক ইবন দিনারকে নির্দেশ দেন কেরালায় গিয়ে এই নতুন ধর্ম প্রচার করতে।  দিনারের কথায় আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে কেরলের মানুষ এই ধর্ম গ্রহণ করেন। বিশেষত সেইসব মানুষ যাঁরা বর্ণাশ্রমের জাতাকলে পিষ্ট। প্রথম ধর্মান্তরিত হন মাপিলা বা মোপলা জনগোষ্ঠী। এঁরা ধনী ব্যবসায়ী শ্রেণি। কিন্তু সামাজিক শ্রেণিবিভাজনে ব্রাহ্মণদের থেকে অনেক নিচের ধাপের। সুতরাং ব্রাহ্মণশ্রেণির নির্যাতনের শিকার। ধর্মান্তরকরণের সাথে সাথে দিনার অনেকগুলি মসজিদও স্থাপন করেন। যার প্রথমটি হয় রাজা চেরমনের নামে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৬২৯ সাধারণাব্দে।

এর মানে এই নয় যে জোর করে ধর্মান্তর একেবারেই ঘটেনি। হয়েছে। তবে তা একেবারেই ক্ষুদ্র অংশে। মোটামুটি চারটি কারণে ধর্মান্তর ঘটেছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণটি হল, শাসকের ধর্ম গ্রহণ করার স্বাভাবিক প্রবণতা। তখন মনে করা হত, শাসকের ধর্ম গ্রহণ করলে সরকারি সুযোগসুবিধা মিলবে। সে-কারণেই বাংলায় পাল আমলে সবাই বৌদ্ধ ছিল। এই প্রবণতার সঙ্গে যোগ হয়েছিল সুফি সন্তদের ব্যবহার, যা এক বিরাট অংশের মানুষকে ওই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। কর্নাটকের বাবা বুদানের নাম এ-প্রসঙ্গে করতেই পারা যায়। মনে করা হয়, ভারতে কফির প্রচলন করেন এই সাধকটিই। উনি তাঁর ভক্তদের নিজ হাতে এই পানীয়টি পরিবেশন করতেন।

তবে সুফি সাধকদের মতো আরব ব্যবসায়ীরাও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের, বিশেষত সমুদ্র বিধৌত দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের, সঙ্গে জলপথে আরবের যোগাযোগ ছিল অনেকদিন ধরেই। ভাস্কো দা-গামা যে জলপথ আবিষ্কার করেন বলে প্রচার, তার হদিশ অনেককাল আগেই জানত আরব ব্যবসায়ীরা। ভারতে তারা আফ্রিকা থেকে কিনে আনা বিভিন্ন দ্রব্য বিক্রয় করত। এরা নতুন ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করলে ভারতে এই ধর্মের কথা প্রচার করে। তাদের মাধ্যমেই ভারতীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই ধর্ম। ভারতে প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয় ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ, মহম্মদ বিন কাশিমের ভারত আক্রমণের ৮২ বছর আগে।

৭১১-৭১২ সাল নাগাদ সিন্ধুপ্রদেশ আক্রমণ করেন মুহম্মদ বিন কাশিম।তখন সিন্ধুপ্রদেশের রাজা ছিলেন দাহির। তাঁর অকর্মণ্যতার কারণে প্রদেশটিতে বেকারি চরমে উঠেছিল। তার পর তো ছিলই জাতপাতের বিষয়টি।  বলাবাহুল্য, প্রজারা ছিলেন এই রাজার প্রতি ক্ষিপ্ত। তারা কাশিমকে সাহায্য করে বলেই জানা যায়।

যাই হোক, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, জয়ের পরেও সিন্ধুপ্রদেশ 'মুসলিম' করেননি বিন কাশিম। 'তলোয়ারের ডগা' দিয়েই যদি সব ধর্মান্তর ঘটে থাকে, তবে এক্ষেত্রে তা করায় অসুবিধা কী ছিল? বরং পাকিস্তানি ঐতিহাসিক ডঃ মুবারক আলি দেখিয়েছেন, ইসলামীকরণের জন্য বিন কাশিম সিন্ধুপ্রদেশ আক্রমণ করেননি। সেই সময় ওখানকার লোকেরা আরব বাণিজ্যতরী আক্রমণ করে লুটপাট চালাত, তার একটা বিহিত করতেই তাঁর সিন্ধুপ্রদেশ আক্রমণ। আর তখন রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ধিকিধিকি জ্বলছিলই। এর কারণ, সীমাহীন দারিদ্র্য আর বেকারি। তার সঙ্গে তো জাতপাতের বিষয়টি ছিলই। এসব কারণে দেখা যায় কাশিমের বিজয়ের পরই বেশকিছু গোষ্ঠীপতি সর্দারকে ইসলাম গ্রহণ করে নতুন রাজার পাশে এসে দাঁড়ানোয়। এর পর কাতারে কাতারে ধর্মান্তরিত হন সেখানকার মানুষেরা।

এই একই জিনিস ঘটেছিল বাংলায়।  সূফি সাধুরা সপ্তম শতক থেকে উপস্থিত হলেও, বড় আকারে ধর্মান্তর দেখা গেল বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের পরই। যার অনেকগুলি কারণের মধ্যে একটি ঠিক সেটি যার কারণে রবীচন্দ্রন রইস মহম্মদ হলেন। অর্থাৎ হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরে থাকা জাতিভেদপ্রথা। এই প্রথার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য স্বয়ং আম্বেদকরকে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে হয়েছিল। আজও পার্ক সার্কাস তিন নম্বর ব্রিজের নীচে থাকেন যেসব মানুষ, তাঁদের সবাই দলিত হিন্দু পরিবার থেকে আগত। হিন্দুধর্মের জাতিভেদ জনিত অত্যাচারের শিকার হয়েই যাঁদের ধর্মপরিবর্তন।

তাই ধর্মপরিবর্তন রুখতে গেলে প্রথমেই জাতিভেদপ্রথাকে মারতে হবে টুঁটি টিপে। অন্য ধর্মের উপর দোষারোপ করলে চলবে না।

শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত