চার গুণীজনকে একান্নবর্তী-রণজিৎ বিশ্বাস স্মৃতি সম্মাননা প্রদান
দুদকের ২৬ মামলার ভুল আসামি জাহালমকে অব্যাহতি হাইকোর্টের
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় কারাগারে থাকা ভুল আসামি টাঙ্গাইলের জাহালমকে সব মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে তাকে আজই মুক্তি দিতে ডিআইজি প্রিজন্সকে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
রোববার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশিদ আলম খান। আর জাহালমের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত।
পরে অমিত দাস গুপ্ত বলেন, জাহালমকে ২৬ মামলায় অব্যাহতি দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া আরো সাত মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল হয়নি। ফলে তার মুক্তিতে আর বাধা থাকছে না।
নিরীহ জাহালমকে গ্রেফতার ও কারাগারে রাখার ঘটনায় দুদকের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, বিনা দোষে জাহালামকে কারাগারে রাখা আরেকটি জজ মিয়ার নাটকের মতো ঘটনা।
এই ভুল তদন্তের সঙ্গে কারা জড়িত, তাঁদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘দুদকের ফলস ইনভেস্টিগেশনের সুযোগ কোথায়, দুদক যদি প্রোপারলি কাজ করে, তাহলে এ দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে, তা স্থায়ী রূপ নেবে। এই জাহালমকে মিথ্যাভাবে মামলায় অভিযুক্ত করার পেছনে দায়ী কে? আপনার অফিসের কেউ আছে কি না, আমরা দেখতে চাই দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান।’ আদালত আরও বলেন, ঘটনার সঙ্গে কোনো সিন্ডিকেট জড়িত থাকলে খুঁজে বের করতে হবে।
এর আগে, গত ২৮ জানুয়ারি ২৬ মামলায় ভুল আসামি জেলে থাকার অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি ও মামলার বাদীসহ চারজনকে তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন উপস্থানের পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিচারপতি নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।
দুদকের চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী, স্বরাষ্ট্র সচিবের একজন প্রতিনিধি ও আইন সচিবের একজন প্রতিনিধিকে উপস্থিত থেকে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আজ সকালে ওই চারজন হাইকোর্টে হাজির হন।
প্রসঙ্গত, একটি জাতীয় দৈনিকে ‘৩৩ মামলায় ভুল আসামি জেলে’ ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না…’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আবু সালেকের (মূল অপরাধী) বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটছেন জাহালম। তিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক।
ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত। প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপনের পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন হাইকোর্ট।
জাহালমের কারাবাসের তিন বছর পূর্ণ হবে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি। দুদক বলছে, জাহালম নিরপরাধ প্রমাণিত হয়েছেন। তদন্ত করে একই মত দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও।
মূলতঃ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি চিঠির মাধ্যমে ঘটনার শুরু। জাহালমের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঠিকানায় দুদকের একটি চিঠি যায়। সেই চিঠিতে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় জাহালমকে হাজির হতে বলে দুদক। জাহালম তখন নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
দুদকের ওই চিঠিতে বলা হয়, ভুয়া ভাউচার তৈরি করে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আবু সালেক নামের এক লোক, যার সোনালী ব্যাংক ক্যান্টনমেন্ট শাখায় হিসাব রয়েছে।
কিন্তু আবু সালেকের ১০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ভুয়া ঠিকানাগুলোর একটিতেও জাহালমের গ্রামের বাড়ির কথা নেই। রয়েছে পাশের আরেকটি গ্রামের একটি ভুয়া ঠিকানা। আর এটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় জাহালমের জীবনে। নির্ধারিত দিনে দুই ভাই হাজির হন দুদকের ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। তখন জাহালম বুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’
দুদকে হাজিরা দেওয়ার পর জাহালম চলে যান নরসিংদীর জুট মিলে তার কর্মস্থলে। এর দুই বছর পর টাঙ্গাইলের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জাহালমের খোঁজ করতে থাকে পুলিশ। সেখান না পেয়ে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর ঘোড়াশালের মিল থেকে জাহালমকে আটক করা হয়।
আর তখন জাহালম জানতে পারেন, তার নামে দুদক ৩৩টি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে, তিনি অনেক বড় অপরাধী। পুলিশের কাছেও জাহালম একই কথা বলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’ তখন কেউ শোনেনি তার আকুতি। তাকে পাঠানো হয় কারাগারে।
ইতিমধ্যে কারাগারে কেটে যায় আরও দুটি বছর। জাহালমকে যতবার আদালতে হাজির করা হয়, ততবারই তিনি বলেন, ‘আমি জাহালম। আমার বাবার নাম ইউসুফ আলী। মা মনোয়ারা বেগম। বাড়ি ধুবড়িয়া গ্রাম, সাকিন নাগরপুর ইউনিয়ন, জেলা টাঙ্গাইল। আমি আবু সালেক না।’
এদিকে তার ভাই শাহানূর দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরতে থাকেন। হাজতখানার পুলিশ থেকে শুরু করে আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী যাকে পান, তাকেই বলতে থাকেন, ‘আমার ভাই নির্দোষ।’ অথচ ব্যাংক, দুদক, পুলিশ সবার কাছেই জাহালম হলেন ‘আবু সালেক’ নামের ধুরন্ধর ও ব্যাংক জালিয়াতিকারী।
এলএবাংলাটাইমস/এন/এলআরটি
শেয়ার করুন