আপডেট :

        ধর্ষণ মামলায় হার্ভকে দোষী সাব্যস্ত করে ২০২০ সালে দেওয়া রায় বাতিল

        ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভের জেরে স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়

        ট্রাম্পের বিচার নিয়ে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট

        যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ দমনে মারমুখী পুলিশ

        ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেফতার শতাধিক

        পশ্চিম ভারত মহাসাগর অঞ্চলে মাদক পাচার এবং মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার বিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে

        গাজা উপকূলে অস্থায়ী বন্দর যুক্তরাষ্ট্রের !

        রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করার নির্দেশ

        জাতীয় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের অবদান কখনোই ভুলবার নয়

        ৮৮ আসনে দুপুর পর্যন্ত কত ভোট পড়লো

        ২৬ জেলার ওপর তাপপ্রবাহ

        চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ রেকর্ড ৪২.৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা

        চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ রেকর্ড ৪২.৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা

        কেন্দ্রীয় কি ঋণখেলাপি ও অর্থপাচারের সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করছে, প্রশ্ন টিআইবির

        ইসরায়েল বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার

        বিমান হামলায় নিহত এক নারীর গর্ভ থেকে প্রসব হওয়া সন্তানটি মারা গেছে

        ফেনীতে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে কিশোর গ্যাং গ্রেফতার

        তাপ্প্রবাহে ভাঙল ৭৬ বছরের রেকর্ড

        তিন দিনের সফরে বর্তমানে চীনে রয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন

        ভারতীয় দলে হার্দিক পাণ্ডিয়া ও বিরাট কোহলি নেই

বিশ্বখ্যাতদের এক ডজন বিচিত্র ঘটনা

বিশ্বখ্যাতদের এক ডজন বিচিত্র ঘটনা

যে কবির ঘরবাড়ি ছিল না

'হোম সুইট হোম' নামের একটি মাত্র কবিতা লিখেই পৃথিবীর সর্বত্র 'জন হাওয়ার্ড পেইন'-এর নাম কবি হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে এবং সে সময় সমস্ত কবিতা প্রেমিকের মুখে মুখেই এই কবিতার লাইনগুলো অনবরত শোনা যেত। কবিতাটা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই অনুবাদ হয়ে যায় নানান ভাষায়। ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। কবিতাটির প্রতি শব্দের ভাঁজে ভাঁজে সুরকারেরা খুঁজে দেন সুর। শুধুমাত্র একটি কবিতার জন্য এত জনপ্রিয়তা সম্ভবত অন্য আর কোনও কবির ভাগ্যে জোটেনি।
কবিতাটি লেখা হয়েছিল ছবির রাজধানী প্যারিসে। যেখানে অঢেল শ্যাম্পেন, কফি আর প্রাচুর্য। যে সময়ে কবিতাটি কবি লিখেছিলেন, ঠিক সেই সময় তাঁর দুটি পকেটই ছিল একদম খালি। প্রাচুর্যের মালভূমিতে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ন কপর্দকহীন কবি লিখে ফেললেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা--- হোম সুইট হোম। পরে যার বাংলা অনুবাদ হয়, 'ঘর সুন্দর ঘর'। কবির শুধু এই কবিতাতেই নয়, তাঁর অন্যান্য কবিতাতেও ধরা পড়েছে ছোট্ট একটি ঘরের স্বপ্ন। সারাটা জীবন ধরে ঘরের স্বপ্ন দেখে গেছেন কবি। ঘরই ছিল তাঁর আশা। ঘরই ছিল তাঁর একমাত্র চাওয়া। ঘরই ছিল তাঁর কাছে সব কিছু। কিন্তু ঘর তো দূরের কথা, একটা বারান্দাও ছিল না তাঁর। তিনি থাকতেন একটি পরিত্যক্ত পার্কের পাপে বড় একটি গাছের তলায়। ছোট্ট মতন একটি ঝুপড়ি বানিয়ে।
একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করে এত প্রবল‌ জোরে তুষারপাত শুরু হল যে, তাঁর কোনও রকমে জোড়াতাপ্পি দিয়ে বানানো অস্থায়ী ঝুপড়ির ছাউনিটা এক ঝটকায় উড়িয়ে নিয়ে গেল দমকা বাতাস। কোথায় মাথা গুঁজবেন তিনি! দিশেহারা হয়ে ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সামনের একটা বাড়ির ঝুল-বারান্দায় নীচে। কিন্তু তাতেও তুষার ঝাপটার হাত থেকে নিজেকে কিছুতেই বাঁচাতে পারছিলেন না। বেশ খানিকটা ভিজেও গিয়েছিলেন। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছিলেন। এমন সময় তাঁর কানে ভেসে এল একটা পরিচিত গানের সুর। কান পেতে শুনলেন, সমবেত ভাবে কারা যেন তাঁর 'হোম সুইট হোম' গানটা গাইছে। কারা? দরজার ঘুলঘুলিতে চোখ রাখলেন কবি। দেখলেন, কিছু তরুণ ছেলেমেয়ে আগুন পোয়াচ্ছে আর হাততালি দিয়ে দিয়ে গানটি গাইছে।
তিনি মনে মনে‌ ভাবলেন, গানটি আমার লেখা, এই পরিচয় দিলে হয়তো এখানে একটু আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে। মিলতে পারে ফায়ার প্লেসের আগুন পোয়ানোর সুযোগ। এই আশা নিয়েই তিনি দরজা ধাক্কালেন।‌ একটি মেয়ে এসে দরজা খুলতেই তিনি তাঁর পরিচয় দিলেন। কিন্তু তাঁর ভিখিরির মতো পোশাক-আশাক আর তাঁর চেহারা দেখে তাঁর কথা সে বিশ্বাস করল না।
এই দুর্যোগের রাতে কে এল? দেখার জন্য যারা ওই মেয়েটির সঙ্গে দল বেঁধে গান গাইছিল, ততক্ষণে গান থামিয়ে তারাও বেশ কয়েক জন মেয়েটির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। লোকটির কথা শুনে তারা ভাবল লোকটা নিশ্চয়ই একটা পাগল।‌ তাই আর কথা না বাড়িয়ে মুখের সামনে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।
ছেলেমেয়েগুলোর এই ব্যবহারে তিনি এতটাই মর্মাহত হলেন যে, তখনই তিনি ওই তুষার-ঝড়ের মধ্যেই বারান্দা থেকে রাস্তায় নেমে এলেন।
'হোম সুইট হোম' লেখার এক বছর পরেই গৃহহীন এই কবি সে দিনের সেই তুষারপাতে ভিজে মারাত্মক টিউনিস রোগে আক্রান্ত হন এবং ক'দিন পরেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।
আমরা জানি না, মারা যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সেই কাঙ্খিত ছোট্ট বাড়িটির স্বপ্ন তাঁর‌ চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল কি না।


প্রতি সংস্করণে সংযোজন

এখন এই মুহূর্তে আমরা যদি 'লিভস্ অব গ্রাস' কাব্যগ্রন্থটির সূচিপত্র সামনে তুলে ধরি, তা হলে দেখতে পাব প্রায় সাড়ে চারশোর মতো কবিতা রয়েছে সেখানে। অথচ এই বইটি আঠেরটশো পঞ্চান্ন সালে যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন এই বইটিতে কবিতার সংখ্যা ছিল মাত্র বারোটি। এই অল্প সংখ্যক কবিতার পাতলা চটি বইটিই পরবর্তিকালে একটি অসামান্য সাহিত্যকীর্তি হিসেবে গোটা বিশ্বের সর্বত্র স্বীকৃতি পায়।
বইটির কবিতাগুলি লিখেছিলেন আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান। সারা জীবন ধরে তিনি এই একটিই মাত্র কবিতার বই লিখে গেছেন।‌ তাঁর বয়স যখন বছর ছত্রিশ, তখন এই সংকলনটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
তা হলে আজ 'লিভস অব গ্রাস'-এ কবিতার সংখ্যা এত হল কী করে! আসলে এই বইটি বেরোবার পরেও আরও অনেক কবিতা লিখেছেন এই কবি এবং সেগুলিকে নিয়ে আর আলাদা কোনও বই না করে, প্রকাশিত ওই বইয়েরই পরবর্তী সংস্করণগুলোতে কিছু কিছু করে জুড়ে দিয়েছেন।‌যখন যে ক'টা লেখা হয়েছে, সে ভাবেই অন্তর্ভুক্তি হয়েছে। এই ভাবে প্রত্যেক সংস্করণে নতুন কবিতা যোগ করতে করতে কবির বয়স যখন তিয়াত্তর বছর, অর্থাৎ যে বছরে কবি মারা যান, আঠারোশো বিরানব্বই সালে এই বইটির নবম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বইটিতে কবিতার সংখ্যা তখন চারশো তেইশ।
মাত্র একটি বইতে এই ভাবে প্রত্যেক সংস্করণে পরবর্তী লেখাগুলো যোগ করে করে, জীবনের সমস্ত কবিতা একই গ্রন্থে বন্দি করার প্রথম নজির‌ সৃষ্টি করেন ওয়াল্ট হুইটম্যান।


উপেক্ষিত লেখিকা

নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পুরস্কার প্রাপকের বিভিন্ন বই নানান ভাষায় অনুবাদ হতে দেখা যায়। দেখা যায়, বড় কোনও পুরস্কার তো নয়ই, এমনকী ছোটখাটো‌ দেশীয় পুরস্কার না পেলেও কিংবা তেমন জনপ্রিয়তা না জুটলেও, মোটামুটি লিখতে পারলেই বহু লেখকের বই, অন্য ভাষায় না হলেও অন্তত ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। কিন্তু এর একমাত্র ব্যতিক্রম--- গ্যাব্রিয়েলা মিস্তাল।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্মান পাওয়ার প্রায় এগারো বছর পরেও কেবল একটি ছোট্ট সংকলন ছাড়া তাঁর আর কোনও বইই ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়নি। শুধু তাই-ই নয়, তাঁর নিজের দেশীয় স্প্যানিস কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ সংকলনগুলোতেও, যেখানে সদ্য লিখতে আসা একদম তরুণ কবিদের কবিতাও ঠাঁই পায়, সেই সব সংকলনগুলিতেও তাঁর কোনও কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় না। আরও বিস্ময়ের কথা, বাস্ক ও আমেরিন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত এই কবির অনেক লেখাই আজও বিভিন্ন কাগজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। গ্রন্থিত হয়নি। প্রামাণ্য রচনাবলি তো দূরের কথা। অথচ ১৯১৪ সালে তাঁর Sonetos de la Muerte বা মৃত্যুর সনেট নামক কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সাহিত্যজগতে হইচই পড়ে যায়। তখনই তিনি যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেন।
১৯৫৭ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি যখন দীর্ঘদিন ক্যানসারে ভুগে মারা যান, তখনও তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রথম শ্রেণির দৈনিকগুলোতে তো নয়ই, অনেক সাহিত্য পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়নি। হয়নি কোনও শোকসভাও।
১৯৪৫ সালে প্রথম লাতিন আমেরিকান হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরেও, নিজের দেশে এবং বিদেশে আর কোনও কবি বা লেখককে তাঁর মতো এমন ভাবে উপেক্ষিত হতে দেখা যায়নি।
তাঁর পুরো নাম ছিল---  লুসিলা দে মারিয়া দেল পেরপেতুও সোকোরো গোদোয় আলকায়াগা। কিন্তু
গ্যাব্রিয়েলা মিস্তাল নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। না, তিনি শুধু একজন কবিই ছিলেন না, ছিলেন কূটনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং প্রথম সারির একজন নারীবাদী কর্মীও।
তবু ১৮৮৯ সালের ৭ এপ্রিলে জন্মগ্রহণ করা এই কবি কিন্তু নিজের নামে কবিতা প্রকাশ করতে রাজি হননি। কারণ তিনি প্রথম কবিতা লিখেছিলেন, তাঁর প্রেমিকের হঠাৎ আত্মহত্যার বেদনাতে কেন্দ্র করে।
এই সময় একটি কবিতা প্রতিযোগিতায় এই বিষয়ের ওপরেই তিনটি সনেট লিখে পাঠিয়ে দেন তিনি। তাঁর ভয় ছিল, এই রকম বিষয় নিয়ে কবিতা লেখার জন্য তাঁর অবৈতনিক বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রীর চাকরিটি খোয়া যেতে পারে। তাই তিনি ছদ্মনাম গ্রহন করার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু কী নাম নেবেন তিনি? অনেক ভেবেও তেমন কোনও নাম ঠিক করতে না পেরে, অবশেষে তিনি তাঁর দুই প্রিয় লেখকের নাম থেকে বেছে নেন একটি করে শব্দ। একজনের নাম আর একজনের পদবি--- এই নিয়ে তৈরি করে ফেললেন তাঁর নিজের নাম। ছদ্মনাম।
এ দু'জনের একজন হলেন ইতালির বিখ্যাত কবি, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল দান্নুনৎসিও আর অন্য জন হলেন ফ্রান্সের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি ফেডেরিক মিস্তাল। ফলে তিনি পরিচিত হলেন--- গ্যাব্রিয়েল মিস্তাল নামে।
বলতে বাধা নেই, দক্ষিণ আমেরিকার কবিতায় আধুনিকতার সূচনা যাঁদের হাতে, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম তিনি। কত কবি লেখক‌ যে তাঁর কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তার হিসেব নেই।‌ স্বয়ং পাবলো নেরুদা পর্যন্ত অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এই মহিলা কবির কবিতা থেকে। অথচ তার মতো উপেক্ষিত আর কাউকে হতে দেখা যায়নি।


এক সুটকেস পাণ্ডুলিপি

জার্মানির লুবেক শহরের বিখ্যাত মান পরিবারের টমাস যখন রোম থেকে মিউনিখে ফিরে এলেন, তখন মাঝারি সাইজের একটি সুটকেস নিয়ে প্রায় সব সময়ই তাঁকে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল। এতে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন, আরও অবাক হলেন যখন সবাই জানতে পারলেন যে, ওই স্যুটকেসে কোনও জামা কাপড় নয়, রয়েছে কাগজের বিশাল একটা বান্ডিল। সেটা‌ এতটাই মোটা যে, স্যুটকেসটা আটকাতে গেলে বেশ‌ বেগ পেতে হয়। পরে জানা গেল ওটা আসলে একটি পাণ্ডুলিপি।
এত মোটা পাণ্ডুলিপি? আয়তন নিয়ে যখনই কেউ কিছু বলতে শুরু করতেন, তখনই আত্মরক্ষার জন্য টমাস বেশ একটু তৈরি হয়েই বলতেন, 'খুব বেশি মনে হচ্ছে কি? কাগজের এক পিঠে লেখা তো! তাও বড় বড় অক্ষরে। মাত্র আঠেরোশো‌ সত্তরখানা স্লিপ।' তারও পরে টমাস একটু ইনিয়ে-বিনিয়ে বোঝাতে চাইতেন যে, তাঁর লেখা প্রথম বই 'লিটলহার ফ্রিডেমান' বেশ জনপ্রিয় হওয়ায় বার্লিনের যে প্রকাশক তাঁকে লেখার জন্য বারবার করে তাগাদা দিচ্ছিলেন, তাঁদের জন্যই তিনি এটা লিখেছেন।
কিন্তু লেখা তৈরি হলেও, ক্ষুদে ক্ষুদে হস্তাক্ষরে লেখা ওই বিশাল‌ পাণ্ডুলিপিটা ছাপা হলে যে বিপুল পৃষ্ঠা সংখ্যা দাঁড়াবে, তার কথা ভেবেই প্রকাশক নড়েচড়ে বসলেন। লেখককে বললেন, পাণ্ডুলিপিটার অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দিতে হবে।‌ না হলে আমার পক্ষে এই বই করা সম্ভব নয়।
লেখক বেঁকে বসলেন। প্রকাশকও। অবশেষে এই নিয়ে লেখক আর প্রকাশকের মধ্যে অনেক বাগবিতণ্ডার পর শেষ পর্যন্ত একটা ছাত্রও বাদ না দিয়ে, পুরো অ্যান্টিক কাগজে মোটা মোটা দুটো খণ্ডে প্রকাশক বের করলেন লেখকের দ্বিতীয় উপন্যাস--- 'বাডেন ব্রুকস'।
এটা বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে সমালোচকেরা বইয়ের আয়তন দেখেই ভীষণ চটে গেলেন। এত বড় বইয়ের পুরোটা পড়ে তার পর সমালোচনা করতে হবে! ক্রেতারাও চটে গেলেন‌ দাম শুনে। কারণ, নেহাত অনিচ্ছায় ছাপা এই বইয়ের একটাও কপি বিক্রি হবে কি না আশঙ্কা প্রকাশ করে, প্রকাশক এমন দাম করেছিলেন, যাতে কোনও রকমে একটা বই বিক্রি হলেই অন্তত তিনটে বইয়ের খরচ উঠে আসে। লাভের আশা তো দূরের কথা, পনেরো কি বিশ বছরেও এই খরচটা আদৌ উঠবে কি না তা নিয়ে প্রকাশকের যথেষ্ট সংশয় ছিল।
কিন্তু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ দুঁদে প্রকাশকের সমস্ত হিসেব-নিকেশ ভুল প্রমাণিত করে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই‌ তিন হাজার কপির প্রথম মুদ্রণ নিঃশেষিত হয়ে গেল।
তার পরে সেই বইটির কতগুলো সংস্করণ যে বেরিয়েছে এবং কতগুলো ভাষায় যে অনূদিত হয়েছে, তার আর কোনও হিসেব নেই।
এই হচ্ছেন ১৮৭৫ সালের ৬ জুন জন্মগ্রহণ করা দুনিয়া কাঁপানো লেখক--- টমাস মান। যিনি ১৮৫৫ সালের ১২ই আগস্ট সুইজারল্যান্ডের জুরিখ‌ থেকে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চিরদিনের জন্য চলে যান। যিনি শুধু লেখালিখির জন্যই ১৯২৯ সালে পেয়েছিলেন সাহিত্যের সেরা পুরস্কার নোবেল প্রাইজ।


স্ত্রীর কফিনে সমস্ত রচনা

ছবি আঁকা এবং লেখালেখির জন্য যিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, পি-রাফেলাইট কবি গোষ্ঠীর যিনি ছিলেন পুরোধা, সেই দান্তে গ্যাব্রিয়েল‌ রসেটি-র কোনও লেখাই হয়তো পরবর্তী কালের কোনও পাঠকই আর পড়তে পারতেন না। দেখার সুযোগ পেতেন না তাঁর আঁকা সুন্দর সুন্দর ছবিগুলিও।
নানান মৌলিক সৃষ্টির জন্য যখন তিনি সবার নজর কাড়ছেন, ঠিক তখনই একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। নাম--- এলিজাবেথ সি ডল। কয়েক দিনের মধ্যেই সেই আলাপ থেকে তাঁদের গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। বন্ধুত্ব থেকে একেবারে প্রেম। পরে সেই প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। প্রাণের থেকেও তিনি তাঁকে বেশি ভালবাসতেন। মেয়েটিও তাঁকে ভালবাসত একই রকম ভাবে। দারুণ সুখে জীবন কাটছিল তাঁদের।
এই সময়ে নিশ্চিন্ত মনে রসেটি লিখছিলেন আরও ব্যাপক হারে। কিন্তু মাত্র দু'বছর। অপরূপ সুন্দরী স্ত্রী মাত্র কয়েক দিনের জোরেই এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে হঠাৎই চলে গেলেন। এলিজাবেথের শোকে পাথর হয়ে গেলেন তিনি। যে সৃষ্টির উপাসনা তিনি এত দিন ধরে করেছেন, বাকিটা কেমন হবে কল্পনা করে রেখেছেন, তা যেন এক লহমায় তাঁর চোখের সামনে আচমকাই খানখান হয়ে ভেঙে পড়ল।
যে কোনও সৃষ্টিকর্তাই হাজারও প্রতিকূলতার মধ্যেও‌ তাঁর সৃষ্টিকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতে চান। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটল রসেটির বেলায়। তিনি বললেন, আমি সারা জীবন ধরে যা করেছি, তার কোনও মূল্য নেই। তবু এগুলোই আমি আমার বউকে উৎসর্গ করতে চাই। করলেনও তাই। নিজের সমস্ত রচনা এবং‌ আঁকা ছবিগুলো‌ স্ত্রীর কফিনের ভেতরে দিয়ে স্ত্রীকে সমাধিস্থ করে দিলেন।
তাঁর অগণিত পাঠকেরা ভেঙে পড়লেন। বন্ধুরা হতভম্ব। তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা চলল কত। আসতে লাগল অনুরোধের পর অনুরোধ। উপরোধ। তবু তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়।
তাই তাঁকে লুকিয়েই তাঁর বন্ধুরা এবং তাঁর অনুরাগীরা একদিন চুপিসাড়ে ওই কবর খুঁড়ে উদ্ধার করে আনলেন তাঁর সমস্ত রচনা এবং ছবি। যা থেকে প্রমাণ হয়, তাঁর থেকেও চিন্তাশীল এবং শক্তিমান কবি ও চিত্রকর এই পৃথিবীতে হয়তো থাকলেও থাকতে পারেন, কিন্তু তিনি তাঁর নিজের জায়গায় একদম অনন্য।
সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য তিনি রেখে গেছেন অপরূপ মহিমান্বিত শিল্পবৈভব, জীবনরস‌ আর কাঙ্খিতদের জন্য সংসারের কামনা-বাসনার কাহিনি। চিত্রপ্রিয়দের জন্য তন্ময় করা সুন্দর সুন্দর রেখা, রং।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বউকে ভালবাসার নজির সৃষ্টি করেছেন অনেকেই, কিন্তু এ রকম উজাড় করা স্বতন্ত্রতা নিঃসন্দেহে বিরল এবং বিরলতম।


লেখকের পদবি রহস্য

নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন এমন লেখক আর আছেন কি না বলা মুশকিল, যাঁর পদবি নিয়ে এ রকম এক কৌতুকময় বেদনা জড়িয়ে আছে। নাট (কনুট) হ্যামসূনের পদবিটাকে 'হ্যামসূন' না বলে 'পেডারসেন' বলাই ঠিক। কারণ নাট হ্যামসূন নামে গোটা পৃথিবীর কাছে তিনি পরিচিত হলেও, তাঁর আসল পদবি কিন্তু হ্যামসূন‌ নয়, পেডারসেন। পুরুষাণুক্রমে চলে আসা এই পেডারসেন পদবিটা  কী করে যে হ্যামসূন হয়ে গেল সেটাই কৌতুকের, আবার বেদনারও।
নরওয়ের এক পুরনো কৃষক পরিবারে নাট জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়ে কাকার কাছে গিয়েছিলেন মানুষ হতে। কাকা ছিলেন ভীষণ গরিব। নিজেরই সংসার চলত না। কোনও রকমে খেটেখাওয়া এই কাকা নাট-কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এক মুচির কাছে। যাতে মুচির কাজ শিখে বাকি জীবনটা খেয়েপড়ে কোনও রকমে কাটিয়ে দিতে পারে তাঁর ভাইপো।
সেই মুচির কাছে থাকার জায়গা হিসেবে পাওয়া গেল খামারের একটা কোণ। কারও কাছে নাট কখনও ভালবাসা পাননি। তাই যেখানে তিনি রাত কাটাতেন, মাত্র কয়েক দিনেই সেটাকে খুব ভালবেসে ফেললেন তিনি। তখন ওই খামার ছাড়া তাঁর কাছে আর কেউই অতটা আপন নয়। কেউ তাঁকে কখনও কিছু দেয়নি। না বাবা-মা, না কাকা-কাকি, না অন্য কোনও আত্মীয়-স্বজন। অথচ এই খামারটি তাঁকে অনেক কিছু দেয়। দেয় নিশ্চিন্ত ঘুম। দেয় দু'চোখ ভরা স্বপ্ন। উপহার দেয় প্রত্যেক দিন নতুন একটা সকাল।
খামারটার নাম ছিল--- হ্যামসূন। তাই বংশগত পদবিটাকে বাদ দিয়ে তার জায়গায় নিজের নামের পাশে তিনি বসিয়ে দিলেন খামারটার নাম। তখন কেউ তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলেই তিনি বলতেন, আমার নাম--- নাট হ্যামসূন।
এ ভাবেই শুরু। সে সময় সবাই এটাকে কিশোর বালকের খেয়ালখুশি মনে করে তেমন কোনও গুরুত্ব দেননি। আর তিনিও কারও কাছে কোনও বাধা না পেয়ে ওই নাম আর ওই পদবিতেই পরিচিত হয়েছেন সবার কাছে।
তিনি যা লেখাজোখা করতেন, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যেগুলো পাঠাতেন, সেই লেখাগুলোতেই লেখকের নাম হিসেবে ব্যবহার করতেন ওই--- নাট হ্যামসূন। ফলে পরবর্তিকালে ওই খামারের নামটাই তাঁর পদবি হয়ে দাঁড়াল। নাট পেডারসেনকে যে দু'-চার জন চিনতেন, তাঁদের কাছেও ফিকে হয়ে এল সেই নাম। আর আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠল নতুন ভাবে গড়ে ওঠা নতুন নাম--- নাট হ্যামসূন। উনিশশো কুড়ি সালে নরওয়ে থেকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নাট হ্যামসূন।


চোর-ডাকাতের লেখক

যাঁর লেখার প্রধান চরিত্রগুলোই চোর, ডাকাত, বাটপার, ভবঘুরে, মিথ্যেবাদী, ভাগ্যহীন এবং প্রতারক, যাদের নিয়ে উনিশশো থেকে উনিশশো পাঁচ সালের মধ্যে, মানে ছ'বছরের মধ্যেই ‌যিনি লিখে ফেলেছিলেন তিনশোরও বেশি গল্প এবং‌ সেই গল্প লিখে পাঠকমহলে বেশ‌ সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু কখনও চাননি তাঁর এই গল্পগুলো তাঁর নিজের নামে ছাপা হোক। এমনকী, যে সব পত্রপত্রিকায় এ সব গল্প তিনি ছাপতে দিতেন, সেই সব পত্রিকার সম্পাদকদেরও তিনি বলে দিয়েছিলেন, তাঁর আসল পরিচয় যেন কেউ না জানে। তার কারণ, তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল অনেক কলঙ্ক, অনেক অপবাদ এবং অবশ্যই পাহাড় প্রমাণ অপমান।
প্রথম জীবনে তিনি যে ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন, সেখানে একবার এক হাজার ডলারের হিসেব মেলাতে না পারার জন্য তাঁর চাকরি চলে যায়। এক সপ্তাহের মধ্যে সেই টাকা দিতে না পারলে তাঁকে এরেস্ট করা হবে জানতে পারা মাত্রই তিনি টেক্সাস থেকে পালাতে যান হাউস্টনে। সেখানেও তাঁর নামে গ্রেফতারি সমন জারি হওয়ায় তাঁকে চলে যেতে হয় অরলিনসে। তারও পরে ট্রজিনোতে।
এত বার জায়গা বদল করে, গা ঢাকা দিয়ে থেকেও শেষ রক্ষা হল না। অবশেষে তিনি পুলিশের জালে‌ ধরা পড়েন এবং বিচারে‌ তাঁর জেল হয়ে গেল তিন বছর তিন মাস।
তাই তিনি চাননি তাঁর আসল পরিচয় কেউ জানুক। ফলে প্রকাশকেরা তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, আপনার নামে যদি বই না ছাপি, তা হলে কার নামে ছাপব? যে কোনও একটা নাম দিন। অন্তত একটা ছদ্মনাম।
তখন, যে অহিয়ো জেলে‌ তিনি বন্দি ছিলেন, মনে পড়ে গেল সেই জেলখানার কথা। মনে পড়ে গেল সেই জেলখানার প্রহরীদের যিনি সর্দার ছিলেন, তাঁর কথা। তাঁর নাম ছিল--- ওবিন হেনরি। সংক্ষেপে 'ও হেনরি'। সেই সর্দারটি ছিলেন খুব ভাল। এই লেখকের সঙ্গে তার খুব মিষ্টি একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাই সেই নামটিই তাঁর লেখক জীবনের নাম হিসেবে বেছে নিলেন তিনি। এবং 'ও হেনরি' নামেই প্রকাশ পেতে লাগল তাঁর একটার পর একটা বই।
তাই তাঁর প্রকৃত নাম উইলিয়াম সিডনি পোর্টার হলেও, সে নাম একদিন সবাই ভুলে গেল। আর উনি পরিচিত হয়ে উঠলেন ওহিয়ো জেলখানার প্রহরীদের সর্দারের সংক্ষিপ্ত নাম 'ও হেনরি' নামে।


ভিখারির সঙ্গে কবির সমাধি

যাঁর মতো লেখক ইংরেজি সাহিত্যে পাওয়া সত্যিই দুর্লভ এবং পশ্চিমের প্রথম সারির চিত্রকরদের মধ্যে যিনি‌ নিঃসন্দেহে অন্যতম, সেই 'উইলিয়াম ব্লেক' কিন্তু আদতে ছিলেন একজন অর্ধোন্মাদ।
এক গরিব কারিগরের ঘরে তাঁর জন্ম। কিন্তু বাবার সেই কাজের প্রতি তাঁর কখনও আগ্রহ‌ ছিল না। তাই বাবাও তাঁর এই অপ্রকৃতিস্থ ছেলেকে হাতে হাতে কাজ তুলে দেবার জন্য‌ কোনও দিন জোর করতেন না। ফলে ছেলে‌ তাঁর নিজের মতো থাকতেন। যখন যা মন চাইত তাই করতেন। কখনও মাটি ছেনে ছেনে পুতুল বানাতেন। কখনও বা রং তুলি কাগজ নিয়ে ছেলেখেলা করতেন। খেলার ছলেই আঁকতেন ছবি। কখনও আবার খাতা কলম নিয়ে বসে পড়তেন। যা মনে হতো তাই লিখতেন। তার পর সেগুলো ঢুকিয়ে রাখতেন একটা কাঠের বাক্সে। তিনি যেমন‌ কারও‌ কোনও খোঁজখবর রাখতেন না।‌ তাঁরও কোনও খোঁজখবর রাখতেন না কেউ‌।
তিনি নিজের খেয়ালখুশি মতো‌ চলতেন। কোনও কাজকর্ম করতেন না। রোজগারপাতি তো নয়ই। তাই জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন ভীষণ গরিব। এতটাই গরিব যে, কোনও কোনও দিন তাঁর‌ খাওয়াও জুটত না। অথচ খাবার জন্য কারও কাছে হাত পাততেও তাঁর লজ্জা করত। এতটাই সম্মানবোধ ছিল‌ তাঁর।
অথচ তাঁকে দেখলে লোকে ভাবত এ নিশ্চয়ই একটা ভিখারি। তাই তিনি যখন মারা‌ যান, তখন আরও তিন জন বেওয়ারিশ ভিখারির সঙ্গে তাঁকেও সমাধিস্থ করা হয়।
এ রকম ঘটনা তো আকছাড়ই ঘটে।‌ ফলে কেউ মনেও রাখেন না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে‌ হল ব্যতিক্রম। কারণ তাঁর নাম--- উইলিয়াম ব্লেক।
তাঁর মৃত্যুর‌ কয়েক দিন‌ পরেই এক বিদগ্ধ শিল্পরসিক মানুষ তাঁদের বাড়িতে এসেছিলেন কাঠের কাজ করাবেন বলে। কিন্তু ঘরে ঢুকেই তিনি একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। বুড়োর ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছবিগুলো দেখে। ঘুরে ঘুরে‌ সব ক'টা ছবি খুব ভাল‌ করে‌ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। তিনি ছিলেন সত্যিকারের ‌ছবির সমাজদার। তাই নিজে থেকেই যেচে প্রচুর দাম দিয়ে কিনে নিয়ে গেলেন‌ বেশ‌ কয়েকখানা ছবি। যে ছবিগুলো এত দিন অবহেলায় অনাদরে এ দিকে-সে দিকে পড়ে ছিল, তার দাম এত! বাড়ির লোকজন তো একেবারে থ'।
সেই ‌ছবিগুলো নিয়ে এক টানা সাত দিন ধরে তিনি একটি চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করলেন। আমন্ত্রণ করে নিয়ে এলেন বিদগ্ধ সব শিল্পরসিকদের। নিয়ে এলেন শিল্প সমালোচকদের। হাজির করালেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সম্পাদকদের। করলেন সাংবাদিক সম্মেলনও।
প্রথম সারির প্রায় সমস্ত‌ দৈনিক কাগজগুলোতে ফলাও করে ছাপা হল সেই খবর। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন তাবড় তাবড় সব শিল্পীরা। অনেক উন্নাসিক চিত্রসমালোচকরাও প্রাণ খুলে প্রশংসা করলেন সেই ছবিগুলোর।‌
অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর খ্যাতি। সাংবাদিক সম্মেলনে সেই বিদগ্ধ শিল্পরসিক বলেছিলেন, তাঁর বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকা লেখাজোখার কথা। যিনি এত ভাল ছবি আঁকেন, তিনি‌ যখন‌ লিখেছেন, সে কি আর ফেলনা হবে! তাই এক প্রকাশক তড়িঘড়ি গিয়ে হাজির হলেন উইলিয়াম ব্লেকের বাড়ি। প্রকাশ করলেন একের পর এক তাঁর বই। আর সেগুলো বেরোতে না বেরোতেই হয়ে গেল বেস্ট সেলার।
ছবির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর লেখাজোখার‌ খবরও ছড়িয়ে পড়ল দেশবাসীর কাছে। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই সেই সব বই বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়ে পৌঁছে গেল গোটা বিশ্বে। তাঁর ছবি দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন চিত্রপ্রেমিকেরা, ঠিক তেমনি তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন পাঠকেরা।
তাঁরাই দল বেঁধে ঠিক করলেন, তাঁদের প্রিয়‌ এই শিল্পী-লেখককে তাঁরা শ্রদ্ধা জানাবেন। ঘটা করে পালন করবেন তাঁর জন্মদিন। কিন্তু তাঁর জন্মদিনটা কবে?
অনেক খোঁজাটোজ করেও উদ্ধার করা গেল না কবে তাঁর জন্মদিন। কেউ ঠিক ভাবে বলতেও পারল না কোথায় তাঁর সমাধিক্ষেত্র। ফলে আজও অজ্ঞাত রয়ে গেছে সেই সব।
তা বলে এই নয় যে, তিনি খুব কষ্টে ছিলেন। হ্যাঁ, চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে থাকলেও, এই আলাভোলা উইলিয়াম ব্লেক কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় খুব সুখী ছিলেন।‌ কারণ, তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন সোফিয়া বুচার তাঁকে দিয়েছিলেন প্রাণ ভরা ভালবাসা আর‌ প্রচণ্ড প্রশ্রয়। তাই দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন এই কবি নিজের মতো করে একটা জগত তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। হাজার অভাব অনটনের মধ্যে থাকলেও তিনি ছিলেন সদা হাস্যময়। আনন্দময়।


ব্রন্টিত্রয়

বোনের একটা খাতা হঠাৎ এসে পড়ল বড়দির হাতে। খাতা খুলে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বড়দি দেখলেন, তাতে অনেকগুলো কবিতা লেখা। সেগুলো পড়ে তিনি চমকে উঠলেন। তাঁর বোন এত ভাল কবিতা লেখে! তাঁকে ডেকে এনে প্রচুর প্রশংসা করলেন তিনি।
ইতিমধ্যে তাঁদের অগোচরে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের আর এক বোন। তিনি চুপটি করে সব শুনছিলেন। কবিতা লেখা যে খুব একটা খারাপ কাজ নয়, এটা জেনে তিনি তাঁর দিদিকে এত দিন যেটা বলতে পারেননি, সেটাই খুব ধীরে ধীরে নির্ভয়ে বললেন, আমিও কবিতা লিখি।
দিদি ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুইও?
--- পরে দেখবি?
বড়দি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, যা, নিয়ে আয়।
সেই বোন তখন এক দৌড়ে ভেতরঘর‌ থেকে পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখা তাঁর লেখা কবিতার খাতাটা‌ নিয়ে এলেন।
সেগুলো পড়ে দিদি‌ তো‌ একেবারে মুগ্ধ। দু'জনের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ হয়ে গেলেন তিনি। অবশেষে দুই বোনের কাছে লজ্জা মিশ্রিত গলায় সেই দিদিও স্বীকার করলেন, আমিও মাঝেমধ্যে একটা-দুটো কবিতা লিখি জানিস তো...
--- তাই নাকি? তা হলে এত দিন বলোনি কেন?‌ দুই বোনই একসঙ্গে জিজ্ঞেস করে বসল।
দিদি বললেন, যে কারণে তোরা বলিসনি, সেই একই কারণে।
দু'বোনকেই তিনি সে দিন পাঠ করে শোনালেন তাঁর একে পর এক কবিতা। বোনেরা তাঁদের দিদির কবিতা শুনে একদম স্তম্ভিত।
আগেই ক্ষয় রোগে মারা গিয়েছিলেন তাঁদের বড় ভাই আর‌ এক বোন। মা-হারা বাকি তিন বোনই বাবার কঠিন শাসনে বড় হচ্ছিলেন তাঁদের মাসির কাছে। নির্জন প্রকৃতি আর ঢালাও বইপত্র ছাড়া তাঁদের আর কোনও সঙ্গী ছিল না।
মেয়েরা কবিতা লিখছে শুনলে বাবা যদি ক্ষেপে যান! তাই বাবার কাছে এটা গোপন রাখার‌ জন্য তিন বোনই বেছে নিলেন তিন-তিনটি ছদ্মনাম। অবশেষে তিন বোনের কবিতা এক মলাটে বন্দি করে জমানো কিছু টাকা দিয়ে বড়দি প্রকাশ করলেন একটি যৌথ কবিতার বই--- 'পোয়েমস বাই কারার, এলিস অ্যান্ড অ্যাকটন বেল'।
শুধু কবিতাতেই নয়, উপন্যাসেও তাঁরা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। লিখতেন ছোট গল্প, মুক্তগদ্য এবং প্রবন্ধও।
পি-রেফেলাইট যুগের অন্যতম প্রধান মহিলা কবি ও গদ্যশিল্পী শার্লট ব্রন্টি, এমিলি ব্রন্টি এবং অ্যান ব্রন্টি--- এই তিন বোনই পরবর্তিকালে বিশ্বসাহিত্যে 'ব্রন্টিত্রয়' নামে খ্যাত হন।
সাহিত্যের ইতিহাসে এমন আর একটিও পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে-পরিবারের তিন বোনের, তিন জনই কবিতা ও‌ গদ্যে এমন যশস্বিনী।


রাউলে পেপারস্

'রাউলে পেপারস্' প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই হইচই পড়ে গেল সারা দেশে।‌ রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ল কবি রাউলের খ্যাতি।
কিন্তু রাউলে কে? সবাই যখন জানতে চাইছে, ঠিক তখনই মুখ খুলল এক ছোট্ট কিশোর। সে বলল, রাউলে হলেন মধ্যযুগের এক ধর্মযাজক। বহু বছর আগে তিনি এগুলো লিখে একটা সিন্দুকে ভরে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন পুরনো গির্জার একটা গোপন কুঠুরিতে। একদিন বন্ধুদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার সময় ওখানে লুকোতে গিয়ে সেটা আমার নজরে পড়ে। পরে গিয়ে আমি সেগুলো উদ্ধার করে আনি। শুধু এটাই নয়, তাঁর এ রকম আরও আরও আরও অজস্র লেখা আমার কাছে আছে।‌
ব্যস। এর থেকে আর বেশি কিছু জানা যায়নি। যে কিশোর ছেলেটি এ সব কথা বলেছিল, এর মাত্র কয়েক দিন পরেই, নিদারুন দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝে উঠতে না পেরে, একদিন নিরুপায় হয়ে মাত্র আঠেরো বছর বয়সেই সে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ।
আবিষ্কারক মারা যেতে পারে, কিন্তু সে তো বলেছিল, তার কাছে আরও অজস্র লেখা আছে। তা হলে তাঁর আবিষ্কৃত সেই লেখাগুলো কোথায়?
তন্নতন্ন করে খোঁজা শুরু হল কবি রাউলের বাকি লেখাগুলো। সে যেখানে থাকত, সেই ছোট্ট ঝুপড়িতে গিয়ে সব কিছু ওলট-পালট করে তল্লাশি করা হল। কিন্তু কিচ্ছু পাওয়া গেল না। তা হলে কি সেগুলো সে কাউকে দিয়ে গেছে! কোনও প্রকাশককে! বা নিকট কোনও আত্মীয়কে!
সন্ধান করতে গিয়ে এক সময় চমকে উঠলেন সবাই। ফাঁস হয়ে গেল যাবতীয় রহস্য। আসলে রাউলে নামে কেউ কোনও দিন কখনও কোথাও জস্মিনকালেও ছিল না। উন্মেচিত হল প্রকৃত সত্য।
ওই বালক পুরনো গির্জার একটা গোপন কুঠুরিতে কয়েকটি পুঁথির সন্ধান পেয়েছিল ঠিকই, তবে সেগুলো কিন্তু এগুলো নয়। পেয়েছিল অন্য কয়েকটা পুরনো পুঁথি। সেগুলো পাঠ করে সে মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ে। পৌঁছে যায় সেই পুরনো পৃথিবীতে। যে সময়ে লেখা হয়েছিল এই কবিতাগুলো, ঠিক সেই সময়ে।
অবসর সময়ে সে এই লেখাগুলো পড়ত। দেখে দেখে টুকত। নকল করতে করতে শুধু প্রাচীন ভাষা বা ছন্দই‌ নয়, নিখুঁত ভাবে আয়ত্ত করে ফেলেছিল পুঁথির সেই অবিকল হস্তাক্ষরও। এক সময় তার প্রভাবে সেই ভাষা এবং বিষয় নিয়ে নিজেই লিখতে শুরু করে দেয় একটার পর একটা কবিতা। কিন্তু তার মতো একটা হতদরিদ্র বালক কবিতা লিখেছে শুনলে কেউ কি সেটা আগ্রহ নিয়ে পড়বে! ফলে সে নিজেই মনে‌ মনে ধর্মযাজকের একটি কাল্পনিক চরিত্র বানিয়ে প্রচার করতে‌ লাগল মিথ্যে এক রাউলের অস্তিত্ব।
পাঠকদের কাছে পৌঁছল নতুন তথ্য। বিস্মিত হল সাহিত্য জগৎ। পণ্ডিতমহল। তাই পরবর্তিকালে আর রাউলে নয়, 'রাউলে পেপারস্' গ্রন্থটির জন্য কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেল স্বল্পায়ুর‌ সেই বালক--- টমাস চ্যাটারটন।
মাত্র আঠারো বছর‌ বয়সেই মারা যায় সে। তার মধ্যেই এ রকম মর্মস্পর্শী লেখা! মানুষের মনের মনিকোঠায় জায়গা করে নেওয়া! এত খ্যাতি! অথচ জীবিতকালে কিছুই পেল না সে! তাকে বেছে নিতে হল এমন নির্মম পরিণতি!
অনেকেই এটা মেনে নিতে পারেননি। তাই তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন অনেক বিখ্যাত কবি‌ও। উৎসর্গ করেছেন তাঁদের গ্রন্থ। যেমন প্রবাদপ্রতিম কবি কিটস উৎসর্গ করেছেন তাঁর 'এনডিমিয়ন' কাব্যগ্রন্থ। শেলী উৎসর্গ করেছেন তাঁর‌ অত্যন্ত জনপ্রিয় বই--- অ্যাডোনেইস। আরও কত কবি-সাহিত্যিক যে তাঁদের বই তার নামে উৎসর্গ করেছেন, তার কোনও হিসাব নেই।


নির্বোধ পড়ুয়াই অমর স্রষ্টা

প্যারিস থেকে একটু দূরে ভেনদোমের একটি স্কুলে ভীষণ কড়াকড়ি নিয়ম ছিল। স্কুলটির প্রত্যেক ক্লাসের দরজার পাশে একটি করে বেঞ্চ রাখা হত। সেটার নাম দেওয়া হয়েছিল--- গাধার বেঞ্চ। যারা হোমটাস্ক করে আনত না বা ক্লাসে পড়া পারত না, তাদের গিয়ে‌ বসতে হত ওই বেঞ্চে। ওখানে বসাটা ছিল বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করার চেয়েও লজ্জাজনক। একবার ওই বেঞ্চে কেউ বসলে ক্লাসের আর কেউ পারতপক্ষে তার সঙ্গে মিশত না।
সেই বেঞ্চে অলস, নির্বোধ, একগুঁয়ে এবং একদম অপদার্থ একটি ছেলেকে প্রায়ই বসতে দেখা যেত। সে এত‌ বার ওই বেঞ্চে বসেছিল যে, ধরেই নেওয়া হয়েছিল স্কুলের মধ্যে সে-ই সব চেয়ে অযোগ্য বা পাতি বাংলায় যাকে বলা হয়--- একেবারে মাথামোটা। যার ফলে কঠোর শাস্তি হিসেবে দু'বছরের মধ্যে স্কুল‌ কর্তৃপক্ষ‌ তাঁকে মাত্র দু'দিন ছুটি দিয়েছিল।
সে ভবিষ্যতে কী করবে, তা নিয়ে কটুক্তি এবং নঞর্থক মন্তব্যের ছড়াছড়ি ছিল আত্মীয়স্বজন এবং চেনাজানা পরিমণ্ডলের মধ্যে। এমনকী, হাজার চেষ্টা করেও, স্পেশাল ক্লাস নিয়েও যখন তাকে কিছুতেই মানুষ করা যাচ্ছে না, তখন তিতিবিরক্ত হয়ে স্কুলের স্বয়ং হেডমাস্টার তাকে বাড়িতে ফেরত‌ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে তার বাবা-মাকে অত্যন্ত কড়া ভাষায় চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এর আর কিচ্ছু হবে না। এ একটা নষ্ট বালক। আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছি। একে আর স্কুলে পাঠাবেন না।
শুধু মাস্টার বা হেডমাস্টারই নয়, তার‌ বাবা-মাও তার সম্পর্কে খুবই হতাশা বোধ করতেন। এবং এই রকম একটা অপদার্থ ছেলেকে জন্ম দেওয়ার জন্য তার বাবা-মা একে অপরকে দোষারোপ করতেন। আফসোস করতেন। মরমে মরে থাকতেন। এমনকী, ওরা যে তার বাবা-মা, সেই পরিচয়টুকু পর্যন্ত কাউকে দিতে চাইতেন না। সে জন্য সর্বদা ছেলের কাছ থেকে তাঁরা দূরে দূরে থাকতেন। কে কী বলবেন, সেই ভয়ে ক্রিসমাসের ছুটি পড়লেই, সব বাচ্চাদের যখন তাদের অভিভাবকেরা বাড়িতে নিয়ে যেতেন, তখনও, উৎসবের মরসুমেও ছেলেকে স্কুল থেকে তাঁরা বাড়িতে নিয়ে আসতেন না।
অথচ এই ছেলেটির নাকি লেখাজোঁকা করতে চায়। এটা শুনে তার বাবা-মা তো একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। এ ছেলে বলে কী! এটা নিশ্চয়ই তার ফাঁকি দেওয়ার আর একটা নতুন অজুহাত মাত্র।
একে বোঝাতে যাওয়া মানে উলুবনে মুক্ত ছড়ানো। তাই প্রথমে বকাঝকা করে, পরে ছেলেকে কঠিন নির্দেশ দেওয়া হল--- লেখালেখি করতে পারো। তবে দু'বছরের মধ্যে বই লিখে টাকা রোজগার করতে হবে। যদি পারো তো ঠিক আছে। আর‌ তা‌ যদি না পারো‌, তা হলে সব ছেড়েছুড়ে, মাথা থেকে এই লেখালিখির ভূত নামিয়ে, তোমাকে আবার পড়াশোনার জন্য ফিরে যেতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এ কী সম্ভব? তবু কী আর করা! পিতৃদেবের নির্দেশ বলে কথা! তাই মাস চারেক অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি লিখে ফেললেন একটি কাব্যনাটক।
কিন্তু কেমন হয়েছে সেটা! মতামত জানার জন্য একদিন বেশ‌ কিছু কবি, লেখক, সমালোচক, শিক্ষক এবং বন্ধু-বান্ধবদের নেমন্তন্ন করে বাড়িতে ডেকে আনলেন তার বাবা-মা। সেই ঘরোয়া আড্ডায় সবার সামনে সে পাঠ করে শোনাল সেই কাব্যনাটকটি। শুনে সবাই খুব হতাশ বোধ করলেন। কেউ কেউ তার মুখের ওপরেই বলে দিলেন, এটা কিচ্ছু হয়নি। একজন স্কুল মাস্টার তো বলেই ফেললেন, এটা রেখে আর কী করবে!‌ হয় কাগজওয়ালার কাছে কিলো দরে বেঁচে দাও, নয়তো পুড়িয়ে ফেলো।
কিন্তু নিজের লেখা তো নিজের সন্তানের মতোই। তাই হাল ছাড়লেন না তিনি। এ দিকে সময় ক্রমশ ফুরিয়ে আসতে লাগল। যখন বাবার বেঁধে দেওয়া সময় শেষ হতে আর মাত্র মাস দেড়েক‌ বাকি,‌ তখন রাতদিন এক করে তিনি লিখে ফেললেন, না কোনও কাব্যনাটক নয়, একটি উপন্যাস। জীবনের প্রথম উপন্যাস।
এবং অবাক কাণ্ড! নতুন লেখকের ভাগ্যে একটি প্রকাশকও জুটে গেল। এইবার আর কোনও বাধা রইল না। তাকে ফিরে যেতে হল না বাঁধা-ধরা শিক্ষার গণ্ডির ভেতরে। তিনি একের পর এক শেষ করতে লাগলেন তার নতুন নতুন সাহিত্যকীর্তি।
এবং খুব অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সবার অনুমান আর আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত করে, রিয়ালিজমের প্রবর্তক, ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম এই দিকপাল, কেবলমাত্র লেখাজোঁকা করেই কেড়ে নিলেন বিশ্বসাহিত্যের একটি স্থায়ী আসন।
অলস, নির্বোধ এবং একগুঁয়ে এই পড়ুয়ার নাম থেকে 'এইচ ডিই' বাদ দিলেও, শুধু 'বালজাক' বললেই সবাই তাঁকে অনায়াসে চিনে নিতে পারেন। আর শুধুমাত্র বালজাক হিসেবেই তিনি আজও সবার মনের মণিকোঠায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছেন।


লেখার সেই বিশাল পরিকল্পনাটি

এত দিনের সাহিত্য সৃষ্টির ইতিহাসে ফরাসি সাহিত্যের একমাত্র বালজাক ছাড়া আর কোনও লেখক আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে আসেননি, যিনি সমগ্র দেশের বাস্তব জীবনযাত্রার ছবিটাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে লেখনীতে ফুটিয়ে তোলার জন্য এতখানি দুঃসাহসিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন।
পরে যেগুলোর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি, প্রথম দিকে উল্টোপাল্টা ভাবে অশ্লীল সেই সব বাজারি কাটতি লেখা বেনামে লিখে, গদ্যে দক্ষতা আনার পরে; আঠারোশো তেত্রিশ সালে বালজাক  প্রথম সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর উপন্যাসে বাস্তব ছবিটাকে তুলে ধরার। এর মাত্র ন'বছর পরেই, মানে আঠারোশো বিয়াল্লিশ সালে এই সিদ্ধান্তের ওপরেই একটা বিরাট প্রস্তাব পরিকল্পনা প্রকাশ করেন তিনি। 'নামকরণ'-এর জন্য খুব বেশি সময় হাতে পাননি, ফলে দান্তের 'ডিভাইন কমেডি'র অনুকরণ করেই তাঁর নিজস্ব নতুন ভাবনাচিন্তার উপন্যাস-পদ্ধতির নাম রাখেন 'হিউম্যান কমেডি সিরিজ'। তবে এখানে তিনি দান্তের মতো দেবতা বা ঈশ্বর ও তাঁর অলৌকিকত্বকে না এনে, এনেছেন কেবল মানুষ।
ভাল কথা, কিন্তু সেই সিরিজ বিভক্ত হবে ক'টা সংখ্যায়? সাধারণত লেখকেরা তাঁদের সিরিজের যে আয়তন বা সংখ্যা একটু ভেবেচিন্তে ঠিক করে থাকেন, বালজাকের ক্ষেত্রে তা করতে গিয়ে বেড়ে অনেক দাঁড়িয়ে গেল। আনুমানিক প্রায় একশো আটত্রিশটি বই। হয়তো ভেবে রাখা লেখার কোটা তিনি শেষ করে যেতে পারতেন, তবু পারলেন না, একমাত্র উচ্চশ্রেণীর লোকেদের মতো সচ্ছলতায় জীবন কাটাতে গিয়ে।
আচমকা হাতে কিছু টাকা পাবার জন্য উনি কি না করেছেন... বইয়ের দোকান থেকে প্রেস, এমনকী সার্ভিনিয়ার পরিত্যক্ত রুপোর খনির কথা শুনে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে গিয়েছেন সেখানে। লোকজন লাগিয়ে চালিয়েছেন খোঁড়াখুঁড়ি। এ ছাড়াও টুকিটাকি ব্যবসা তো আছেই--- এ সব করতে গিয়ে যেমন তাঁর সময় গেছে, তেমনি সময় গেছে প্রেমে মজেও।

ফলে শেষ পর্যন্ত সময়ের অভাবে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক লেখা আর লিখে যেতে পারেননি। তবুও বলব, এমন পরিবেশ ও সর্বক্ষণ দোটানার মধ্যে থেকেও শ'খানেক 'হিউম্যান কমেডি' লিখে রেখে যেতে পেরেছেন, সঙ্গে কিছু নাটক, গল্প, প্রবন্ধও, সেটাই আমাদের কাছে অনেক। যদিও লেখার গুণে সেগুলির বেশির ভাগই আর কমেডি থাকেনি, পরিণত হয়েছে ট্রাজেডিতে।
এই ঘটনার পরে সিরিজ লেখার এ রকম কোনও বিশাল পরিকল্পনা আর কোনও লেখক কোনও দিন কখনও ভাববেন কি না যথেষ্ট সন্দেহ আছে।


শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত

এ বিভাগের আরো খবর