জুলাই সনদ সই শেষ, বাস্তবায়ন পদ্ধতি এখনও অনিশ্চিত
গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল এনসিপিসহ কয়েকটি দলের বর্জন, অনুষ্ঠানস্থলে জুলাইযোদ্ধাদের বিক্ষোভ এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে সই হলো বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদ। গতকাল শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সনদে সই করেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ২৪টি দল ও জোটের নেতারা। তবে কীভাবে সনদ বাস্তবায়ন করা হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি।
সনদের আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা না পাওয়া এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক না করায় সনদে সই করেনি এনসিপি। একই দাবি করে আসা জামায়াত আগের দিন পর্যন্ত সনদ সই করার বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট না করলেও গতকাল সনদে সই করেছে। এরপর দলটি বলেছে, বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে তা হবে জাতির সঙ্গে গাদ্দারি।
এনসিপি ছাড়াও ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়া পাঁচটি দল জুলাই সনদে সই করেনি। অন্যদিকে সনদ স্বাক্ষরকে বড় অগ্রগতি আখ্যা দিয়ে বিএনপি বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় বসতে রাজি তারা।
ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও সরকারপ্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বলেন, ‘এর মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করলাম। সেটা যেন সঠিকভাবে আমরা করে যেতে পারি। আমরা একমত হয়েছি সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’
সাত দফা অঙ্গীকার দলগুলোর
আইনগত দায়মুক্তির দাবিতে সনদ সইয়ের ঘণ্টা চারেক আগে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে জুলাইযোদ্ধারা সংসদের গেট ভেঙে দক্ষিণ প্লাজায় পৌঁছে যান। তাদের দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সনদের অঙ্গীকারনামার পঞ্চম দফায় সংশোধন করে সংশোধন করে জুলাইযোদ্ধাদের দায়মুক্তি, স্বীকৃতি এবং পুনর্বাসনের অঙ্গীকার যুক্ত করা হয়।
জুলাই সনদ নিয়ে প্রশ্ন না তোলা, বাস্তবায়নের প্রতি ধাপে সাংবিধানিক ও আইন সুরক্ষা, সনদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা এবং অবিলম্বে বাস্তবায়নসহ সাত দফা অঙ্গীকারনামায় সই করেন প্রতিটি দল ও জোটের দুজন করে প্রতিনিধি। সই করেন ড. ইউনূস, ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ এবং কমিশনের সদস্যরা। সঞ্চালনা করেন ঐকমত্য কমিশনের সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
বিএনপির পক্ষে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ; জামায়াতের পক্ষে নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার; গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান; নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ প্রমুখ সই করেন।
জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে বিকেল সাড়ে ৪টায় শুরু সনদ স্বাক্ষরের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। খোলা আকাশের নিচে দক্ষিণ প্লাজার সিঁড়িতে নির্মিত মঞ্চে বৃষ্টিতে ভিজে সই করেন নেতারা। দর্শক সারিতে ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা। উপস্থিত ছিলেন শহীদ মীর মুগ্ধের বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান এবং শহীদ তাহির জামান প্রিয়র মা সামসি আরা জামান। দুই ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দেন। কিছু সময় থেকেই তারা চলে যান।
কীভাবে বাস্তবায়ন সনদ
জুলাই সনদে সংস্কারের ৮৪টি সিদ্ধান্ত রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ ৯টি মৌলিক সংস্কারে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে। দলটি বলেছে, নির্বাচনে জিতলে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করবে না।
দলটির অবস্থান হলো, সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোটের পর আগামী সংসদে বাস্তবায়ন হবে জুলাই সনদ। আর জামায়াতে ইসলামীর দাবি, সংবিধান আদেশে সনদ কার্যকর করে নির্বাচনের আগে গণভোট হতে হবে। গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট রাখা যাবে না। গণভোটে অনুমোদিত সনদের পুরোটা বাস্তবায়ন করতে হবে আগামী সংসদে।
একই দাবি জানানো এনসিপির অবস্থান, সংবিধান সংস্কারে আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনের কনস্টিটুয়েন্ট (গাঠনিক) ক্ষমতা থাকতে হবে। দলটির মতে, এসব ধাপ নিশ্চিত না করে স্বাক্ষরের নামে প্রতারণা রয়েছে। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর গতকাল রাতে মনির হায়দারের সঙ্গে বৈঠক করেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
এদিকে গতকালও সনদ সংশোধন করা হয়। কোন সংস্কারে কোন দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, এর সঙ্গে আরেকটি অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘যে দলের যে বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, তা নির্বাচনী ইশতেহারে রাখবে। সেই দল জয়ী হলে নোট অব ডিসেন্ট অনুযায়ী সংস্কার করার এখতিয়ার রাখবে।’ তবে পরে সনদের এই সংস্করণ সরিয়ে ফেলে কমিশন। বিএনপি নোট অব ডিসেন্টে এই প্যারা যুক্ত করার দাবি জানাচ্ছে আগে থেকে।
রাজনৈতিক ও কমিশন সূত্র জানিয়েছে, সংবিধান আদেশ জারির মাধ্যমে সনদ কার্যকরে সরকারকে সুপারিশ করা হবে। জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য মনির হায়দার সমকালকে বলেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন পদ্ধতি কী হবে, তা সুপারিশ করা হবে সরকারকে। একাধিক বিকল্প দেওয়া হবে। সেখানে থেকে সরকার ঠিক করবে কীভাবে সনদ বাস্তবায়ন করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর গণভোটে ঐকমত্য রয়েছে। ভোট কখন হবে– এ সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। যারা সনদে সই করেনি, তারা এই সময়ের মধ্যে সই করতে পারবে।
সই করেনি আরও পাঁচ দল
বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিবর্তন করায় সনদে সই করেনি সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী) এবং বাংলাদেশ জাসদ। সংবিধানে সপ্তম তপশিল তথা মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়ার ‘প্রস্তাব’ থাকায় অনুষ্ঠানে গেলেও স্বাক্ষর করেনি গণফোরাম। তবে ঐকমত্য কমিশন আগের দিনই জানিয়েছিল, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ দেওয়া হবে না। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তপশিল বাদ যাবে। ভুলবশত সপ্তম তপশিল বাদ দেওয়ার কথা মুদ্রিত হয়েছে সনদে।
নির্বাচনের সুর সনদে
সনদকে অগ্রযাত্রায় পথ আখ্যা দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘যে তরুণরা এই দিনটিকে সম্ভব করেছে, পরিবর্তনের জন্য যারা জীবন দিয়েছে, তারাই বাংলাদেশকে নতুন করে গড়বে।’
ঐকমত্য কমিশনের যাত্রার শুরুটা ‘ভয়ে ভয়ে’ হয়েছিল মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পুরো জাতি এবং সব নেতা একসঙ্গে হয়ে জুলাই সনদ সই করছেন। এ রকম ঘটনা ঘটবে, এ রকম কেউ চিন্তাও করতে পারিনি। যখন ঐকমত্য কমিশন গঠন করলাম, মনে মনে আশা ছিল হয়তো দু-একটা বিষয়ে তাদের এক করতে পারব। কমিশনের সদস্যরা ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবেন।
জুলাই সনদ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, ‘যে সুর আজকে আমরা এখানে বাজালাম, সেই সুর নিয়ে আমরা নির্বাচনের দিকে যাব। ঐক্যের সুর, ঐক্যের মধ্য দিয়ে আমরা নির্বাচনের দিকে যাব। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে এবং এই ঐক্য যেন বজায় থাকে। বিভিন্ন দলের নেতারা বসে একটা সনদ করেন, কীভাবে নির্বাচন করবেন। সবাই মিলে এমনভাবে নির্বাচন করব, দুনিয়ার কেউ এসে বলতে পারবে না এখানে ক্ষতি হয়েছে।’
ঐকমত্যের মাধ্যমে যে ‘কঠিন কঠিন কাজ’ সমাধান করা যায়– মন্তব্য করে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা এক বর্বর জগতে ছিলাম। যেখানে আইনকানুন ছিল না। মানুষের ইচ্ছায় যা ইচ্ছা তা করতে পারত। এখন আমরা সভ্যতায় এলাম।
জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়গুলো পাঠ্যপুস্তকে থাকবে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের মালিকানা ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়েও কথা বলেন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনীতিতে মতপার্থক্য না থাকলে তা গণতান্ত্রিক হয় না। বহু স্রোত যেন মোহনায় এসে মেলে, যেন বলতে পারি যে, আমাদের অনেক স্রোত, কিন্তু মোহনা একটি। আলী রীয়াজ বলেন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শের যে রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা, তা ৫৩ বছর ধরে বারবার হোঁচট খেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় এক বছর ধরে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এই জাতীয় সনদে উপনীত হয়েছে।
নতুন অধ্যায়ের সূচনা
জুলাই সনদ স্বাক্ষরকে বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, সংস্কার কমিশনগুলো আট মাস পরিশ্রম করে এই সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শহীদদের রক্তদান, জাতির আকাঙ্খা, জনপ্রত্যাশা– সবকিছু পূরণে যাত্রা শুরু হলো। সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান নির্মিত হবে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মিত হবে, রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গ আরেকটি অঙ্গের ওপর কর্তৃত্ব প্রদর্শন করতে পারবে না।
তিনি বলেন, ‘সব রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। যারা করেনি, আশা করি তারাও ভবিষ্যতে স্বাক্ষর করবে।
এক প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচন কীভাবে হবে, সেটি সংবিধানে লেখা আছে। এখানে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। এর পরও প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে বসতে চাইলে অবশ্যই বসা হবে।
‘বাস্তবায়নে বিলম্ব গাদ্দারি’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে তা জাতির সঙ্গে গাদ্দারি বলে গণ্য হবে। জামায়াতের হুঁশিয়ারি ছিল, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া সই করবে না। কেন এই অবস্থান পরিবর্তন– এমন প্রশ্নে ডা. তাহের বলেন, সংলাপে যেসব সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে সব দলের মতে জামায়াতও একমত। তাই আমরা স্বাক্ষর করেছি।
জামায়াতের নায়েবে আমির বলেছেন, ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটা যেন এই সরকার বাস্তবায়ন করে। প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আস্থা রেখেই জুলাই সনদে সই করেছি বলে মন্তব্য করে ডা. তাহের বলেন, আমরা আশা করি উনি কথা ঠিক রাখবেন।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন