আপডেট :

        দুবাই থেকে আসা ইমিরেটস কার্গো বিমান হংকংয়ে সাগরে পড়ল, ২ নিহত

        জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণ: স্কুল পাঠ্যক্রমে যুক্ত হবে 'জুলাই সনদ'

        নরওয়াকে পালশালার বাইরে গুলি বর্ষণের ঘটনায় দুইজন আহত, বন্দুকধারীকে খুঁজছে পুলিশ

        লস এঞ্জেলসের ‘No Kings’ প্রতিবাদে সমাবেশ ভাঙার নির্দেশ, অন্তত একজন গ্রেপ্তার

        ২০২৬ সালে বাড়ছে মেডিকেয়ার খরচ: ওপেন এনরলমেন্টে যেভাবে সাশ্রয় করা যায়

        প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যৌনবিষয়ক কনটেন্ট চালুর ঘোষণা দিল OpenAI

        রিভারসাইড কাউন্টির শেরিফ ডেপুটি গাড়ি চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার

        বারব্যাঙ্কে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১, বন্ধ ৫ ফ্রিওয়ের উত্তরমুখী লেন

        কলম্বিয়ার জলসীমায় মার্কিন হামলা: ‘খুনের অভিযোগ’ তুললেন প্রেসিডেন্ট পেত্রো

        গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের’ অভিযোগে ইসরায়েলের বিমান হামলা

        যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ট্রাম্পবিরোধী ‘নো কিংস’ আন্দোলনে লাখো মানুষের অংশগ্রহণ

        ‘রাজা চাই না, গণতন্ত্র চাই’ স্লোগানে তোলপাড় যুক্তরাষ্ট্র

        "সময়ের খেলা: সন্ধ্যা থামে, বছর ছোটে"

        দুর্নীতির ছায়ায় বাংলাদেশ ফুটবল: বিনিয়োগের অভাবে লিগের পতন ও খেলোয়াড়দের হতাশা

        সেন্টমার্টিন দ্বীপ উন্মুক্ত হচ্ছে নভেম্বর থেকে, পর্যটকদের জন্য সুসংবাদ দিলেন উপদেষ্টা

        রিয়াদের প্রত্যাশা: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে 'আক্রমণ-সমান' চুক্তি

        জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারে রোববার থেকে সাইট ব্লক

        নিউইয়র্কে সিলেটিদের প্রতিবাদ: উন্নয়ন বঞ্চনায় ক্ষোভ

        নিউইয়র্কে ডমেস্টিক সহিংসতা রোধে নতুন বিশেষ ইউনিট

        জুলাই সনদ সই শেষ, বাস্তবায়ন পদ্ধতি এখনও অনিশ্চিত

শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে 'বঙ্গবন্ধু' হলেন

শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে 'বঙ্গবন্ধু' হলেন

দুই-পাকিস্তান বিভক্তির আন্দোলনে অংশ নিলেও অপরাষ্ট্র (এক) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পূর্ব-বাংলার বাঙালি বুঝতে পারে তারা প্রতারিত হয়েছে। এখন তারা শোষণ-নির্যাতন ও জাতিগত নিপীড়নের শিকার। তাই ১৯৪৭-৪৮ সালেই ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাঙালি শুরু করে নৃতাত্ত্বিক জাতিভিত্তিক নতুন ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। সে-আন্দোলনে বাঙালির সংস্কৃতি ও রাজনীতি একাত্ম হয়ে যায়। ফলে বাংলা ভাষা ও বাংলার ভূপ্রকৃতিভিত্তিক নবচেতনা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে। তখনই প্রকৃত ধার্মিক, বিবেকবান ও ইতিহাসনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপটি নির্ধারণ করে দেন এই ভাষায় : ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন দাগ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে তা ঢাকবার জো-টি নেই’ (পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন, কার্জন হল, ঢাকা, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮, সভাপতির ভাষণ)।

জন্ম থেকেই পাকিস্তান রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভারত বিরোধিতা আর কমিউনিস্টদের কষে গাল দেওয়া। দেশের ভেতরে যে কোনো অপকর্মের পেছনে কার্যকারণহীনভাবে ভারত বা কমিউনিস্ট সংশ্লিষ্টতা খোঁজা হতো। বাংলাদেশ ৪৫ বছর আগে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জন করলেও এখনো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো ঘটনা ঘটলে পাকিস্তানের অনুসারিরা প্রথমেই ভারতকে অভিযুক্ত করে বিবৃতি দেয় যে এটা ভারতের কাজ। বিবৃতিদাতারা নিজেদের অপকর্ম আড়াল করার জন্যই ভারতকে সামনে নিয়ে আসে। পাকিস্তানিদের ভারত বিরোধিতা বা হিন্দু বিরোধিতার এখনো কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং পরিবর্তন হওয়ার ন্যূনতম কোনো সম্ভাবনা আছে বলেও মনে হয় না।

মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির জিগির তুলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর যে পাকপবিত্র নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হলো, সেই রাষ্ট্রের জনকের মুখে ‘ইসলাম ইসলাম, বললেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন ঘোর নাস্তিক। তিনি কখনো নামাজ পড়তেন না, রোজা রাখতেন না। মহান সৃষ্টিকর্তা এবং পবিত্র কুরআন সম্পর্কে তাঁর বিশেষ কোনো জ্ঞান বা আগ্রহ কোনোটাই ছিল না। দাদার আমল থেকে কনভার্টেট মুসলিম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর জীবনাচরণে, চিন্তা চেতনায় কোনো দিক থেকেই সাচ্চা ধার্মিক তো দূরের কথা বরং ইসলাম ধর্মের মূল বিধি বিধানকেও উপেক্ষা করে চলতেন। ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক লাপিয়েব ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ নামক বিশ্বখ্যাত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি মদপান করতেন, শুয়রের মাংস খেতেন। তিনি শুক্রবারেও মসজিদে যেতেন না। তাঁর মানস চোখে ঈশ্বর বা কুরআনের কোনো স্থান ছিল না। জিন্নাহর প্রতিপক্ষ মহাত্মা গান্ধী পবিত্র কুরআন থেকে যেটুকু উদ্ধৃতি দিতে পারতেন তিনি সেটুকুও পারতেন না। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সেই পাকিস্তান আজ অবধি শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো বিষয় উন্নতি লাভ করতে পারেনি। প্রতিহিংসাপরায়ণ পাকিস্তানিরা এখনো বাংলাদেশকে তাদের কলোনী ভাবে। তাদের সকল ধ্যান জ্ঞান এখনো বাংলাদেশের সর্বনাশ সাধন নিয়ে।

বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ভারত ভেঙ্গে দু’টি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের প্রাক্কালে যে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন আজ তা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। তিনি বলেছিলেন- ‘মুসলিম লীগ বর্ণিত পাকিস্তান পরিকল্পনাটির সম্ভবপর সমস্ত দিক থেকে আমি বিচার করে দেখেছি।... ভারতের মুসলমানদের ভাগে এর কী ফলাফল ঘটতে পারে একজন মুসলমান হিসেবে আমি তা যাচাই করে দেখেছি। পরিকল্পনাটির সমস্ত দিক বিচার করে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে এটি শুধু সারা ভারতের পক্ষেই নয়, বিশেষ করে মুসলমানদের পক্ষেও হানিকর। এবং বস্তুতপক্ষে এতে সমস্যা যত না মিটবে তার চেয়ে ঢের বেড়ে যাবে। একথা স্বীকার না করে পারছিনা যে, পাকিস্তান শব্দটাই আমার আছে অরুচিকর। অযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক শাসন ডেকে আনবে, যা নাকি অনেক মুসলমান রাষ্ট্রে ঘটেছে।... এ অবস্থায় পাকিস্তানের স্থায়িত্ব খুবই একটা চাপের মুখে পড়বে এবং কোনো মুসলিম রাষ্ট্র থেকেই কার্যকরী সাহায্য পাওয়া যাবে না। অন্য রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে শর্তসাপেক্ষে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে, তবে পাকিস্তানের মূলমন্ত্র ও রাষ্ট্রকে এর জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হবে।’

পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাংশ অর্থাৎ পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ তিনি যেন দিব্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন, ‘আরেকটা বিষয় মি. জিন্নাহর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ। তিনি জানেন না, বাংলাদেশ বাইরের কোনো নেতৃত্ব মেনে নেয় না। আজ কিংবা কাল তারা সে নেতৃত্ব অস্বীকার করবে।... বাংলাদেশের পরিবেশ এমনই যে, বাঙালিরা বাইরের নেতৃত্ব অপছন্দ করে এবং তখনই বিদ্রোহ করে, যখন তাদের অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা বিশেষভাবে ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে। যতদিন জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী জীবিত আছেন ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতি তাদের বিশ্বাস থাকবে। কিন্তু ওরা যখন থাকবেন না তখন যে কোনো ছোটো ছোটো ঘটনায় ওদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠবে। আমি মনে করি পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা মোটেই সম্ভব নয়।... পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা, নিয়ম-কানুন, আচার-ব্যবহার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একেবারে আলাদা। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে এখন ওদের মনে যে উষ্ণতা আছে, তা পরে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে এবং বিরোধ ও প্রতিবাদ দানা বেঁধে উঠবে। তখন বাইরের শক্তিগুলো এতে ইন্ধন জোগাবে ও একসঙ্গে এই খণ্ড আলাদা হয়ে যাবে।’

বস্তুত বিজ্ঞ রাজনীতিক মাওলানা আবুল কালাম আজাদের এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলতে শুরু করল পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটি জন্ম নেওয়ার পরপরই।

১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার একটা অভাবনীয় তথ্য প্রকাশ করে যে, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং গুটিকয় সাধারণ সৈনিক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাদের সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। এই মিথ্যে মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ মোট ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। ১৯৬৮ সনের ২০ জুন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি শুরু হয়। প্রেসিডেন্টের আদেশ বলে সাবেক প্রধান বিচারপতি এমএ রহমান, বিচারপতি মুজিবুর রহমান এবং বিচারপতি মকসুমুল হাকিমকে নিয়ে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও মামলার অন্যান্য আসামিদের বিচারের জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান কৌসুলি ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খান। ১৯৬৮ সালের ২০ জুন হতে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ১১জন আসামি রাজসাক্ষীর ভূমিকা নেয়। পরে ইংল্যান্ডের রানির কৌসুলি স্যার টমাস উইলিয়াম শেখ মুজিবুর রহমানের কৌসুলি নিযুক্ত হন। মজার ব্যাপার যে শেখ মুজিবুর রহমান বাদে আর যে ৩৪ জনকে তাঁর সাথে আসামি করা হয় তাদের অনেককেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন না। ৩৫ জন আসামির সবাইকে পাক সরকার গ্রেফতার করে। কুর্মিটোলা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে তাঁদের বিচার কাজ শুরু হয়। সেনানিবাসের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানেকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। ১৯৬৯ সসের ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমান বাইরে পায়চারী করছিলেন, সে-সময় একজন পাঠান ক্যাপ্টেন তাঁকে তাড়াতাড়ি কক্ষে চলে যেতে বলেন। সে যাত্রা তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

প্রিয় নেতাদের মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে, এটা বুঝতে পেরে বাঙালি জাতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং স্বৈরাচারী আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেনানিবাসের অভ্যন্তরে যখন বিচার কাজ চলছিল বাইরে তখন ছিল জনতার প্রকম্পিত মিছিল। ছাত্র-জনতার মিছিলে রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে। সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। সরকার যতই বোঝানোর চেষ্টা করে যে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাকিস্তানকে দ্বি-খণ্ডিত করতে চায়, জনতা ততোই ফুঁসে ওঠে এবং সরকারের মিথ্যাচারের মুখোশ উন্মোচিত হতে থাকে। পাকিস্তান সরকারের এই প্রহসনটিই ঐতিহাসিক ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবে খ্যাত।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের গোপন বিচার প্রক্রিয়া, বাঙালি জাতিকে নিরন্তর নির্যাতন-শোষণ, বেতার ও টিভিতে কড়াকড়িভাবে রবীন্দ্রবর্জন, বাংলা ভাষা-সংস্কারে তথাকথিত সরকারি উদ্যোগ ইত্যাদি অপচেষ্টা পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজকে অভিন্ন বিন্দুতে নিয়ে আসে। আন্দোলনের মত ও পথ ভুলে গোটা ছাত্র সমাজ শেখ মুজিব কর্তৃক ইতোপূর্বে উত্থাপিত ছয় দফাতে যোজন-বিয়োজন ঘটিয়ে ১১ দফা দাবি পেশ করে। ওই ১১ দফাভিত্তিক ছাত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শাহাদাতবরণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আসাদুজ্জামান। আসাদের মৃত্যু সংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, শহর থেকে গ্রামান্তরে। ছাত্র-জনতা জাগতে শুরু করে অবিনাশী চেতনায়। ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’

১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন আইয়ুব খান এবং আলাপ আলোচনার প্রস্তাব দেন। ছাত্র-জনতা সাফ সাফ জানিয়ে দেয়, শেখ মুজিব ও অন্য নেতৃবৃন্দকে কারাগারে রেখে তারা কোনো আলোচনায় বসবেন না। অনেক দেন-দরবার করেও রাজনৈতিক অচলাবস্থার সামান্য অগ্রগতি ছাড়াই আইয়ুব খান ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ত্যাগ করেন। এর দুদিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে আটক অবস্থায় হত্যা করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সান্ধ্য আইন ভেঙে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। এবার আইয়ুব খান নতুন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তার অপশাসনের বিরুদ্ধে গঠিত সর্বদলীয় ‘ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি’ (সংক্ষেপে ডাক)-এর নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করার প্রস্তাব দেন। সমস্যা দেখা দেয় শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহণ নিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমান ততদিনে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে বন্দি, নির্যাতনের শিকার ও বিচারের সম্মুখীন। মুজিববিহীন যে কোনো রাজনৈতিক বৈঠক যে অর্থহীন, সে কথা সরকার ও সরকারবিরোধী উভয় শিবিরেই উপলব্ধ। সেই বিবেচনায় তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে প্রস্তাবিত বৈঠকে অংশগ্রহণের সুযোগ দানের পাঁয়তারা চলে। তাতে বাদ সাধেন মুজিব স্বয়ং ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ। অস্বীকৃত হয় জামিনে মুক্তি। সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় আইয়ুব খান ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অভিযুক্ত সকল আসামিকে মুক্তি প্রদানের ঘোষণা দেন। ২২ ফেব্রুয়ারি শনিবার শেখ মুজিবসহ অন্য রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পরপরই তিনি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ উত্থাপিত ১১ দফা দাবির প্রতি জোরালো সমর্থন দেন।

২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করা হয় এবং ওই সভায় তৎকালীন ডাকসু’র সভাপতি বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ঢাকার ইতহাসে এত বড় বিশাল জনসভা আর হয়নি। অনেকের মতে উক্ত মহাসমাবেশে দশ লাখ লোক সমাগম হয়েছিল। সভায় সভাপতিত্ব করেন তোফায়েল আহমেদ। সে সভায় বক্তব্য রাখেন খালেদ মোহাম্মদ আলী, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুবুল হক দোলন ও মাহবুব উল্লাহ। এরপর থেকে বাংলার জনগণের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান নাম ছাপিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা থেকে নিষ্কৃতি পাবার পর শেখ মুজিবুর রহমান মূলত বাংলার কিংবদন্তির নেতায় পরিণত হন। এই উপাধিটি এত জনপ্রিয়তা ও যথার্থতা লাভ করে যে বঙ্গবন্ধুই হয়ে যান বাংলাদেশ।


 এলএবাংলাটাইমস/এন/এলআরটি

শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত