অনলাইন বনাম শিক্ষার্থী এবং শিক্ষা
সামনে পরীক্ষা,টানটান পড়া চালানোর কথা এ সময়, কিন্তু বাধ সাধলো করোনা ৷ হবেটা কী? এ কোন বিষন্নতায় পা দিলো পড়ুয়ারা? কি হবে জীবনের? জীবনের এক এক টা সেকেন্ড যেখানে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ,সেখানে যদি মিস হয়ে যায় পুরো একটা বছর! কি হবে তাহলে? "যার যায় সে বোঝে" জীবন কি? যারা পড়াশুনা করেনি একটা দিনও,ভালোলাগে না পড়াশুনা,তারা কি করে বুঝবে এর গুরুত্ব?
করোনার ভ্যাকসিন কবে আসবে কে জানে? কিন্ত স্মার্ট ফোন,ট্যাব,ল্যাপ এসব এসে গেছে পড়ুয়াদের হাতে ৷ ইচ্ছে করে না হোক চরম অনিচ্ছায় মা,বাবাই এসব দিতে বাধ্য হয়ছে সন্তানকে ৷ "কি আর করবো ! ক্লাস হয়তো অনলাইনে,না দিয়ে পারি? ও ক্লাস করবে কিভাবে? যদি পরীক্ষা হয়,জেনে শুনে তো আর সন্তানের জীবনে ভুল কিছু ডেকে আনতে পারি না ৷"অর্থাৎ তারা মনে করেন,পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা,শিক্ষার জন্য নয় ৷
ও হে আমার বুদ্ধিমান অভিভাবক, খাল কেটে কুমির যেনো না আনেন ,একটু নজর দিবেন ৷ ছোটকালে যে কম্পোজিশন লিখতেন "বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ" ঐ টার কথা ভুলে যাবেন না যেনো ৷ সত্যিই কি ল্যাপ,ট্যাবে আর আপনার কষ্টের উপার্জন দিয়ে কেনা মোবাইল ফোনে পড়াশুনা চলছে? নাকি অন্য কিছু হচ্ছে? ক্রিকেট লাইভ হচ্ছে নাতো,সিরিয়াল চলছে নাতো ? ভিডিও গেইম হচ্ছে না তো? বলিউড উঁকি মারছে নাতো? পর্নোগ্রাফি চলছে নাতো আপনার সন্তানের ডিভাইসে?
সেদিন পত্রিকার পাতা খুলে দেখলাম,এক অভিভাবক নাকি নানা জল্পনা কল্পনার পরে অনেক কষ্ট করে টাকা এনে ছেলেকে কিনে দিয়েছে স্মার্ট ফোন ৷ স্মার্ট ফোন কেনার সামান্য অর্থটুকু নাই ,অথচ পড়ালেখা আগে ,জীবন থাকুক আর না থাকুক ৷ কী চিন্তাবোধ আজকাল জেগেছে রে বাবা , তবে সন্তানের জন্য কে না এসব করে !
আমার মনে হয়, করোনার মধ্যে কোনো দেশেরই পড়াশুনা চালিয়ে নেয়ার কথা বলাটাই উচিত হয়নি ৷ বিশেষ করে ,আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ৷ দেশে এ্যাসাইমেন্ট শুরু হয়েছে, " এসাইনমেন্ট জমা দিতে এসে প্রাণ গেলো দুই স্কুল শিক্ষার্থীর" ,"মেয়ের এসাইনমেন্ট দিতে এসে সড়কে ঝড়লো পিতার প্রাণ"এরকম শিরোনাম কয়েকদিন আগে দেখেছি পত্রিকায় ৷ প্রাণ আগে নাকি শিক্ষা আগে? কি বলবেন বলুনতো সচেতন অভিভাবক,শিক্ষার্থীগণ ৷ আজকাল অনেক টপার শিক্ষার্থীরাই বলে যে স্কুল খুলে দেয়া ভালো,কিন্তু তারা কি জানে যে-তার না হোক ,তারই বন্ধুর করোনা পজিটিভ হলে নিভে যাবে ঐ পরিবারের দ্বীপ,ধ্বংস হবে ঐ পরিবারটা ৷ যেখানে সন্তানই হলো বাবা-মা এর বেচেঁ থাকার একমাত্র সোপান,সেখানে যদি সন্তানই না থাকে তাহলে "চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়" এই কথা ঘুরিয়ে বলতে হবে যে, চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান ৷ এসব গভীর চিন্তা ভাবনা করে না টপার শিক্ষার্থীরা,করলে হয়তো বলতো আমার পড়াশুনা যায় যাক,বন্ধুর প্রাণ যেনো না যায় ৷ কারণ আমি জানি, এদেশের শিক্ষার্থীরা খুবই পরোপকারী এবং মনুষ্যত্ববাদী ৷তারা উপলব্ধি করলে বিষয়টি বাস্তবায়ন না করে ছাড়ে না ৷
যতই বলি দেশ উন্নত হয়েছে আইটির বিষয়ে দেশ কতটা উন্নত হলো তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে করোনা ৷ শহরাঞ্চলে তো মোটামুটি উচ্চ আয়ের লোকেরাই বাস করে, তারা না হয় ঠিক ভাবেই চালালো লেখাপড়া ৷ কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকেরই পেশা যে কৃষি, কৃষি কাজ করেই তাদের বাস,কিংবা "দিন আন্তে পান্তা ফুঁড়োয়" এরকম অবস্থাও রয়েছে আজকাল,একটু গ্রামের দিকে চোখ মেললেই দেখা যায় সবটা ৷ তারা ডিভাইস কি করে কিনবে বলুনতো? তা যাক,যে ভাবেই হোক ডিভাইস কিনে দিয়েছে ৷ ছাত্রও ভালো ,বাজে বিষয়ে মন নাই,পড়াশুনাতে ঝোকঁ ৷ পড়াশুনা চালাচ্ছে অনলাইনে ৷ আসলে আমি ও ভেবেছিলাম অনলাইন ক্লাস শুরু করার আগে যে, অনলাইনে ক্লাস হলে ভালোই হবে ৷ পড়াশুনাটা তো চালাতে পারবো,শহরের ছাত্ররা বাড়িতে চলে এসেছে,গ্রাম,উপজেলার বাড়িতে ৷ অনলাইনে তো যেখানে ইচ্ছা সেখানে বসেই পড়া যাবে ৷
গ্রামে এসে দেখা গেলো, সিমই অচল হয়ে গেছে ৷ ইন্টারনেট তো দুরের কথা নেটওয়ার্কই নাই ৷ অন্যদের কথা কি বলবো,নিজের অভিজ্ঞতা বলি, "গ্রামীণফোন" ছাড়া অন্য কোনো সিমের নেট পাওয়া যায় না বাড়িতে,তবুও লেপ্টে আছি,ক্লাস তো করতে হবেই ৷ প্রথমে ১৭ টাকায় ১ জিবি কিনতাম,এরপর এটা বন্ধ হয়ে গেলো সিমে, ৩৮ টাকায় কেনা শুরু করলাম, দুমাস পরে সেটাও বন্ধ হয়ে গেলো ৷ এরপর ৬৮ না কত জানি,ঠিক মনে নাই,সেটাও কিনতাম,এরকম আর পারা যায় না,নিম্নবিত্ত পরিবারে ইন্টারনেটের পিছনে এতো টাকা ব্যয় করা যায় না ৷ বিজ্ঞান বিভাগে তো খরচ বেশি সবথেকে ৷ প্রাইভেট পড়তে হয় সব বিষয় ৷ এতো টাকা দিয়ে কি পড়াশুনা করা যায় ? জামা কাপড় ও তো কিনতে হবে ,দুমুঠো খাবার তো খেতে হবে ৷ আমার পিছনেই যদি মাসে তেরো-চৌদ্দ হাজার টাকা খরচ হয়,তাহলে পরিবারের বাকিরা চলবে কি করে বলুনতো ৷ তারপর একটা নতুন সিম কিনলাম, যেনো সাধ্যের ভেতর অফার পাওয়া যায়,কিন্তু না ৷ সেটায় দুশো টাকায় কিনতে হয় দশ জিবি ৷ এর থেকে সাধ্য মতো আর কোনো অফার পাইনি নতুন সিমটায় ৷ প্রথম দিকে এ দশ জিবিতে যেতো পনেরো দিনের মতো আর আজকাল যায় আট দিন ৷ আজকাল যে অনলাইনে একটু এক্সট্রা পড়াশুনাও করি,টেন মিনিট স্কুল ভিজিট করি,তাই হয়তো ৷
সেদিন সংবাদে দেখলাম,২০২১ সাল থেকে মাধ্যমিকে আর বিভাগবিভাজন থাকবে না ৷ শুনে ভালই লাগলো ৷ এটা সত্যিই সরকারের একটা ভালো উদ্যেগ ৷ এরফলে শিক্ষার্থীরা সব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারবে ৷ বিদেশী শিক্ষার সাথে তাল মিলাতে পারবে না ৷ ভালোই হবে তাইলে ৷ এটা হলে আর বিভেদও সৃষ্টি হবে না ৷
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের শীর্ষ সংবাদ মাধ্যম একাত্তরের সংবাদ উপস্থাপিকা ফারজানা মুন্নি ফেসবুক লাইভে এসে তাদের অনলাইন বিরম্বনার কথা তুলে ধরলেন ৷ তিনি বলেছিলেন,অনলাইন যাদের নয় তারাও বিপদে পরে অনলাইনের পিছনে লেগে আছে "আলাদীনের চেরাগ"এর মতো ৷ কোনো কোনো অতিথি নাকি আবার লাইভে থাকা অবস্থাতেই বাসার লোকদের সাথে কথা বলেন ৷ বিদ্যুৎ চলে গেলে নাকি বলেন "এই কে আছো,আমার লাইট টা অন করে দিয়ে যাও তো ৷" অর্থাৎ তারা ভুলে যান,যে তারা অন এয়ারে আছেন,পুরো বাংলাদেশে দেখছে তাদের ৷ অনলাইনে যেটা হচ্ছে আরকি আজকাল ,তিনি বাস্তবতাটাকে তুলে ধরলেন,তিনি বললেন,অনেকেই নাকি অন এয়ারে থাকা অবস্থাতেই হাওয়া হয়ে যান, কি আর করার,নেট নাই, নেট চলে গেছে ৷ কার সাধ্য অবিরাম সংযোগ রাখার ? মিউট ,আনমিউটের বিষয়টা নাকি এখনো অনেক উচ্চপদস্থদের অজানা ৷ তো মাসখানেক আগে আমি একাত্তরের সংবাদযোগ দেখতে ছিলাম,হঠাৎ করে অতিথির ডিভাইসটি মিউট হয়ে গেলো,উপস্থাপক সাহেব বারবার বললেন আনমিউট করতে কিন্তু তিনি মোটেই পারছিলেন না,অত:পর বিজ্ঞাপনে যেতে হলো সংবাদ মাধ্যমটির ৷ অন্তত বিশ মিনিটের মতো বিজ্ঞাপন দিয়ে রেখেছিল চ্যানেলটি ৷ যা হয় আরকি, ব্যপারটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম,বাধ্য হয়ে অন্য চ্যানেলের টক শো দেখতে হলো আমাকে ৷
দেশের এতো বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলোকেই যদি এতো বিরম্বনায় পরতে হয়,তাহলে শিক্ষার্থীদের কথা কি বলবো বলুনতো ৷ গ্রামে নেট যায়, লেখা থাকে ফোর জি সার্ভিস ,আমার মনে হয় থ্রী জি দেয় কি না সন্দেহ ৷ ক্লাস শুরু,টানটান উত্তেজনা,স্যার লিংক দিলেন জুম অ্যাপ ক্লাসে, ক্লাসে ঢুকলো স্টুডেন্ট ৷ হঠাৎ স্যার হাওয়া ৷ কখনো কখনো স্টুডেন্টদের পুরো ক্লাসই কাটাতে হলো স্যারবিহীন ৷ আবার টিচাররাও পড়েছেন বিপাকে ৷ এই ধরুন, যখন তাদের হাত দেখা যায় তখন তাদের মাথা দেখা যায় না ৷ মাথা দেখা গেলো তো বোর্ড দেখা গেলো না ৷ কখনো কখনো শিক্ষকবৃন্দ নিজেরা হয়ে যান অনড় ৷
কখনো আবার স্টুডেন্টরা শুধু কথা শুনতে পেলো কিন্তু ভিডিও আসলো না, কি জানি কোথায় ছবি আটকে গেছে ৷ নেট দেখায় তার কারসাজি ! ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টদের কথা আর কি বলবো, তারা তো সবসময় লেখাপড়া বলতে ঐ খাতা, কলম আর বইকে বোঝে ৷ স্মার্ট ফোনের এতো অপশন, কোনটায় ঢুকতে কোনটায় ঢুকে পরে, সে এক দারুন কষ্টের বিষয় ৷ এই ধরুন সে ঢুকবে জুম আ্যাপে ,ঢুকে পরলো হোটস্ অ্যাপে ৷ তারা আবার ঐ মিউট,আনমিউটে অনেক কাচাঁ, তারা ওসব পারে না ৷ কেউ কেউ আনমিউট করে বসে থাকে, কেউবা ভিডিও অন করে, পিছনে চা খাওয়া টেবিলের ক্যানভাস দেখা যায় তবুও ৷ এ এক চরম বাস্তবতার সম্মুখীন হলো গোটা জাতি ৷
অনেক বেস্ট স্টুডেন্টদের মাথা খেয়েছে অনলাইন ৷ অপ্রয়োজনীয় সাইটগুলো মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে শিক্ষার্থীদের ৷ বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে আইসিটি বিষয়টাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ৷ এই বইগুলোর বেশির ভাগ বিষয়ই ব্যবহারিক ৷ কিন্তু এ গুলো রপ্ত করার প্রয়োজনীয় ডিভাইস শিক্ষার্থীদের কাছে রয়েছে তো? নাকি তারা সেই আদি শিক্ষাব্যবস্থার মতো মুখস্ত করে যাচ্ছে একের পর এক ৷ দেখার বিষয় এটা ৷ এদিকে উচ্চ মাধ্যমিকের যে বইগুলো বাজারে রয়েছে সবই এনসিটিবি প্রদত্ত অনুমোদিত বর্ধিত সংস্করণ ৷ আমি বলি,বর্ধিত সংস্করণের প্রয়োজনটা কি ? কয়েকটি বিষয় না হয় বাড়ানো লাগে,সে গুলোও সংক্ষিপ্ত আকারে দিয়ে দিলেই হয় ৷ উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা বুঝি উচ্চ মস্তিস্কের অধিকারী যে তারা পদার্থ দুইটা মিলিয়ে পড়বে ষোলোশো পৃষ্ঠার বই ? বাজারের এইসব বইয়ের দিকে দ্রুত নজর দেয়া প্রয়োজন ৷
সবশেষ একটা কথা বলবো যে,আমি এখানে বিষয়গুলোকে হাস্যরসাত্মকভাবে অনলাইনের বাস্তব সমস্যাগুলোকে তুলে ধরেছি ৷ তবে এটা সত্য যে, এই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি দাড়াঁতে হবে পুরো শিক্ষাসিস্টেমকে তা কে ভেবেছে কবে বলুনতো? এই সমস্যার পিছনে কাউকে দোষ দেয়া চলে না, তবে অনলাইন তো আর ক্লাস রুমের বিকল্প হতে পারে না ৷ যেখানে জাতির ভাগ্য লিখিত হয় ক্লাসরুমের অভ্যন্তরে, সেখানে এসব অনলানের কথা তোলা নিরর্থক ৷ কয়েক বছর আগেও পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্ন ফাঁসের কথা শুনতাম ৷ কিন্তু বর্তমান শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষামন্ত্রী তা সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করতে সফল হয়েছেন,যা প্রশংসার দাবিদার ৷ তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন ধারায় সাজাতে কাজ করে যাচ্ছেন ৷ যা সত্যিই আমাদের শিক্ষাসিস্টেমের জন্য দরকার ৷ বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্য থাকার কারণেই আজ আমরা "অনলাইন" নামক শব্দটার সাথে এতো পরিচিত ৷
শিক্ষা ব্যবস্থায় আইসিটি সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো যথেষ্ট বিবেচনার সাথে দ্রুত বাস্তবায়ন দরকার ৷ তবেই ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্যে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে দেশ ,বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিশ্বের বুকে ডিজিটাল মডেল হিসেবে তৈরি হবে খুব শিঘ্রই ৷
শেয়ার করুন